Politics

নিরামিষ চাপানোর রাজনীতি

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫’এর রিপোর্ট বলছে, ভারতে ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মাছ, ডিম বা মাংস পছন্দ করেন।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২২ ০৪:৪৭
Share:

মহম্মদ আখলাককে যে দিন ‘গোমাংস ভক্ষণকারী’ বলে পিটিয়ে মারা হল, আমরা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ‘গোমাতা’ ও ‘বিধর্মী’কেন্দ্রিক। ভুল। বিক্ষিপ্ত শক্তি প্রদর্শনকে গ্রন্থিত করার সেটা ছিল ভূমিকা। আখলাকের খুনিদের হাত লম্বা হতে হতে ‘সমধর্মী’-দের টুঁটিও চেপে ধরছে। আমিষ খাওয়াকে গো-বলয় আগেই অপরাধ সাব্যস্ত করেছিল। এখন সারা ভারতেই ‘নিষেধাজ্ঞা’র চাপ। প্রস্তুতি চলছিলই— জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রদর্শনীতে আমিষ নিষেধ, গান্ধীজির জন্মদিনকে ‘নিরামিষ দিবস’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভারতীয় রেলে আমিষ বন্ধ রাখার চেষ্টা। এই আমিষবিদ্বেষীর দল যখন যেখানে সিংহাসন দখল করেছে, নিরামিষের দাবিতে হয়েছে জবরদস্তি। সরকারের তরফেও প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখা যায়নি।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও দিল্লির কিছু এলাকায় নবরাত্রিতে মাংস বিক্রি বন্ধের ফরমান জারি হয়। আমদাবাদের পথে এবং স্কুল ও ধর্মস্থানের কাছে সব মাংসের দোকান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। গুরুগ্রামে বিশেষ দিনে মাংস বিক্রি নিষেধ হয়। বরোদা, রাজকোটে মাংস বিক্রি করতে হলে তা ঢেকে করার ফরমান দেওয়া হয়। নিরামিষ ‘আগ্রাসন’ থেকে বাদ যায়নি শিশুরাও— ১২টি রাজ্যে মিড-ডে মিলে ডিম বাদ রাখা হয়। পরিকল্পিত ভাবেই আমিষবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাকে ‘অনার্য’, ‘অসভ্য’-এর খাদ্য প্রমাণ করা হচ্ছে— আমিষ নাকি মানুষকে হিংস্র বানায়! আশ্চর্যের কথা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকও টুইট করেছিল যে, আমিষ খেলে স্থূলতা বাড়ে! পরে তা মুছে ফেলা হয়।

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫’এর রিপোর্ট বলছে, ভারতে ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মাছ, ডিম বা মাংস পছন্দ করেন। উত্তর ও মধ্য ভারত বাদ দিলে দেশের বাকি সব অঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ আমিষ খান। প্রতি তিন জনে দু’জন ভারতীয় আমিষপ্রিয়। আবার হরিয়ানা, গুজরাত, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে অজস্র মানুষ আছেন, যাঁরা আমিষ স্পর্শ করেন না। নিরামিষাশীরা সকলেই স্বেচ্ছায় আমিষ বর্জন করেছেন, না কি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের শিকার হয়েছেন, এই প্রশ্নও উঠছে। কারণ গো-বলয়ের হাতে এখন রাজনৈতিক শক্তি; আমিষ অধিকাংশের অপছন্দ হলে পরিবারের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে এত মানুষ মাছ মাংস ডিম খেতেন? এ কথা সত্য, বিশ্বের সর্বাধিক নিরামিষাশীর বাস ভারতে। নিরামিষ খাওয়া তাঁদের অধিকার। আবার এ-ও সত্য, ভারতে কোটি কোটি মানুষ আমিষ খান। স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসাবে তাঁদের অধিকার স্বীকৃতি পাবে না কেন? ঐতিহ্যের অজুহাত টেনে লাভ নেই, পুরাকালে যেমন অনেকে নিরামিষ খেতেন, তেমন মনুস্মৃতি বা বেদে মাংস খাওয়াকে পাপ বলা হয়নি, ঈশ্বরের উদ্দেশে তা নিবেদনও করা হত। বৌদ্ধরাও শর্তসাপেক্ষে মাংস খেতেন। আর প্রাচীন ভারত যদি পুরো নিরামিষাশী হতও, তা হলেও আধুনিক ভারত তা বয়ে বেড়াবে কেন?

Advertisement

মাংস রফতানিতে বিশ্বে ভারতের স্থান প্রথম দিকে। ৭০টিরও বেশি দেশে মোষের মাংস রফতানি করে ভারত। কোভিড-কালেও এই বাণিজ্য তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেই অর্থনৈতিক হিসাবকে অস্বীকার করে যাঁরা নিরামিষ ভারতের ঝান্ডা ওড়ান, পৌষ্টিক মূল্য সম্পর্কেও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা বৃথা। কারণ, তাঁরা আমিষকে শুধু খাদ্য হিসাবে দেখেন না। তাঁরা এমনি এমনিই দেশকে ধর্ম-ঐতিহ্য-একতার নামে এক রঙের— এক মাপের জামা পরা জোকার— বানাতে চাইছেন না। আছে পরিকল্পনা— ভারত চিরকাল যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কথা বলে আসছে, তারা তাকে নষ্ট করে নয়া সাম্রাজ্যবাদী এক ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি’র নামে দেশকে বাঁধতে চাইছে। নতুন করে ভারতকে পরাধীন করতে চাইছে। খাদ্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ। সকলকে এক খাঁচায় আটক করলে দাবিয়ে রাখা সহজ। আমরাও সেই ফাঁদে পা দিচ্ছি। ‘সামোসা’ খেয়ে বিয়েবাড়ির ‘সঙ্গীত’-এ যোগ দিচ্ছি, ‘কেন কী’ আমাদের আনন্দের উৎসগুলি আমাদেরই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে।

দু’শো বছর পরাধীন থাকার পর বহু আত্মত্যাগে স্বাধীন হয়েছে ভারত। আমরা সংবিধান নিয়ে গর্বিত। তা নাগরিককে সাম্য, স্বাধীনতা, শোষণের বিরুদ্ধে যাপন, ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার দিয়েছে। খাদ্যের অধিকার আসলে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অঙ্গ, সংস্কৃতিরও অঙ্গ। সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হলে খাদ্যতালিকায় কী থাকবে, তা নিজে নির্ধারণ করার স্বাধীনতা থাকা চাই। বিচারালয় বার বার নাগরিকের খাদ্যের অধিকারকে স্বীকার করেছে। তবু কিছু ক্ষমতাধরের চাপে সংখাগরিষ্ঠ ভারতীয় নাগরিকের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্যবস্তু সে জীবনের বাইরে নয়।

প্রত্যেক ভারতীয়ের অধিকার আছে ইচ্ছামতো নিরামিষ বা আমিষ খাওয়ার। খাদ্য জোটানোই যে দেশে প্রাণান্তকর, সেখানে খাদ্যবস্তুর উপর ফতোয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। কী খাব বা খাব না, কোন ভাষায় কথা বলব, কেমন পোশাক পরব— এ সব কিছুই নাগরিক অধিকার। সংবিধানস্বীকৃত সে অধিকার রক্ষা করার দায় সরকারের। আখলাকের ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনও রক্ষককে দেখতে পাইনি। ভবিষ্যতেও না পেলে তা গভীর উদ্বেগের কথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement