ফাঁপরে বঙ্গ-বিজেপি, মমতার হাতে দু’টি তাস
India-Bangladesh

কোন পথে যে চলি

বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বাস্তবতায় এর প্রভাব বিস্তৃত হতে বাধ্য। নিকটতম পড়শি হিসাবে আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি চরম উদ্বেগের।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫২
Share:

দায়িত্বে: বাংলাদেশের শীর্ষে নোবেল শান্তি পুরস্কার- প্রাপ্ত মুহাম্মদ ইউনূস,ঢাকা, ৮ অগস্ট। ছবি: রয়টার্স।

গত কিছু দিন ধরে প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘটনাবলি আমরা দেখছি। আজকের দুনিয়ায় একটি দেশের ভিতরকার এই রকম পরিস্থিতি কেবল তার নিজের সীমানাতেই আটকে থাকতে পারে না। বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বাস্তবতায় এর প্রভাব বিস্তৃত হতে বাধ্য। নিকটতম পড়শি হিসাবে আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি চরম উদ্বেগের।

Advertisement

মাস চারেক আগে সে-দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্বৈরাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তীব্র জনরোষ অচিরে লাগামহীন নৈরাজ্যের চেহারা নিয়েছিল। যার অভিঘাত এসে পড়ছিল আমাদের রাজ্যের সীমান্তে। নিজের দেশ থেকে তড়িঘড়ি পালিয়ে বাংলাদেশের পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এখন ভারতের আশ্রয়ে। আর মুহাম্মদ ইউনূসের কর্তৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে সেখানে ছড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন। ওখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা যার শিকার।

এই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাকেই ‘কাজে’ লাগাতে উঠে পড়ে নেমেছে বাংলার বিজেপি। আর জি কর আন্দোলনের পরিসরে তারা হালে পানি পায়নি। সম্প্রতি আরও ছ’টি উপনির্বাচনেও তাদের পর্যুদস্ত হওয়ার ধারা অব্যাহত। সব মিলিয়ে তাই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে রাজনীতির ময়দানে তাদের উপস্থিতি এখন যথেষ্ট ম্রিয়মাণ। এর পিছনে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কী ভূমিকা, অথবা রাজ্য দলের ভিতরকার টানাপড়েন কতটা দায়ী সে সব আলাদা বিষয়।

Advertisement

তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণের ঘটনাবলি কেন্দ্র করে এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর জিগির তোলাকে এখন বঙ্গ-বিজেপির খড়কুটো আঁকড়ে ভেসে থাকার প্রয়াস বলা যায়। যেখানে তাদের অনেক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির সঙ্গেও মেলে না। বরং দলের বিভ্রান্তি ও দিশাহীন অবয়ব প্রকট হয়।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পতন ও পলায়নের সময় ওখনকার সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল নিয়ন্ত্রকের। কার্যত তাদেরই বন্দোবস্তে নোবেল-জয়ী ইউনূসকে বিদেশ থেকে ডেকে এনে ক্ষমতা হাতে তুলে দেওয়ার পরেও দেখা গিয়েছিল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। উল্টে ওই সরকারের ‘প্রশ্রয়ী’ মনোভাব ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম শুভেচ্ছাবার্তাতেই ইউনূসকে বলেছিলেন, ওখানে হিন্দু-সহ সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (অর্থাৎ, অ-মুসলিম) নিরাপত্তা দ্রুত নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাঁর সেই উদ্বেগ একেবারেই অহেতুক ছিল না। আজ সেটা আরও পরিষ্কার।

সেই সময় বাংলাদেশ থেকে বহু লোক তাড়া খেয়ে বা শঙ্কিত হয়ে প্রাণভয়ে এই রাজ্যের সীমান্তগুলিতে জড়ো হয়েছিলেন। শিশু, মহিলা, বয়স্ক সবাই খোলা আকাশের তলায়। এঁদেরও অধিকাংশই ছিলেন ওখনকার সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু। তবে রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে শেখ হাসিনা-র দল আওয়ামী লীগের মুসলিম নেতা-সমর্থকেরাও অনেকে সীমান্ত পেরোতে চাইছিলেন। সরকারি ভাবে বলা না-হলেও সব মিলিয়ে সীমান্তে ভিড় করা মানুষের আনুমানিক সংখ্যা ছিল হাজার কয়েক। বোঝা যাচ্ছিল, কূটনৈতিক বিবেচনায় ভারত শরণার্থীদের ঢুকতে দেবে না। তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা তুলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সচেতন ভাবেই ‘মাছের চোখ’টি নির্দিষ্ট করে দিতে ভুল করেননি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আরও এক পা এগিয়ে বলেছিলেন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে ওপারের মানুষ দরজায় এসে দাঁড়ালে তাঁদের দিকটিও ভাবা উচিত। জেনেছিলাম, দিল্লি ‘অনুমতি’ দিলে এই বাংলার সীমান্তে জড়ো হওয়া লোকজনদের জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে রাজ্য আপৎকালীন ছাউনি ও কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করতে প্রস্তুত ছিল। সে কথা দিল্লির ‘যথাযোগ্য’ স্তরে পৌঁছেও দেওয়া হয়।

