আপন প্রাঙ্গণতলে খণ্ড-ক্ষুদ্র
Visva Bharati

শিরায় শিরায় রাজনীতি, শতবর্ষে বিশ্বভারতী মুক্ত মনের কফিন

শান্তিনিকেতনের চলতি অশান্তি অর্থাৎ ছাত্র-বিক্ষোভের কারণ দেখিয়ে বিশ্বভারতী অনির্দিষ্টকাল বন্ধ করে দেওয়ার একটি চেষ্টাও তো এ বার হয়েছিল।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:০৮
Share:

‘শান্তি-নিকেতন’! বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষীদের সঙ্গে বিক্ষোভরত ছাত্রদের সংঘর্ষ, বিশ্বভারতী, ৩০ অগস্ট। ছবি পিটিআই।

শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে কি ‘তালা’ পড়ে গেল! বিক্ষোভের সময় হাতে করে তালা কে বা কারা দিয়েছিলেন, সেটা আদালতের বিচার্য। পুলিশ দিয়ে সে তালা ভাঙাও গিয়েছে। তবে এ তো বাইরের তালা। যা চোখে দেখা যায়। যে তালা দিয়ে মুক্ত মনের দুয়ার আঁটা, সেটা ভাঙা গেল কি?

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া এই ‘বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ’ মহোজ্জ্বল করার কাজে ব্রতী যাঁরা, প্রকৃতই ‘রুদ্ধ’ দুয়ার খুলতে তাঁরা কে কতটা আগ্রহী, সেই আলোচনা তাই আজ প্রাসঙ্গিক। কিছু দিন আগে রীতিমতো মিটিং ডেকে উপাচার্যকে বলতে শোনা গিয়েছিল, তিনি যাওয়ার আগে বিশ্বভারতীকে বন্ধ করার ব্যবস্থা করে যাবেন! কেউ বলতেই পারেন, সেটা কথার কথা।

কিন্তু শান্তিনিকেতনের চলতি অশান্তি অর্থাৎ ছাত্র-বিক্ষোভের কারণ দেখিয়ে বিশ্বভারতী অনির্দিষ্টকাল বন্ধ করে দেওয়ার একটি চেষ্টাও তো এ বার হয়েছিল। তাতে ফলপ্রকাশ, ভর্তি প্রক্রিয়া, বেতন সবই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারত। তবে কর্মসমিতির সেই সিদ্ধান্ত দিল্লিতে শিক্ষা মন্ত্রক খারিজ করে দেওয়ায় আপাতত শতবর্ষে বিশ্বভারতীর গেটে ‘সরকারি তালা’ ঝুলল না!

Advertisement

শতবর্ষের ‘প্রাপ্তি’ আছে আরও। তার একটি যতখানি চমকপ্রদ, তার চেয়ে ঢের বেশি লজ্জার ও বেদনার। বিষয়টি হল, বিশ্বভারতী আর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউশন অব ন্যাশনাল ইম্পর্ট্যান্স) নয়! গত মার্চে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে দেশের একশো তিরিশটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে নাম নেই বিশ্বভারতীর।

বিশ্বভারতীকে ১৯৫১ সালে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। অতএব ধরে নেওয়া যেতেই পারে, শতবর্ষে বিশ্বভারতীর জন্য ‘উপহার’ হল এই অবনমন। বঙ্কিমকে নকল করে বলা যায়, হায় বিশ্বভারতী, তোমার মান গিয়াছে!

সমাজ ও সংস্কৃতিতে সামগ্রিক অবনমনের হাওয়া যে বিশ্বভারতীর গায়েও লাগবে, কালের নিয়মে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করেও প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি অব্যাহত রাখা, আশার আলোটিকে উজ্জ্বল করে রাখা শিক্ষক-ছাত্র-কর্মী সকলের দায়িত্ব। আর প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যের ভূমিকা সেখানে সর্বাধিক হবে, এটাই প্রত্যাশিত।

কিন্তু ঘটনা হল, বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ক্রমশ যেন জাঁকিয়ে বসেছে। এমন নয় যে, অস্থিরতা এর আগে কখনও হয়নি। হয়েছে, অচিরে মিটেও গিয়েছে। আজকের মতো দীর্ঘস্থায়ী ভয় ও বিশ্বাসহীনতার পরিস্থিতি কায়েম থাকেনি। এটাও এখনকার প্রাপ্তি!

দোষ-গুণ, দায়-অদায়ের বিতর্ক থাকতেই পারে। মতভেদও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সে সব সরিয়ে রাখলেও এটা ঘটনা যে, বিশ্বভারতীর অন্দরমহল আজ পারস্পরিক অবিশ্বাস, অসম্মান, দম্ভ, আস্ফালন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। অনিবার্য পরিণতি অনুযায়ী ক্ষোভের বিস্তারও তাই ঠেকানো যাচ্ছে না।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।’ অথচ, তাঁর আদর্শের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে গিয়ে নানা ভাবে যা চলছে, তা যেন বিশ্বভারতী ও তার পরিমণ্ডলকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ও রুদ্ধ করে রাখারই ‘সাধনা’। বিশেষত, এই উপাচার্যকে নিয়ে, তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপ, মন্তব্য, পদক্ষেপ ঘিরে যে সব কথা প্রকাশ্যে আসছে, তার সবই তো ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। বরং এর কিয়দংশ সত্যি হলেও কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কুলপতির পক্ষে তা অবাঞ্ছিত ও চরম আপত্তিকর।

আচার্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এই অবস্থার কিছুই জানেন না, এমনটা মনে হয় না। না-জেনে থাকলে সেটাও তাঁর দায়িত্বের পক্ষে সমীচীন নয়। প্রশ্ন থেকে যায়, আচার্য কি এর দায় সম্পূর্ণ এড়াতে পারেন?

