মুক্ত: জেল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে জি এন সাইবাবা, মার্চ ২০২৪। ছবি পিটিআই।
গত ১২ অক্টোবর গবেষক, লেখক ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মী অধ্যাপক গোকরকোন্ডা নাগ সাইবাবা (১৯৬৭-২০২৪) মারা গেলেন। হোয়াই ডু ইউ ফিয়ার মাই ওয়ে সো মাচ: পোয়েমস অ্যান্ড লেটারস ফ্রম প্রিজ়ন— এই বইটিতে জি এন সাইবাবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত থাকাকালীন লেখা কবিতা ও চিঠি সঙ্কলিত। ২০২২ সালে এই ২১৫ পৃষ্ঠার বইটি উদ্বোধনে যাঁরা ছিলেন— অরুন্ধতী রায়, গৌতম নওলাখা, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং— তাঁরা সাইবাবার সহযোদ্ধা, মানবাধিকার আন্দোলনের শরিক। বইটির মলাটে জেলের ভিতরে হুইলচেয়ারে বসে থাকা সাইবাবার দীর্ঘ ছায়া প্রলম্বিত। তিনি পোলিয়ো আক্রান্ত হয়ে ৯০% প্রতিবন্ধী ছিলেন।
দিল্লি ইউনিভার্সিটির রাম লাল কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সাইবাবা দলিত ও ভূমিজ আদিবাসী জনজাতিদের অধিকার নিয়ে আজীবন সরব ছিলেন। যেখানেই রাষ্ট্র দলিত ও জনজাতিদের ভূমি অধিগ্রহণ করেছে, আগ্রাসন করেছে, তিনি তার সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। জনমত তৈরি করেছেন। নিষিদ্ধ মাওবাদী সংগঠন রেভোলিউশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট-এর সঙ্গে থেকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ এনে ‘আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট’ (ইউএপিএ) আইনের নানা ধারায়, আইনবিরোধী কার্যকলাপ (ধারা ১৩), ষড়যন্ত্র (ধারা ১৮), সন্ত্রাসবাদী দলকে সমর্থন (ধারা ৩৯) ও সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার (ধারা ২০) অভিযোগে ২০১৪ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৭-য় সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। জেলে থাকাকালীন যে কোনও অভিযুক্তের আছে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্তুগুলি পাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার। ২০১৮ থেকেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বারংবার ভারত সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে থাকেন যে বিশেষ ভাবে সক্ষম সাইবাবাকে রাখা হয়েছে কোনও রকম মেডিক্যাল সাহায্য ও সুরক্ষা ছাড়াই, তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে এমনকি শৌচাগারে যেতে, স্নান করতে ও খেতে যে সাহায্যটুকু প্রয়োজন, তাও তাঁকে দেওয়া হচ্ছে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিরা বারংবার এই দাবি তোলা সত্ত্বেও সাইবাবার পরিস্থিতির বদল ঘটেনি। এমনকি গ্রেফতার করার সময় তাঁকে যখন হুইলচেয়ার থেকে তুলে পুলিশের গাড়িতে ছুড়ে ফেলা হয়, সেই সময়কার হাতের চোটটিরও কোনও চিকিৎসা জেলে হয়নি। এ ভাবে থাকাকালীন সাইবাবা দু’-দু’বার কোভিড ও এক বার সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত হন। তাঁর শ্বাসকষ্ট, হার্টের অসুবিধা, ব্রেন সিস্ট, পিঠ ও কোমরে ব্যথার সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে ঘোষণা করা হয় যে সাইবাবাকে যুক্তিহীন ভাবে নির্বিচারে জেলে আটকে রাখা হয়েছে, তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। দেশে সাইবাবার আইনজীবী, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যানি বাবু, গৌতম নওলাখা-সহ অন্য মানবাধিকার কর্মীরা সাইবাবার গ্রেফতারকে অযৌক্তিক বলে দাবি তুলে তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলন চালাতে থাকেন।
তাঁর বিরুদ্ধে শেষাবধি কোনও অভিযোগই প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে নিরপরাধ ঘোষণা করলেও সেই রায় আটকে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শেষে এই বছর মার্চ মাসে বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে বেকসুর খালাস দিতে বাধ্য হয়। ক্রোধে ক্ষোভে বাক্রোধ হয়ে আসে ভাবতে গিয়ে যে, গত দশ বছর সাইবাবাকে যে পীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা তাঁর শরীর ও মনের এমন বিষম ক্ষতি করল যে তিনি কারামুক্তির পরে সাত মাসের বেশি আর বাঁচলেন না।
সাইবাবার জেলে আবদ্ধ জীবনে সাধারণ নাগরিকের কোনও অধিকারই রক্ষা করা হয়নি। এ দেশে হাজত-গারদমাত্রেই নির্যাতনের জায়গা। সেখানে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের বৈধ সীমা ন্যায়বিচারের নামে প্রত্যেক মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। জেল-আবাসিকদের মানবাধিকার নিয়ে কারও কোনও হেলদোল নেই। বিচারাধীন জেলবাসী মানুষ সাধারণ চিকিৎসার সুযোগ পান না, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষের জন্য বিশেষ সাহায্য, বা সাধারণ ভাবে মানসিক শুশ্রূষা তো সোনার পাথরবাটি। সাইবাবা একা নন।
