আমিষ খাদ্য, বিশেষত মাংস ভোজন নিয়ে ফের বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। খাদ্যাখাদ্য নিয়ে এই ধরনের বিতর্ক নতুন নয়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে আদিবাসী সমাজে, কোন কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ কোন কোন কোমের মানুষ খেতে পারবে না, সে বিষয়ে ট্যাবু বা নির্দিষ্ট প্রথাগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আধুনিক ভারতেও বিশেষত গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের।
খাদ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা ও রাজনীতির ঘূর্ণনজনিত আলোড়নের সাক্ষী মানবসমাজকে পূর্বেও হতে হয়েছে, হয়তো আগামী দিনেও হবে। আসলে কোনও আপাতসরল সমীকরণের মধ্যে দিয়ে খাদ্যকে বোঝা যাবে না, কেননা বিষয়টি বহুমাত্রিক। আর সেই খাদ্য যদি মাংসের মতো লোভনীয় বস্তু হয়, তা হলে তো বটেই। লোভনীয় এই কারণে যে, পৃথিবীর বৃহৎসংখ্যক সমাজে মাংসকে খাদ্যবস্তু হিসেবে প্রভূত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্যালিফর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ সাপোন্তজিস মাংস ভক্ষণ নিয়ে মূলত চার ধরনের বিতর্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন— ১) যে প্রাণীর মাংস খাওয়া হচ্ছে, তার বেদনাসঞ্জাত ক্ষতির সঙ্গে মাংস খাওয়া থেকে আমাদের লাভের তুলনা করলে পাল্লা কোন দিকে ঝুঁকে থাকবে; ২) প্রাণীদের জীবনরক্ষায় যাঁরা উদ্যোগী, তাঁরা কি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করছেন; ৩) নিরামিষাশীরা কি নেহাতই ধর্মান্ধ; এবং ৪) প্রাণীদেরও কি ‘অধিকার’ আছে? ভারতে বর্তমানে যে বিতর্ক চলছে, তা এই চারটি দিককেই কম-বেশি ছুঁয়ে যায়। এই লেখায় আমরা মূলত দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর সন্ধান করব।
এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, মানুষের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পিছনে মাংস খাওয়ার একটি বিপুল বিবর্তনগত ভূমিকা রয়েছে। মানুষের মাংস ভোজনের স্বাভাবিক প্রবণতার ইতিবৃত্তে নজর দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পৃথিবীতে মানুষ তার অস্তিত্বের প্রায় নিরানব্বই শতাংশ সময় অতিবাহিত করেছে হান্টার-গ্যাদারার বা শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে। মাংস আহরণ ও ভক্ষণের প্রয়াস তাকে ‘মানুষ’ হিসেবে ‘দাঁড়াতে’ সাহায্য করেছে। মানুষ শ্রেণিবিন্যাসগত ভাবে যে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, তার নাম ‘হোমিনিড’। এই হোমিনিডরা আবার ‘প্রাইমেট’-বর্গভুক্ত। লেমুর, লোরিস প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণিকুল ছাড়াও বানর, বনমানুষও এই প্রাইমেট বর্গের সদস্য। অধিকাংশ প্রাইমেট উদ্ভিজ্জ খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত হলেও, একমাত্র মানুষই যথার্থ ভাবে সর্বভুক। অন্তত, তার সফল অভিযোজন ঘটেছে সেই ভাবেই। মাংসাশী এবং শাকাহারী প্রাণীদের যদি দু’টি প্রান্ত হিসাবে কল্পনা করা যায়, তা হলে মানব অন্ত্রের গড়ন এই দুইয়ের মাঝামাঝি।
কোনও কোনও প্রাইমেট যে প্রাণিজ খাবার গ্রহণ করে না, তা অবশ্য নয়। শিম্পাঞ্জিরা তো ছোট বানরও শিকার করে তাদের মাংস ভাগ করে খায় গোষ্ঠীবন্ধনকে দৃঢ় করতে, এবং অবশ্যই স্ত্রী শিম্পাঞ্জিকে আকৃষ্ট করতে। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে তার চেয়েও বড় ও শক্তিশালী জন্তুকে শিকার করতে সক্ষম, এবং যারা আহৃত মাংসের বিনিময় তথা ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ সামাজিক সম্পর্কের জাল সৃষ্টি করেছে।