অবশ্য দিল্লির অনুমতি যে আসার নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা ভালই জানতেন। তা সত্ত্বেও রাজ্যের এই মনোভাব সামনে নিয়ে আসার পিছনে ছিল তাঁর নিজের একটি রাজনৈতিক কৌশল। এপার বাংলার শাসক তৃণমূলের বড় উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ‘মানবিক মুখ’ তুলে ধরা, যা বৃহত্তর হিন্দু-আবেগকে ‘প্রশ্রয়’ জোগানোর ক্ষেত্রে সহায়ক। এই রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম ভোট ভাগের নিরিখে বিষয়টির গুরুত্ব আজ বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

মমতার এটাও নিশ্চয় মাথায় ছিল যে, তাঁরা না চাইলেও মোদী-অমিত শাহেরা গত লোকসভা ভোটের ঠিক আগে দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধি (সিএএ) চালু করে দিয়েছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে সেখানকার ‘উৎপীড়িত’ সংখ্যালঘুরা (অর্থাৎ, বাংলাদেশের হিন্দু) কখনও এ-দেশে চলে এলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সংস্থান থাকবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী বিজেপি তার ‘সুফল’ তুলতে ঝাঁপাতে পারে। তাই ওটা ছিল তৃণমূল নেত্রীর আগাম চাল।

এ বারের অবস্থা কিছু আলাদা এবং অনেক বেশি জটিল। সেটা এই কারণে যে, এখন আক্রমণ, নির্যাতন সবেরই নির্দিষ্ট নিশানা বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। ও-দেশের শাসক মানতে না-চাইলেও ঘটনাগুলি এড়ানো অসম্ভব। আর এখানে ‘হিন্দু-রাজনীতি’ তার থেকে অক্সিজেন পাচ্ছে।

এই রাজ্যে মমতাকে ‘মুসলিম তোষণকারী’ বলা নতুন নয়। আবার মোদী-জমানায় দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর অত্যাচার, অবিচারের অভিযোগ ভূরি ভূরি, যার অনেকই সত্যি। ইদানীং আরও বড় সত্যি হল, এই বাংলায় বিজেপির তথাকথিত ‘হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক’-এ ঘাটতি। কয়েকটি ভোটের ফল থেকেই সেটা দেখা যাচ্ছে। অতএব তাদের কাছে ‘সস্তায় পুষ্টিকর’ রাজনীতি হল, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার। কিন্তু সেটা কি কোথাও রাজ্য বিজেপির ‘আত্মঘাতী’ পদক্ষেপ হয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে মমতা কেন ‘প্রতিবাদ’ করছেন না, এটা ছিল বঙ্গ-বিজেপির মূল বক্তব্য, যা প্রকৃতপক্ষে একটি হাস্যকর অবস্থান। কারণ মমতা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁরা কেন্দ্রের নীতি ও সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করবেন। ভেবে দেখলে এই অবস্থান নেওয়ার পিছনে একাধিক কারণ আছে, বিদেশনীতির প্রশ্ন তো বটেই। সেই সঙ্গেই তাঁর কৌশল হল, এর রাজনৈতিক দায় প্রধানত বিজেপির উপরে রাখা।

বিধানসভায় দাঁড়িয়ে তাই কেন্দ্রের কাছেই মমতার ‘নিবেদন’, বাংলাদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধারে শান্তিবাহিনী পাঠাতে রাষ্ট্রপুঞ্জে আর্জি জানানো হোক। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের ‘অস্তিত্ব বাঁচাতে’ রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও চেয়েছেন। তবে তিনি তা চেয়েছেন সরাসরি। মোদীর মাধ্যমে নয়!

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও পণ্য-পরিবহণ আটকাতে রাজ্য বিজেপির তৎপরতাও এখানে লক্ষ করার। কারণ কেন্দ্র এখনও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। মোদী চান না ভারত নিজে থেকে এই ব্যাপারে কোনও নেতিবাচক ভূমিকা নিক। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক মহলের নজরে ভারত এখনই এমন কোনও বিতর্কিত অবস্থান নিতে চাইছে না, যাতে মনে হতে পারে বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহণ বন্ধ করে তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ‘বিপাকে’ ফেলছে। সিদ্ধান্তটি কূটনৈতিক। প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই কলকাতায় বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

এই অবস্থায় রাজ্য বিজেপির কর্মকাণ্ডকে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাওয়ার অপরিণত চেষ্টা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। বাংলার বাজারে ‘ভেসে’ থাকতে আপাতত তাদের হাতে বাংলাদেশ! এবং সেখানেও এক-একটি পদক্ষেপে ফাঁপরে পড়তে হচ্ছে বঙ্গ-বিজেপিকে। মনে হয়, কোন দিকে যাবেন, নিজেরাই তা ঠিক করতে পারছেন না।

অনাগত ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে দিকেই গড়াক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক কারণে এই বাংলার উপর তার প্রভাব বেশি হবেই। ওপারের মানুষের (প্রধানত হিন্দু) গতিবিধিতে এই রাজ্যের সীমান্তগুলি ফের চঞ্চল হয়ে উঠছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সময়ে ‘ফসল’ তোলা সবার লক্ষ্য। মোদী, মমতা কেউ ব্যতিক্রম নন। যে যার মতো চাল ভেবে চলেছেন।

তবে কেন্দ্রের নীতি মেনে চলার কথা বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপাতত দু’টি তাস ধরে রাখলেন। দিল্লি ‘বিরূপ’ হল না, আবার রাজ্যে বিজেপিও ‘বিতর্কিত’ হল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement