ধরুন, আপনার আঙুলে ঘা হল। ভাবলেন, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঘা বাড়তে থাকল। আপনি ছোটবেলার শেখানো বুলি আওড়ালেন, ‘শরীরের নাম মহাশয়…’, যন্ত্রণা কমাতে মা-মাসিমাদের শেখানো ঘরোয়া টোটকা লাগালেন। তাতে হিতে বিপরীত হল। যখন ডাক্তারের কাছে পৌঁছলেন; তত ক্ষণে সেপসিস হয়ে গিয়েছে, আঙুল বাদ না দিলে প্রাণসংশয়!
দোষ আপনার নয়। এই ধামাচাপা, জোড়াতালি ও আর একটুখানি সয়ে যাওয়ার শিক্ষা নিয়েই তো আমরা বেড়ে উঠেছি। আপনি মহিলা হলে খুব ভালই জানেন, জীবনের অর্থ ও গৌরব দুই-ই লুকিয়ে আছে এই মুখ বন্ধ করে সয়ে যাওয়ায়।
এর বাস্তব প্রতিফলন এ দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে। চতুর্থ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রতি তিন জনে এক জন বিবাহিত মহিলা পারিবারিক হিংসার শিকার। দেশের মহিলাদের স্বামীর হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা, অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে অন্তত ১৭ গুণ বেশি। ভারতে বছরে প্রায় ৭৫০০ মহিলা পণের দাবিতে প্রাণ হারান। জাতীয় অপরাধ তথ্য সংস্থার ২০১৯-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি চার মিনিটে এক জন বিবাহিত মহিলা পরিবারের হাতে নির্যাতিত হন। বিবাহিতাদের প্রতি তাঁর পরিবারের হিংসার ঘটনার নিরিখে ভারত বিশ্বের সকল উন্নত ও সিংহভাগেরও বেশি উন্নয়নশীল দেশের পিছনে।
ঘরের অলিন্দেই মহিলাদের প্রতি এই অত্যাচারের ঘটনা নিদারুণ চিন্তার। কিন্তু বেশি চিন্তার কথা হল, অত্যাচারের এই আখ্যান দেশের বিবাহিত মহিলারা যুগের পর যুগ বয়ে চলেছেন। নারীজীবনের অঙ্গ বলে মেনে নিয়েছেন। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেননি। অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা-র প্রতিবেদন বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের হার বিশ্বে সবচেয়ে কম ভারতে— ২০১৭-র হিসেবে, এক শতাংশ। বিশেষত, ১৯৬০ থেকে যেখানে বিশ্ব জুড়ে বিবাহবিচ্ছেদ ২৫১.৮% বেড়েছে, সেখানে এ দেশে প্রতি ১০০০টি বিবাহে মাত্র ১৩টি বিচ্ছেদ অপার্থিব সুখকর শোনায়। মুশকিল হল, দেশের বিবাহিত নারীদের উপর গার্হস্থ হিংসার তথ্যের সঙ্গে এই পরিসংখ্যান মেলে না। কারণ, বিশ্ব জুড়ে বিবাহবিচ্ছেদের চারটি মূল কারণের অন্যতম গার্হস্থ হিংসা। এ দেশের বিবাহিত মহিলাদের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ঘটনার পাশে, এই এক শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা দেখায় যে, অত্যাচারের প্রতিবাদ নয়, হিংসামূলক দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে আসা নয়, সহনশীলতাকেই দেশের মেয়েরা জীবনের ব্রত মেনেছেন। ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এইটুকু সমস্যা হতেই পারে’, ‘সংসারে থাকতে গেলে মানিয়ে নিতে হয়’ কিংবা ‘বিয়ের পর স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঠিকানা’ জাতীয় ভাবনা ও একটু একটু করে সয়ে যাওয়ার চিরাচরিত শিক্ষাই শেষমেশ দেশের মেয়েদের জীবন বিষাক্ত করে তুলেছে, প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু মহিলাদের কথা তোলার অনেকগুলো কারণ। প্রথমত, সমসাময়িক গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে, এক দিকে লিঙ্গবৈষম্যের কারণে এবং অন্য দিকে আর্থসামাজিক ভাবে, দেশের মহিলারা পুরুষদের থেকে