আজ থেকে প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে যখন ওল্ডোয়ান সংস্কৃতিতে হোমো হ্যাবিলিস প্রথম সফল ভাবে পাথরের অস্ত্র নির্মাণ করছে, তখন তার সমসাময়িক আরও অনেক হোমিনিড প্রজাতি এই কৌশল সে ভাবে রপ্ত করতে পারেনি। এর মধ্যে ‘অস্ট্রালোপিথেকাস রোবাস্টাস’-এর মতো শাকাহারী বৃহৎবপু প্রজাতিও ছিল। কিন্তু, বিবর্তনের পথে তারা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর হোমো হ্যাবিলিস থেকে পরবর্তী হোমো ইরেক্টাস হয়ে আধুনিক মানুষ অস্ত্র ব্যবহার ও মাংস ভোজনের অভিযোজনগত সুফল লাভ করে তার অস্ত্রকে যেমন ধারালো করে তুলেছে, তেমনই তার মগজাস্ত্রকেও শাণ দিয়েছে। এর ফলে বিবর্তনের ধারায় অন্যদের পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যেতে পেরেছে।
মানুষ যে সব সময় শিকারের মাধ্যমেই মাংস সংগ্রহ করত, তা নয়। বৃহৎ মাংসাশী প্রাণীদের দ্বারা মেরে রাখা মৃতদেহও তারা হস্তগত করত, যাকে বলে স্ক্যাভেঞ্জিং। এই কাজটি কিন্তু খুব সহজ ছিল না। যথেষ্ট সর্তকতা, পরিশ্রম ও দলগত তালমিলের প্রয়োজন ছিল তাতে। হয়তো প্রাথমিক ভাষা বা অর্থপূর্ণ শব্দ ব্যবহারেরও দরকার পড়ত। এই সমস্ত ক্রিয়াকর্ম তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল। আবার প্রাপ্ত মাংসকে ছাড়িয়ে সহজে চর্বণযোগ্য করে তোলাও নির্মিত হাতিয়ারগুলির একটি কাজ ছিল।
খাড়া ভাবে দাঁড়ানো এবং দ্বিপদ গমনে সক্ষমতা এই মাংসের জোগান সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এর ফলে হাত দু’টি মুক্ত হয়ে যাওয়ায় ‘মানুষ’ যেমন এক দিকে অস্ত্র তৈরি করতে পারল, তেমনই অস্ত্র তৈরির সময় কোনও কিছুকে শক্ত ভাবে ধরার (যাকে বলে ‘পাওয়ার গ্রিপ’) সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম কাজের জন্যও আঙুলগুলি উপযুক্ত হয়ে উঠল (‘প্রিসিসন গ্রিপ’)। এই সমস্ত কিছুর প্রভাব পড়ল মস্তিষ্কের গড়নে। স্মৃতিশক্তি, ধারণক্ষমতা ও মোটর কোঅর্ডিনেশন ছাড়া ক্রমান্বয়ে উন্নততর অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এই ভাবেই হোমো হ্যাবিলিসের প্রায় ৭৫০ ঘন সেন্টিমিটার থেকে করোটির আয়তন হোমো ইরেক্টাসের ক্ষেত্রে প্রায় ১২৫০ ঘন সেন্টিমিটারে পৌঁছে যায়। মনে করা হয় যে, ১৫ লক্ষ বছর আগে এই ইরেক্টাসরাই যথাযথ ভাবে শিকারি হয়ে উঠেছিল।
হোমো ইরেক্টাসের সময় আবার আগুনের ব্যবহার শেখে মানুষ। আগুনের ব্যবহার মাংসের প্রক্রিয়াকরণকে আরও ত্বরান্বিত করে। এর প্রভাব পড়ল মুখ-সহ সমগ্র দেহে। ভারী চোয়াল হালকা হয়ে আসে। বড় ক্যানাইন অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, ভারী ভ্রুরেখা-অস্থি ক্ষীণ হয়, মুখের অভিক্ষেপ অন্তর্হিত হয়ে কপাল-সহ সুষম মুখমণ্ডল তৈরি হয়, আবির্ভূত হয় চিবুক বা থুতনি। এ ভাবেই অঙ্গসংস্থানগত ভাবে আধুনিক মানুষের অবয়ব গড়ে ওঠে, যারা যৌথ জীবনের সুসংগঠিত শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রয়াসের সক্ষমতা দ্বারা পঞ্চাশ হাজার বছর আগে এক প্রকাণ্ড ম্যামথ শিকার করেছিল— সুনিশ্চিত হয়েছিল বেশ কয়েক দিনের মাংসের জোগান। ফ্রান্সে উদ্ধার হওয়া ম্যামথটির কঙ্কাল সেই অভিযানের সাক্ষ্য বহন করছে।
যাঁরা মাংস খাওয়ার বিরোধিতা করছেন, তা নিয়ে হিংস্রতায় মাতছেন, এক অর্থে তাঁরা বিবর্তনের ইতিহাসকেই কি অস্বীকার করছেন না?
নৃতত্ত্ব বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়