তবে সাইবাবার প্রতি গভীরতর অমনোযোগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গে আমরা গত কিছু বছরে ইউএপিএ কী ভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে সেটা এক বার ফিরে দেখতে পারি। গণতন্ত্রের মূল শর্ত যদি ভিন্নমতের সহাবস্থান হয়, আর সেই সহাবস্থান যদি কোনও জনপরিসরে অমিল হয়, যদি আইনি কাঠামোয় তার পথ ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হতে হতে নেই হয়ে ভিন্ন মত বা অসম্মতি হয়ে দাঁড়ায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা হলে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আর যা-ই বলা যাক, গণতান্ত্রিক বলা যায় না।
ইরানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দারিয়ুস রেজালি দেখিয়েছেন, কী ভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শারীরিক অত্যাচার প্রহার ও নির্যাতনের দাগ লুকিয়ে রাখার কায়দা বার করে যাতে স্বৈরাচার করলেও নিজেকে গণতান্ত্রিক হিসাবে পেশ করে চলা যায়। কিন্তু যখন আইনের মধ্যেই থাকে অত্যাচারের ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্বিশেষ সুযোগ, রাষ্ট্রকে তখন আর কোনও আবডাল বা কৌশলই নিতে হয় না। ইউএপিএ সেই রকম একটি আইন। এ ক্ষেত্রে বরং রাষ্ট্র যত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, এই আইনের তত যথেচ্ছ ব্যবহার হয়। কারণ সেই রাষ্ট্রে কোনও অসম্মতিকেই আর সোজা নজরে দেখা হয় না, তাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার তকমা দেওয়া হয়। ক্ষমতার নগ্ন আস্ফালনের আইনি স্বীকৃতি থাকার ফলে উল্টো দিকে চারটে স্লোগান দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। রাষ্ট্রের মূল ও প্রাধান্যকামী বয়ান ছাড়া আর যে কোনও উচ্চারণকেই তখন ‘সিডিশন’ তকমা দিয়ে রাষ্ট্র শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে তোলে। সেটা এতটাই অযুক্তির দিকে চলে যায় যে, ‘কিসের স্বাধীনতা? আমরা কী রকম স্বাধীন হলাম যে স্বাধীনতা দিবস পালন করব?’— ২০১৯-এ মাদুরাইতে এক জন এই পোস্ট দিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে ইউএপিএ-তে গ্রেফতার করা হয়।
ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধের দু’শো বছর পূর্তিতে ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর এলগার পরিষদের উদ্যোগে ২৬০টি অলাভজনক গোষ্ঠী মিলে অনুষ্ঠান করার পরের দিন দলিত ও সবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা বাধে। এরই পরিণতিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার উস্কানির অভিযোগ এনে, আগের দিন ওই অনুষ্ঠানে যাঁরা বলেছিলেন সেই সব লেখক, কবি, অধ্যাপক, মানবাধিকার কর্মী, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কর্মীদের ২০১৮ সাল জুড়ে গ্রেফতার করা হয়। সোমা সেন, ফাদার স্ট্যান স্বামী, ভারাভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন, গৌতম নওলাখা, হ্যানি বাবু, আনন্দ তেলতুম্বডে-সহ এই তালিকার সকলেই নানা ভাবে দলিত ও জনজাতির অধিকার নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছিলেন। অনেকেই তেলঙ্গানা, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত নানা এলাকায় দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে দলিত জনজাতির অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার হলে জামিন স্বীকৃত নয়। এই আন্দোলন কর্মীদের বয়স, অসুস্থতা ও বিশেষ প্রয়োজনের রেয়াত না করে নির্বিচারে বিনা বিচারে এঁদের ‘ডিটেন’ করিয়ে রাখা হয় এক দশকের পার। গ্রেফতারের সময় এঁদের অধিকাংশ বয়স ছিল ষাটের উপর, স্ট্যান স্বামীর বয়স ছিল তিরাশি। সাইবাবার মতো এঁদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, দ্রোহের উস্কানি, সন্ত্রাসবাদী দলের কাজকে সমর্থন বা তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার ধারাগুলি প্রয়োগ করা হয়। স্ট্যান স্বামী পারকিনসন’স রোগে ভুগছিলেন। খাওয়ার সুবিধার জন্য একটা স্ট্র অবধি তাঁকে দিতে রাজি হননি জেল কর্তৃপক্ষ, এটা জানলে কি ক্রোধে ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয় না?
সেই উপনিবেশকালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি দিতে তৈরি কঠোর সিডিশান অ্যাক্ট আজও ইউএপিএ নামে থেকে গিয়েছে— রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণকে আইনি পথে শাস্তি দিতে। কিন্তু কোনটাকে দ্রোহ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বলা হবে তার সংজ্ঞা বদলায়, আর সেটাও ঠিক করে রাষ্ট্রই। গত দশ বছরে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার যেমন বেড়েই চলেছে, তেমনই প্রলম্বিত হয়ে চলেছে বিচারহীন ভাবে আটক থাকার সময়। রাষ্ট্র কোন কোন আচরণকে সন্ত্রাস বলছে নিশ্চয়ই তার একটা হদিস এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। আর সন্ত্রাস কাকে বলা হচ্ছে তা জানলে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঠিক কী হয়ে উঠতে চায় সে-ও বুঝে নেওয়া আর ততটা কঠিন হয় না।