ভীষণ পিছিয়ে। এতটাই যে, সিংহভাগ মহিলা শত অন্যায়-অবিচারের পরেও বিবাহবিচ্ছেদের পথে হাঁটতে চান না। দেশে গার্হস্থ হিংসার বাড়বাড়ন্তও মূলত এই কারণেই। দ্বিতীয়ত, ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, দেশে বিবাহবিচ্ছিন্ন মহিলার সংখ্যা (৩২ লক্ষ) বিবাহবিচ্ছিন্ন পুরুষের (১৫ লক্ষ) দ্বিগুণেরও বেশি। এই সংখ্যাগত ব্যবধানের মূল কারণ বিবাহবিচ্ছিন্ন পুরুষের পুনর্বিবাহ, যা সামাজিক ভাবে সহজতর। অন্য দিকে, দেশের মহিলাদের বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়ার মূল কারণ গার্হস্থ হিংসা। তাই সামাজিক বাধা বাদ দিলেও, সেই হিংসার ক্ষতকে অতিক্রম করে পুনর্বিবাহ তাঁদের পক্ষে দুঃস্বপ্নের মতো।
একুশ শতকে দাঁড়িয়েও দেশের মহিলাদের হিংসাত্মক বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার কারণ কী? সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনিব্যবস্থার আঙ্গিকে তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
প্রথমত, ভারতে বিবাহ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তা দু’টি মানুষের আত্মিক যোগের চেয়েও বেশি জোর দেয় দু’টি পরিবারের সামঞ্জস্য ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার উপর। এই নৈর্ব্যক্তিক পরিণয়ভিত্তি, সামাজিক ও পারিবারিক দায়দায়িত্ব, নিয়মানুবর্তিতার আড়ালে দু’টি মানুষের ভালবাসা দম নেবে কী করে? বিষয়টি নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। তবে, ভারতীয় সমাজ মূলগত ভাবে পুরুষশাসিত। তাই নিয়মের বেড়াজাল তথা সমাজ ও পরিবার টিকিয়ে রাখার দায় মেয়েদেরই উপর বর্তায়। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’— শৈশব থেকেই এই সহজ পাঠ মেয়েদের রক্তমজ্জায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, সংসার প্রেমহীন হলেও আজন্মলালিত মূল্যবোধ ত্যাগ করে সংসার ভেঙে বেরোনো, তাঁদের জীবনদর্শনের অতীত।
অনুষ্ঠান, পূজাপার্বণের রীতিনীতিও সধবাদের গৌরবান্বিত এবং অবিবাহিত, বিবাহবিচ্ছিন্না, বিধবাকে প্রান্তিক করেছে। সিঁদুরখেলা থেকে করবা চৌথ— সর্বত্র এয়ো-স্ত্রীদের উপযোগিতা, দেশের বিবাহবিচ্ছিন্নাদের বোঝায় যে, ‘বিবাহিতা’ তকমার সঙ্গে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও হারিয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থনৈতিক। দেশের মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে, দীর্ঘ দিন নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি জোরালো করতে পারেননি। বেতনভিত্তিক শ্রমের বাজার থেকে দূরত্ব তাঁদের পরনির্ভরশীল করেছে। আজও দেশের প্রায় ৮০% মহিলাই কেবল অবৈতনিক ও গার্হস্থ শ্রমে নিয়োজিত। ফলে, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাঁদের বাধ্য করে হিংসার দাম্পত্য মুখ বুজে মেনে নিতে।
সঙ্গে জুড়েছে দেশের সনাতন ও দীর্ঘসূত্র আইনিব্যবস্থা। গার্হস্থ হিংসার বেশ কিছু রূপ এ দেশে এখনও আইনের চোখে অপরাধমূলক নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের ১৯৫টির মধ্যে ৩৬টি দেশ বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় ফেলে না। ভারত তারই একটি।
দেশের এই সামগ্রিক জটিল আর্থসামাজিক ও আইনিব্যবস্থা মেয়েদের মুখ বুজে ‘ঘা’ সইতে শিখিয়েছে, সকল প্রাণশক্তিটুকু দিয়ে…
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়