জরুরি প্রশ্নটা আবার আমাদের সামনে। তা হলে কাজের জায়গাতেও মেয়েরা সুরক্ষিত নয়? আর কত অপেক্ষা করতে হবে তার জন্য?
মেয়েদের প্রতি কাজের অথবা লেখাপড়ার জায়গায় যৌন হেনস্থা একটি অতি চেনা ঘটনা। ১৯৯২ সালে ঘটে যাওয়া রাজস্থানে ভানওয়ারি দেবীর ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে নারী আন্দোলন উত্তাল হয়েছিল, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধে ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে বিশাখা নির্দেশিকা তৈরি হয়েছিল। ২০১৩ সালে সেই নির্দেশিকা আইনে পরিণত হয়। ঠিক হয়, আইন অনুযায়ী সব কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একটি ইন্টারনাল কমিটি গঠন করবে এবং সেই কমিটিতে সংস্থার কর্মী ছাড়াও এ বিষয়ে দক্ষ এক জন মহিলা থাকবেন। এই কমিটিতে সংস্থার পরিচালক অথবা পরিচালন সমিতির সদস্যারা থাকতে পারেন না।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় প্রথম প্রশ্ন ওঠে এই ইন্টারনাল কমিটির ভূমিকা নিয়ে। ইন্টারনাল কমিটির কাজ কিন্তু শুধুমাত্র ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তদন্ত করা নয়। আইন অনুযায়ী, ইন্টারনাল কমিটি নিয়মিত কর্মী, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং কমিটির সদস্যদের যোগাযোগের তথ্য অর্থাৎ ইমেল, ফোন নম্বর ইত্যাদি সংগ্রহ ও সরবরাহ করবে। নিয়মিত কর্মী ছাড়াও আংশিক সময়ের কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক সকলেই এই আইনের আওতাভুক্ত। শোনা যাচ্ছে, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এই ইন্টারনাল কমিটিতে অধ্যক্ষ মহাশয় স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, যা কিনা আইনবিরুদ্ধ।
সারা বিশ্বের এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের তুলনায় ভারতে মেয়েদের কর্মী-বাহিনীতে যোগদান কম। ২০২১ সালের ‘পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স’ সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে শ্রমবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮%। মেয়েদের কর্মী-বাহিনীতে যোগ দেওয়ার অন্যতম অন্তরায় হল কাজের জায়গায় যৌন অত্যাচার। শারীরিক ছাড়াও, বিভিন্ন ভাবে মেয়েদের উপর কাজের জায়গায় যৌন নির্যাতন চলে। যৌন নির্যাতনের ভয় মেয়েদের কাজ নির্বাচনের সময় একটি প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয়ের কারণে পরিবারও মেয়েদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নির্বাচনে বাধা দেয়। মেয়েদের পেশা বাছার সময় প্রথমেই তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবে পরিবার এবং মেয়ে নিজেও, তার পর পারিশ্রমিক, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। কলকাতার এত বড় মেডিক্যাল কলেজে যৌন নির্যাতন ও প্রাণহানির মতো ঘটনাকে যখন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য কর্মপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের কী আশঙ্কায় কাজ করতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় জাতপরিচয়ও। যেমন হয়েছিল ১৯৯২ সালে ভানওয়ারি দেবীর গণধর্ষণের ঘটনায়। ধর্ষকরা তথাকথিত ‘উঁচু সম্প্রদায়’-এর বলে তাদের প্রথমে রাজস্থান হাই কোর্ট বেকসুর খালাস করে দেয় এই মর্মে যে, ‘উচ্চ সম্প্রদায়’-এর মানুষ কখনও ‘নিম্নবর্গ’-এর মানুষকে ছোঁয় না। হাথরসেও দেখেছি, মেয়েটির লিঙ্গ ও জাত পরিচয়ের কারণে তাকে দ্বিমাত্রিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
যদিও আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ, জাত, ধর্ম, বর্ণ, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ, বাস্তবে কাজের জায়গায় লিঙ্গ জাতি, ধর্মীয় ও অন্যান্য প্রান্তিক অবস্থানের মেয়েদের ক্ষমতার সোপানতন্ত্রে উপরের দিকে অবস্থানকারী মানুষ যৌন নির্যাতনের জন্য তাদের অতিশয় সহজলভ্য মনে করে। দীর্ঘ দিনের ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের দাপটের দরুন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মেয়েদের কাজের জায়গায় পরিচিতির ভিত্তিতে বহুমাত্রিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
আরজি কর-এর ঘটনাটি আর একটি ভয়ঙ্কর চিন্তা মাথায় আনে। ভানওয়ারি, মথুরা থেকে শুরু করে সম্প্রতি নির্ভয়া, কাঠুয়া, হাথরস ইত্যাদি ধর্ষণের ঘটনাস্থল পথঘাট। কিন্তু এই ঘটনা ঘটেছে খাস হাসপাতালে। নিরাময় স্থলেও যদি মেয়েরা সুরক্ষিত না থাকে, তা হলে অন্যান্য জনস্থানে কী অবস্থা!
লক্ষণীয়, এ দেশে সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হলে বিরোধী আসনে বসতে হয়! যখন যে রাজ্যে কিংবা কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেখানে নারী- নির্যাতন হলে ক্ষমতাসীন দল হয়ে যায় ধৃতরাষ্ট্র। ইদানীং কালে বিনেশ ফোগট থেকে শুরু করে হাথরসের ছোট্ট মেয়েটির যৌন নির্যাতনের ঘটনা আমরা ভুলতে পারি না। আমাদের রাজ্যে সরকার অদ্ভুত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এই মুহূর্তে। তড়িঘড়ি এমন কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে যাতে মেয়েদের রাতের ডিউটি দেওয়াই কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই গল্প, যেখানে গ্রামে বাঘ পড়েছে বলে বাঘকে না তাড়িয়ে সন্ধেবেলা গ্রামবাসীদের ঘরে ঢুকে বসে থাকতে বলা হচ্ছিল। তা হলে যারা অত্যাচারী তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর মেয়েরা সুয্যি ডুবলেই অন্তরালবর্তিনী হবেন? সত্যিই যদি কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বন্ধ করতে হয়, তা হলে দরকার যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের যথার্থ প্রয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এবং নাগরিকের নারীবিরোধী চিন্তাভাবনার অবসান।