ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত উৎসব ছবিটা থেকে আমরা উপলব্ধি করি যে, পুজো সবার জন্য হলেও সে-উৎসবে সকলে যোগ দিতে পারে না। এক বৃহৎ পরিবারের সন্তানরা দুর্গাপুজোর সময়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে হাজির হয়। সেই উৎসবের আমেজেও এক বছর আবহাওয়া একটু ভিন্ন। এক আত্মীয়কে বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে, সকলেই রাজি বাড়ির ছোট জামাই অরুণ ছাড়া। বাড়ির বাকি সকলে অরুণের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সন্দিহান। অরুণের স্ত্রী-ও স্বামীকে পীড়াপীড়ি করে, পুজোর ক’দিন অরুণ যেন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার অভিনয় করে যায়। অরুণ কিন্তু পুজো ছেড়ে কলকাতা ফিরে যায়।
উৎসবের যে সংজ্ঞা আমরা তৈরি করেছি তাতে মনে হয়, সে জিনিসটি একটা সমষ্টিগত উদ্যাপন। সবাই এক জায়গায় আসবে, সকলে নিজের নিজের পরিবারের কাছে ফিরবে— এটাই যেন উৎসব। কিন্তু প্রত্যহ একাকী যে মানুষ, উৎসব এলেই সে সকলের সঙ্গে মিশতে পারবে কী করে? বয়স, লিঙ্গ-যৌনপরিচয়, শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা, এমন নানা বিষয় তাকে এই সর্বময় উৎসবের আহ্বানে অংশগ্রহণ করতে বাধা দিতে পারে।
এই যেমন, কল সেন্টারে কাজ করে একটি ছেলে। বাড়িতে মা আর বাবা। বিবাহিত দু’টি দিদি, তাদের পরিবার, বাবা-মায়ের জন্য পুজোর জামাকাপড় পাঠিয়েছে সে। পাড়ায় চাঁদা দিয়েছে। মা-বাবার চারটে দিন মণ্ডপে কাটে। দিদিরা পুজোয় ঠাকুর দেখতে বেরোয়। কিন্তু ওই ছেলেটি কোথাও বেরোয় না। সন্ধ্যাবেলা সঙ্গী খোঁজার অ্যাপ ঘাঁটে। যদি কোনও সঙ্গীর সন্ধান পাওয়া যায়, যার কাছে নিজের পরিচয় লুকোতে হবে না!
আর এক জন কলকাতার বাইরে চাকরি করে। পুজোতে শহরে আসতে তার অনীহা। বাড়ির সবাই চাপ দেবে শাড়ি পরতে, ‘মেয়েদের মতো’ সাজতে। মেয়ে হয়ে জন্মালেও তার প্রিয় পোশাক প্যান্ট-শার্ট, পাঞ্জাবি-পাজামা, কিন্তু সে সব পুজোয় পরা চলবে না। তাই সে সরে থাকে। এমন আর এক জন আবার ভুরু প্লাক করেছিল বলে বাবা খুব মেরেছে! সে তো ছেলে, মেয়েদের মতো সাজবে কেন?
এমন অনেক সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের উৎসবে ফিরে আসার মতো পরিবার নেই। এখনও যে-রকম হেনস্থা-হিংসার মধ্যে দিয়ে তাঁদের যেতে হয়, তাতে তাঁরা বাড়ি ফিরতে দ্বিধা বোধ করেন। অনেকের কাছে উৎসব যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, তেমন এই উৎসবই অগণিত মানুষের জীবনে ট্রমার স্মৃতি বয়ে আনতে পারে, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। উৎসবের দিনে সেই মানুষরা অনুভব করেন, তিনি কত কতখানি একা। বার্ধক্যের কারণে যাঁরা মানসিক ভাবে একাকী, পরিবার-পরিজন থাকতেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, এমন মানুষরাও কি সেই বোধের শরিক নন? শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা যাঁদের আছে, বা যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণায় (ক্রনিক পেন) কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁদের মনেও এমন গ্লানি নেমে আসতে পারে। তাঁরা নিজেরাই সরে থাকতে চান উৎসব থেকে। মনে করেন, ওই আনন্দোৎসব তাঁর জন্য নয়, ওর মধ্যে তাঁর কোনও স্থান নেই।
আবার যাঁদের আগ্রহ রয়েছে যোগ দেওয়ার, তাঁরাও অনেকে হয়রান, অপমানিত হওয়ার আশঙ্কায় বেরোন না। ঠাকুর-দেখার ইচ্ছে হয়তো আছে, কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের মোকাবিলা করার ভয়ে পিছিয়ে আসেন। কলকাতার হাজার হাজার প্যান্ডেলের মধ্যে ক’টিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য রেলিং বা র্যাম্পের সুব্যবস্থা আছে? কত জায়গায় বৃদ্ধ, অশক্ত বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য ভিড় থেকে আলাদা করে একটু বসার ব্যবস্থা আছে? যদি বা তাঁরা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেন, তা হলেও অনেক দূরে গাড়ি থেকে নেমে এতখানি পথ হেঁটে আসতে পারবেন? অনেক উদ্যোক্তা ভিআইপি পাস দেন, যাতে দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়াতে হয়। মফস্সলের পুজোগুলোতে টাকার বিনিময়েও এমন পাশ পাওয়া যায়। এই সুবিধাগুলি কি বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সর্বদা দেওয়া উচিত নয়? বিশেষত এখন, যখন জনগণের টাকা সরকারি অনুদানের মাধ্যমে ব্যয় হচ্ছে উৎসবের জন্য?
যে সাজপোশাক উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ, তার জন্যেই এ দেশে রূপান্তরকামী মানুষেরা আজও রাস্তাঘাটে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। উৎসবের আবহে যখন শহরে ভিড় বাড়ে এবং ভিড়ের চরিত্রটা বদলে যায়, তখন এই হেনস্থার মাত্রা আরও অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। মেয়েদের যৌন হয়রানি নিয়ে সচেতনতা কিছুটা হলেও বেড়েছে, কিন্তু সমকামী-রূপান্তরকামীদের হেনস্থাকে এখনও ‘নির্দোষ আমোদ’ মনে করার অভ্যাস ছাড়তে পারছে না অনেকে। এটা আমোদ তো নয়ই, এমনকি শুধু খুচরো অপরাধও নয়। যাঁরা উৎসবের আনন্দে যোগ দিয়ে সমাজে নিজেদের স্থান দাবি করতে চান, তাঁদের প্রতিহত করার, দূরে ঠেলে রাখার একটা নকশা।
এর পরেও রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা কোনও আদর্শগত কারণে উৎসব বর্জন করেন। সেটা হতে পারে জনকল্যাণ থেকে সরে থেকে উৎসবের বিপুল অপব্যয়ের বিরোধিতা, হতে পারে ধর্মীয় উৎসবের প্রাবল্যের মাধ্যমে দেশের সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করার চেষ্টা। এ বছর আমরা দেখলাম, যৌনহিংসা এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অনেকে উৎসব বর্জন করলেন। প্রতিটি উৎসবে তাই রাস্তার ভিড়ের পিছনে থাকে এক অদৃশ্য জনতা, যাঁরা অপারগ, ব্রাত্য, বিমুখ। তাঁদের কথা ভুললে চলে না।