যুদ্ধের শেষে কী পড়ে থাকে? প্লেটো বলেছিলেন— যুদ্ধের শেষে পড়ে থাকে মানুষের অশ্রু, মানুষের রক্ত। ত্রিশ বছর যুদ্ধের পর ইউরোপ শান্তি স্থাপনে বসে। ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি দ্বারা জাতিরাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন হয়। যদিও পর্তুগাল ছাড়া আর কেউই বর্তমানে সেই সীমানা অক্ষত রাখতে পারেনি।
পশ্চিম ইউরোপের শিল্প বিপ্লব এবং তার প্রয়োজনে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে হিংসা এবং বলপ্রয়োগের ইতিহাস। জাতি গঠনের উপাদান হিসেবে রক্তের বন্ধন, ভাষা, ধর্ম, একজাতীয় সংস্কৃতি এই সবের পাশাপাশি সম্মিলিত যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসও একটি অনস্বীকার্য উপাদান। উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বাধীনতার সংগ্রাম এ ভাবেই পরাধীনতার কালে তার ভবিষ্যতের নাগরিকদের এক করেছে। ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির পরিচয় ছাপিয়ে অন্য একটি ‘জাতীয় পরিচিতি’ সামনে এনেছে।
রেনাঁ বলেছিলেন সম্মিলিত যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস কেবল নয়, সম্মিলিত হতাশার ইতিহাসও একটি জাতিকে বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। পরাধীন ভারতের ইতিহাস সেই কথার সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। ভাষাকে সামনে রেখে, এক ভিন্নতর অস্তিত্বের লড়াই লড়েছে বাংলাদেশ। ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতির সমবেত চৈতন্য, সম্মিলিত ইতিহাস।
সমস্যা হল, একটি জাতি সর্বদাই নিজেকে অন্য জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। একটি জাতিরাষ্ট্র সর্বদাই শঙ্কিত থাকে তার সীমান্ত নিয়ে। এর পিছনে কাজ করে গোপন সংশয়। গোপনে গোপনে প্রতিবেশীর শক্তিশালী হয়ে ওঠার সংশয়। সীমান্তে সামান্য নড়াচড়াও আগ্রাসন বলে মনে হয়। মনে হয় কাঁটাতার থেকে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে ভূখণ্ড। আর তেমন কিছু হলেই সৈন্যদের তৎপর হতে নির্দেশ দেয় রাজধানী। এই গোপন পারস্পরিক সংশয়ের রূপ কী রকম, ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের এ কথা আর বুঝিয়ে বলতে হয় না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতা থেকেই প্রয়োজন হয় সামরিক জোটের। উদ্ভব হয় কোনও বড় দাদার, যে আবার নিয়ন্ত্রণের ধারণাটি খুব ভাল বোঝে।
আধুনিক রাষ্ট্রের এই সীমান্ত ব্যাপারটাই যে হেতু জন্মই নিয়েছে যুদ্ধের পরের শান্তি চুক্তি থেকে, তাই সীমান্ত থাকলে সীমান্ত সমস্যাও থাকবে। থাকবে সংশয়। দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সীমান্তের কাঁটাতার কখনওই দরাদরি ও প্রতিরোধ ছাড়া এগোতে পারেনি। তাই সংশয় ও ষড়যন্ত্র যেন সর্বদাই তাকে তাড়া করে বেড়ায়। একমাত্র আফ্রিকাকে নরম কেকের মতো খুব সহজে কাঙ্ক্ষিত আকৃতির টুকরোয় কেটে ফেলা সম্ভব হয়েছিল!