আমরা জানি, বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে আচার্য-প্রধানমন্ত্রী ভয়শূন্য চিত্ত এবং মুক্ত জ্ঞানের কথা বলে গিয়েছেন। বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেই তিনি আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখতে চান। এ সব বলতে, শুনতে, ভাবতে ভালই লাগে। চিত্ত উদার ও প্রসন্ন হয়। তবে সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর বিরুদ্ধে যদি ক্রমাগত ভীতিসঞ্চারের এবং কু-কথা বলার অভিযোগ উঠতে থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণের কোনও উদ্যোগ যদি টের পাওয়া না-যায়, তা হলে তাঁর প্রতি কোথাও কোনও স্তরে প্রশ্রয় রয়েছে বলে ধরে নেওয়া কি খুব ভুল হবে?

জেনে স্তম্ভিত হতে হয়, এক জন উপাচার্য তাঁর ডাকা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে (জ়ুম মিটিং) একটি বিভাগের ফ্যাকাল্টিদের উদ্দেশে নাকি বলেছেন, তাঁদের আচরণ ‘কুকুরের মতো’! এখানেই শেষ নয়। কখনও তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে চাকরি থেকে তাড়িয়ে ‘পথের ভিক্ষুক’ করে দেওয়ার হুমকি। কখনও আবার আস্ফালন, তাঁর কত ‘ক্ষমতা’ তিনি তা দেখিয়ে দেবেন! উপাচার্যের উদ্ধৃতি বলে আর একটি বাক্য তো রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। যেখানে আছে ‘চরম পরিণতির’ হুঙ্কার— ‘হিন্দিতে বলে, কুচল দো। ম্যায় কুচল দুঙ্গা।’ যত দূর খবর, এ সবই অভিযোগের আকারে লিখিত ভাবে আচার্য-প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা হয়েছে। তার পর কী হল, সেই উত্তর অবশ্য এখনও অজানা।

অনেকের ধারণা, এর পিছনে রাজনীতির একটি বড় ‘অবদান’ আছে। সেই রাজনীতি অবশ্যই দেশের শাসককুলকে ‘তুলে ধরা’। যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বপ্নের এই শিক্ষাঙ্গনকে পুরোপুরি রাজনীতি-মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। একাধিক চিঠিপত্র ও লেখায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ কথা বলেছেন। কিন্তু নির্মম সত্য হল, বিশ্বভারতীর শিরায় শিরায় রাজনীতি এখন বাসা বেঁধে ফেলেছে।

যেখানে বার বার প্রশ্নের মুখে চলে আসে স্বয়ং উপাচার্যের ভূমিকা। তাঁর রাজনৈতিক ‘পরিচিতি’ সংক্রান্ত বিতর্ক এত দূর গড়ায় যে, বিধানসভা ভোটের আগে সেখানকার বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে তোলা তাঁর একটি পুরনো ছবি রীতিমতো বিপক্ষের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

যদিও বিশ্বভারতীর হাল কোথায় পৌঁছেছে, ভোটে লড়তে এসে বিজেপির ওই তাত্ত্বিক নেতা নিজেই তা সম্যক বুঝেছিলেন। তাই প্রকাশ্যে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি উপাচার্যের সমালোচনায় সরব হন। বস্তুত, এখানকার শিক্ষক, ছাত্র, কর্মী, আশ্রমিক থেকে শুরু করে স্থানীয়দের একটি অংশ নানা কারণে এই উপাচার্যের বিরোধিতা করছেন। যদিও এর কোনটি কতখানি যুক্তিসঙ্গত সেই বিতর্কও থাকতে পারে।

কিন্তু মানসিকতা কি তাতে চাপা পড়ে? নইলে বিজেপি কেন ভোটে হেরে গেল, সেটা ‘বিশ্বভারতী বক্তৃতামালা’র বিষয় হতে যাবে কেন? নিশ্চয় উপাচার্যের সম্মতি ছাড়া ওই সিদ্ধান্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিতর্কের মুখে উদ্যোগটি ‘সফল’ করা যায়নি ঠিকই, তবে আজকের বিশ্বভারতীতে এমন অনেক কিছুই হয়, সুবুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলা ভার।

যেমন, রবীন্দ্রনাথের কথায় যিনি ‘দেশকে আত্মনিন্দার হাত থেকে উদ্ধার করেছেন’, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন আচার্য সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষ কি ‘বিস্মৃত’ হওয়া যায়! তিনি তো ‘ভারতমাতা’রও স্রষ্টা।

রাজনীতির নিয়মে একপক্ষ পরিসর দিলে অন্যপক্ষ তার পাল্টা ‘সুযোগ’ নিতে চাইবেই। ফলে অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর বাহিনীর হুমকি এবং কু-কথাও এখন উপাচার্যের দিকে ধেয়ে আসে। উত্তাপ তাতে আরও তীব্র হচ্ছে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী যেন একেবারে ‘তু তু, ম্যায় ম্যায়’-এর আদর্শ পীঠ! যার এক দিকে আছে দম্ভ, ঔদ্ধত্য, অবিশ্বাস, অন্য দিকে মেঠো রাজনীতির দখলদারি।

তবু আশা হারানো উচিত নয়। শতবর্ষের বিশ্বভারতী সমস্ত রকম খণ্ডতা, ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হোক, এটা সকলের কাম্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভয় থেকে অভয়ের পথে নতুন করে যাত্রা শুরু হবে কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement