কলকাতার দুর্গাপুজো সম্প্রতি তার মানবিক আবেদনের জন্য ইউনেস্কোর আবহমান সাস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হল। বাঙালি হিসাবে গর্বই হচ্ছে কথাটা শুনে। ভারত জুড়ে এই সম্মানের উদ্যাপন চলছে। এই স্বীকৃতির আলোয় নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সকলেই সুযোগ খুঁজছে। হিসাব করতে বসা হয়েছে, কী ভাবে এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরি করা যায়— দুগ্গা মা এখন কলকাতার বিজ্ঞাপনের মুখ। সম্প্রতি একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান দুর্গাপুজোর বাজার নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে— যা সামনে এসেছে তাতে অর্থনীতিবিদদের আক্কেল গুড়ুম। এমন একটা বাজার কি হাতছাড়া করতে আছে?
সহস্রাব্দের প্রথমে কলকাতার থিমপুজোর জন্ম। চেনা-অচেনা জায়গাগুলো সাময়িক ভাবে বদলে তৈরি হয় এক কল্পলোক। কলকাতার দুর্গাপুজো একটি নাগরিক অভিব্যক্তি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার হাত ধরে তার প্রকাশ। এতে শহরের এই সৃষ্টিসম্ভাবনা একটি নান্দনিক পটভূমিকা পায়। শহর জুড়ে ছড়ানো-ছিটোনো নানা পাড়া বা গলি বা মাঠে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যায় নিঃশব্দে। শহরের পুজোর সাজ এক অচেনা, অন্য কলকাতা গড়ে তোলে।
কেন এই পরিবর্তন? কী ভাবে কারা বদলে ফেলে শহরটাকে? কোন তাগিদে? প্রশ্ন জেগেছিল মেলা। দেখেছিলাম সেই সব একলব্যদের (থিমস্রষ্টা), যাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। মিশেল ফুকো-র ‘হেটারোটোপিয়া’, ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাকেই চিনি মায়া ও বিভ্রম বলে। যেখানে ‘স্পেস ডিজ়াইন’ বদলে যায় ‘প্লেস ডিজ়াইন’-এ। পাড়ার মানুষের আবেগ, অভিমান ও ক্ষমতা— একটা মিলিত উদ্যোগ, সব মিলিয়ে অভিনবত্বের ছড়াছড়ি। লক্ষ লক্ষ বাঙালি, অবাঙালি জাতিমত নির্বিশেষে রাস্তায় ঘুরে একে স্বাগত জানায়। আমরা নগরবাসীরা অনুভব করি এর বৈশিষ্ট্য, এ একান্তই শহর কলকাতার আবেগ। বহু মানুষকে আপ্লুত করার অভিনব প্রক্রিয়া।
এর এমন আবেদন বিশিষ্ট সমাজপতিদের দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রচারমাধ্যম এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল ‘বাজার’। আমরা দেখেছিলাম ‘কর্পোরেট’ দুর্গাপুজো— হরেক পুরস্কার, সবাই দুর্গার আলোয় ধন্য হতে চাইছিলেন। বনেদি পুজো রাস্তায় নেমে হল বারোয়ারি পুজো। সেটাই পার্ক, স্কোয়্যার, সার্কাসে চেহারা নিল সর্বজনীন পুজোর। উদ্যোগপতি অর্থ ও লোকবলের জোগান দিলেন, কোটি টাকায় উন্নীত সেই পুজো পরিণত হল অবশ্যদ্রষ্টব্য পুজোমণ্ডপে— মাথা ঘোরানো কল্পজগৎ। বিপুল প্রচার, লাগামহীন বিজ্ঞাপন আর তার শহরের গণ্ডিতে আটকে থাকতে চায় না— হতে চায় বিশ্বপর্যটনের আকর এবং তার জন্য চাই এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এতে শহর বা রাজ্যের ভূমিকা গৌণ। অনেক প্রান্তিক মানুষজন, যাঁরা বঙ্গবাসীর আসল মুখ, জাতপাত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে যাঁরা এই পুজো, শহরের এই বিবর্তনে যোগ দেন, তাঁদের বছরভর সংসারনির্বাহের মূল সংস্থান দুর্গাপুজোর নানা কর্মকাণ্ড। ডেকরেটিং, মণ্ডপ তৈরি, আলো, অলঙ্কার, কায়িক শ্রম, ঢাক, পুজোর উপচার, রেস্তরাঁ— সর্বত্র তাঁদের জীবনসম্ভাবনা। বঙ্গবাসী নিজেদের মতো করে এই আয়োজনকে উদ্যাপন করেছি। একে অপরের সঙ্গে মিলেছি, আনন্দ করেছি।
আনুমানিক চল্লিশ হাজার কোটিরও বেশি লেনদেন হয় পুজোয়। যার সিংহভাগ আজও সঞ্চারিত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে। পুজোর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। এটি আদ্যন্ত বাংলার উৎসব। উৎসবের ঋতুতে পর পর পুজোগুলিতে এই অর্থ আরও আবর্তিত হয়। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সুবাদে আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনার প্রস্তাবটি ভাল। এর ফলে বিদেশি মুদ্রা আসবে, যার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু সে সব বাদ দিয়েও দুর্গাপুজোর নগদ প্রাপ্তি যথেষ্ট। তা ছাড়া, বাঙালির উৎসবে আন্তর্জাতিকতার বাড়তি আগ্রহ কিন্তু বেশ বিড়ম্বনার কারণ হবে।
নিজেদের জন্য, নিজেদের তৈরি, নিজস্ব সংস্কৃতি ঘিরেই এই উৎসবের কক্ষপথ। সেখানে আছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য, সুষম এক বিন্যাস। কিছু লোকের বাড়তি আগ্রহ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা এই ভারসাম্যে বিঘ্ন তৈরি করবে, সেটাই চিন্তার। একে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বেলাগাম পর্যটন এ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেরই ভারসাম্য নষ্টের কারণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। যে বিষয়কে ঘিরে উন্নতির ভাবনা শুরু, সেটিই হয়ে দাঁড়ায় তার অবলুপ্তির মাধ্যম।
ভারতে ইউনেস্কোর এমন স্বীকৃতি ২০০৮ থেকে ২০২১ অবধি চোদ্দো বার এসেছে। বাংলায় একমাত্র ছৌ নাচ এর দাবিদার হয়েছে। অন্য রাজ্যে বাকি যে ক’টা স্বীকৃতি এসেছে, সেগুলির রাজ্য-অর্থনীতিতে এমন ব্যাপক প্রভাব নেই। দেখা গিয়েছে, এই স্বীকৃতি আজ অবধি সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যটির সঙ্গে জড়িত প্রান্তিক অঞ্চল ও মানুষজনের জীবনে বিশেষ উন্নতির কারণ হয়নি। ফলে যে দুর্গোৎসবের এমন পরিচিতি ও ব্যাপ্তি, তার জন্য স্বীকৃতিটুকুই যথেষ্ট। তার জন্য নিজেদের ঐতিহ্য বদলানোর ও তাকে ‘ফর্মালিটি’ বা আনুষ্ঠানিকতার আওতায় আনার বিশেষ প্রয়োজন দেখি না। কলকাতাবাসী নাহয় আধুনিক কালিদাস না-ই হল।