জাতিরাষ্ট্রের মত্ততায় দুটো মহাযুদ্ধ দেখেছে পৃথিবী। কেবল একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার অগ্নিশপথের বলি হয়ে বন্ধ কক্ষে বিষবাষ্পে প্রাণ দিয়েছে লক্ষ লক্ষ অন্য জাতির মানুষ। মুশকিল হল এই যে— জাতিরাষ্ট্রের এই উল্লাস যখন শুরু হয়, তখন তার উত্তরোত্তর জয়ের আশা পূরণ হওয়া পর্যন্ত অথবা পরাজয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার আগে পর্যন্ত সে কারও কথা কানে নেয় না। উন্মাদনা কত দূর যেতে পারে? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে ১৯১৪ সালের একটি আইন দ্বারা ১৯১৬ সালে ট্রিনিটি কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয় ওই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক স্যর বার্ট্রান্ড রাসেলকে।
কোন যুদ্ধ ন্যায় আর কোন যুদ্ধ অন্যায়, এ এক ধাঁধার মতো। কাঁটাতারের এ পার-ও পারে, স্থান কাল পাত্রভেদে বদলে যায় যুদ্ধের ন্যায়-অন্যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের উল্লাস থেমে যাওয়ার পরে, ১৯১৯ সালে ট্রিনিটি কলেজে ফেরত নেওয়া হয় রাসেলকে। যুদ্ধকে সমর্থন করার চেয়ে যে রাসেল কারাবাস শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন, তিনিই হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে যুক্তি সাজিয়ে সমর্থন করলেন।
গিলগামেশ থেকে রামায়ণ, মহাভারত— মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে বসে আছে যুদ্ধ। তার সঙ্গে রয়েছে অভিযান, ষড়যন্ত্র, মৃত্যুভয়, হত্যা! যুদ্ধের বিপরীতে কী থাকে? শান্তি? প্রেম? আমাদের প্রেমের ঈশ্বর কৃষ্ণ কার্যত মহাভারতের ‘ন্যায়যুদ্ধ’ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল শক্তি।
একটি জয়ের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী একটি পরাজয় জড়িয়ে থাকে। অস্ত্র জিতে গেলে, মনুষ্যত্ব হেরে যায়। পরমাণু বিস্ফোরণের দ্বারা যুদ্ধে নৃশংস
এক জয় সুনিশ্চিত হয় বটে, তবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হেরে যায় সভ্যতা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে চুরমার হয়ে যাওয়া বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত নাগরিকের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা হারায় বিজ্ঞান, যুক্তি!
যাঁরা দাবা খেলার সঙ্গে পরিচিত তাঁরা জানেন, রাজাকে কিস্তি দেওয়ার অর্থ পরের চালে কোনও বোড়ের প্রাণসংশয় নিয়ে ভাবলে চলে না। প্রতিপক্ষকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কিস্তি বাঁচানোর দিকেই মনোনিবেশ করতে হয়। তখন কার সৈন্যসংখ্যা কত, কোন সৈন্য কত বড় বিপদের সম্মুখীন, হাতি, ঘোড়া, নৌবহর— সব কিছুই গৌণ। সব কিছুই রাজার উদ্দেশে নিবেদিতপ্রাণ।
যুদ্ধ এই কিস্তি দেওয়ার কাজটাই করে। অন্য সমস্ত কিছু থেকে নজর তখন চলে যায় ওই দিকে। ‘যুদ্ধের বাজার’ কথাটাকে তখন বিশ্বব্যাপী ঘটা সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। আসলে আধুনিক রাষ্ট্রের কিছু নির্দিষ্ট কলঙ্কদাগ আছে। অনুন্নয়ন, ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, এই সব। এই সব প্রতিপক্ষকে সহজেই কিস্তি দিতে পারে এই যুদ্ধ। এই সব কিছুর দায় তখন খুব সহজেই চাপিয়ে দেওয়া যায় যুদ্ধের উপর।
মাঝে মাঝে ভয় হয়— সীমান্তে সন্দেহজনক গতিবিধি আর প্রতিবেশীর শক্তি বেড়ে যাওয়ার সংশয় বুকে নিয়ে সারা পৃথিবী এক দিন টুকরো টুকরো আথেন্স আর স্পার্টা হয়ে যাবে না তো?