সঙ্ঘবদ্ধ: আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিটে মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচি, ১৪ অগস্ট। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
এ বার ১৪ অগস্ট রাতে সারা কলকাতা, সারা বাংলার মেয়েরা জনজোয়ারে বদলে দিয়েছিল পথের ছবি। তিন জায়গায় যে জমায়েত হওয়ার কথা, তা হল শত শত জায়গায়। লক্ষ লক্ষ মেয়ের সঙ্গে পথে নামলেন কিশোরকিশোরী, পুরুষরা। তবে, স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলন হলে যা হয়, সব নিশ্ছিদ্র হল না। কোথাও মিছিলে ঢুকে এল অবাঞ্ছিত সমাজবিরোধীরা। তবু কেঁপে গেল তাদের বুক কিছু অপরাধীর সুরক্ষা যাদের কাছে নাগরিক সুরক্ষার চেয়ে বেশি জরুরি। আর জি কর হাসপাতালে সমাজবিরোধীদের ভাঙচুর, জনসম্পত্তি নষ্ট এবং পুলিশের অনুপস্থিতি যে চিত্রনাট্য তৈরি করল তার রসিক হতে গেলে সিনেমাবোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। আমরা যে আরম্ভটা জানি।
সাউন্ডপ্রুফ সেমিনার রুম। ব্যস্ত হাসপাতালের জনাকীর্ণ ওয়র্ডের থেকে দূরে, এক কোনায় গোঁজা। ওখানে এসি কাজ করে। তাই ঘুমোনোর জন্য সুবিধাজনক। যে ঘুমোতে চেয়েছিল একটানা ডিউটির পর, তার এখন চিরনিদ্রা। কোনও চিৎকার ভেসে আসেনি। সম্ভবত একাধিক ব্যক্তির অত্যাচারে ঘটে গেছে এই নির্মমতম পরিকল্পিত ধর্ষণ ও হত্যা। আততায়ী কারা ছিল? কোনও দিন জানা যাবে কি?
এ কামদুনির মতো গ্রামাঞ্চল নয়, যেখানে কলেজ থেকে ফেরার পথ থাকে জনহীন। তেহট্ট নয়, যেখানে ধর্ষণের পর স্থানীয় প্রভাবশালীর নির্দেশে দেহ দাহ করে দেওয়া হয় স্বীকৃতিহীন শ্মশানে। কলকাতার গমগমে ব্যস্ত এলাকা, সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের কাজের জায়গা। সেই জন্য আর জি করের ধর্ষণ ও হত্যা হয়তো নির্ভয়া কাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি বীভৎস। অপরাধীদের মনোভাব প্রশাসনের প্রশ্রয় নিয়ে নিশ্চিন্তে ছিল।
মহানগরের মানুষ এ বার চমকে উঠে বসেছেন ঘটনার বীভৎসতার সঙ্গে বিপদের নৈকট্যের আভাসে। এ যেন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আততায়ী। অনেকে সমাজমাধ্যমে লিখছেন, আমার কন্যার জন্য ভয় করছে। শুধুই ভীত কন্যার পিতা বা তাদের স্বজন? যে নাবালক সন্তান গত বছর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়তে গিয়ে ফেরেনি, যাকে দীর্ঘ লাঞ্ছনার পর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ ছিল মেধাবী ছাত্রদের বিরুদ্ধে, তার মৃত্যুর কিনারা আজও হয়নি। আর জি করের ঘটনায় আক্রান্ত ও নিহত এক নারী। কিন্তু প্রশ্নটা আর কেবল নারীর সুরক্ষায় আবদ্ধ থাকছে না। স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সাধারণ নাগরিকের জীবন আসলে রাষ্ট্র বা তার প্রতিভূ সরকারের কোনও মাথাব্যথাই নয়। সরকার তাঁদেরই সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, যাঁরা নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে চান। বাকিদের জীবন গৌণ।
১৯৯৭-এ বিশাখা রায়ের আগে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের কোনও স্বীকৃত মৌলিক অধিকার ছিল না। কাজের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বা অত্যাচার হলে আইন সংহিতার ধারায় নালিশ দায়ের করতে হত। ২০১৩-য় এসেছে যৌন হেনস্থা নিবারণী আইন। কিন্তু কেবল আইন থাকলেই লড়াই শেষ হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বদলির শাস্তি পায় মেয়েটি। অসংগঠিত ক্ষেত্রে তো সুরক্ষা বা সমাধানের প্রশ্ন নেই। অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোথাও অন্তর্বর্তী অভিযোগ কমিটি নেই, কোথাও তা অদৃশ্য, কর্তাদের দ্বারা অলঙ্কৃত হয়ে বসে আছে।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে অভিযোগ কমিটির সদস্য সেখানকার প্রিন্সিপাল, যা মোটেই আইনানুগ নয়।
বাংলার দুর্ভাগ্য, কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষার সঙ্গে দুর্নীতির রাজ্যব্যাপী সংস্কৃতি পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি একটা অদ্ভুত সোনার তরোয়াল, যার পরশে যে কোনও দরজা খোলে। অথচ, দুর্নীতি নির্বাচনে কোনও বিষয় হয় না।
এই ঘটনায় একমাত্র ধৃত, সেও এক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার ফসল। থানা স্তরে বিপুল সংখ্যক রিক্ত পদ থাকা সত্ত্বেও, কম টাকায় কোনও রকম ভর্তির পরীক্ষা ছাড়া কেবল শাসক দলের প্রতি ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেড় লক্ষের মতো সিভিক ভলান্টিয়ার কাজ করে। কোনও কোনও থানা জানেই না তার অধীনে কত সিভিক ভলান্টিয়ার। এরা ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট থেকে গ্রাম সালিশি সবই করে। এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সংসর্গে কেউ কেউ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।
আর জি কর কাণ্ডের ধৃত এমনই এক ক্ষমতাধর। পুলিশ বলে নিজের পরিচয় দেয়, পুলিশ লেখা বাইক চড়ে, হাসপাতালে অবাধ যাতায়াত। ২০১২ সাল থেকে রাজ্য সরকার এই সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এক বাহিনীকে পুলিশের সহায়তায় জুড়ে দিয়েছে। কিছু মানুষকে গোধূলিসন্ধির ছায়ায় যা ইচ্ছে তাই করতে দিয়ে কিছু প্রভাবশালীর অসাধু পথে রোজগার বেড়েছে, আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলার ভূমি।
এক সিভিক ভলান্টিয়ারের দাপটের চেয়েও গুরুতর ব্যাপার হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি চক্র চালানোর অভিযোগ। তাঁর সহকর্মীরা চুপ করে থেকে অন্যায় করেছেন। অভিযোগ, তরুণ ডাক্তাররাও চক্রে জড়িয়ে গেছেন ক্ষমতা ও টাকার লোভে। বাবা-মায়েরা জানতেন না, তাঁদের সন্তানরা পরিণত হচ্ছে রক্তপিপাসু পিশাচে? প্রিন্সিপালের মাথায় সরকারের এমন স্নেহের হাত যে তিনি ছাত্রদের দাবিতে বদলি হলেও উচ্চতম নির্দেশে পেয়ে যান আর এক হাসপাতালের দায়িত্ব। তাঁকে শেষ পর্যন্ত ছুটিতে পাঠাতে হয়েছিল আদালতের নির্দেশে, সিবিআই তাঁকে ডেকে পাঠানোর আগে।
কিন্তু দুর্নীতিপরায়ণকে কেন এত স্নেহ? ঘটে যাওয়া অপরাধ তাঁর প্রশাসনিক গাফিলতি জেনেও পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে না, তিনিও মৃত্যুর ঘটনায় কোনও নালিশ দায়ের না করে পার পেয়ে যান। ছাত্র-আন্দোলনের অনুগত সৈনিকরা প্রথম দিকে তাঁর বদলির বিরোধিতা করছিল, এমনই এই সোনার তরোয়ালের খেলা। ক্রাইম সিনে অদলবদল ঘটিয়ে দেওয়া হল কোর্টের নজরদারি সত্ত্বেও। ক্রাইম সিন কি সেমিনার রুম না অন্য কোথাও?
দুর্নীতির চক্র অবৈধ টাকা তৈরি করে, আজকের দিনে পার্টির শাসন চালাতে তার বিরাট প্রভাব। হয়তো ইলেকশন বন্ডের টাকার চেয়ে বেশিই।
এই চক্রের হাতেই কি এমন নারকীয় আক্রমণ আমাদের কন্যাটির উপর এবং তার হত্যা? শোনা যায়, সে প্রয়োজনের বেশি জেনে ফেলেছিল। তাই কি এমন হিংস্র হত্যা ও নির্মম নিধন? তাই কি মৃত্যুর পর এত মিথ্যাচার? এমন তোড়জোড় যে শাসক দল সমর্থক ডাক্তারদের এসে বসে থাকতে হয় ঘাঁটি গেড়ে? রাজ্যের সর্বোচ্চ স্তরেও তা হলে টাকা-ই এক মেধাবী ডাক্তারের জীবনের চেয়ে বড়।
আমরা যেন মনে রাখি, দুর্নীতি যখন রাজ্য চালানোর মূলমন্ত্র, তখন লোভ ও ক্ষমতার অরাজকতা কাউকে ছাড়বে না। চোখকান খোলা যে কোনও নাগরিকের প্রাণ যেতে পারে। রাত দখল করা, আর জনপ্রতিরোধের যে আন্দোলন এক সপ্তাহের মধ্যে গড়ে উঠল আমাদের চোখের সামনে, তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তাকেও কিন্তু দাবি করতে হবে দিন বদলের। না হলে নারী পুরুষ কারও জন্য কোনও সুরক্ষিত স্থান থাকবে না।
নারী-সুরক্ষা কোনও পাশবালিশ নয় যা কোলে করে বসে থাকা যায়। এই তো সিসিটিভি লাগিয়ে দিলাম, আর মেয়েদের ক্যারাটে কুংফু শেখালাম। সাবধানতা, সতর্কতা হিসাবে ভাল। কিন্তু এটাই সমাধান নয়। সিসিটিভি বিকল করা যায়, সংগঠিত আক্রমণের মুখে ক্যারাটে কাজে লাগে না।
আমাদের পোড়া দেশে রাত জাগা ফুরোয় না। জনজীবন বিকল না করেও চলতে পারে লাগাতার জনআন্দোলন, নির্বাচনের অপেক্ষা না করে শাসককে লাগাতার প্রশ্ন। আমরা দেখছি, সরকার জিতে এসে মানুষকে চুপ করিয়ে রাখে। কথা বললে তার পুলিশ নির্মম ভাবে রাস্তায় ফেলে মারে।
সারা রাজ্য যদি সাউন্ডপ্রুফ ‘সেমিনার রুম’ হয়ে যায়, আমাদের চিৎকার কোথায় কার কাছে পৌঁছবে?