Army General

নতুন মুখ, পুরনো রাজনীতি

গত কয়েক মাসে অবশ্য সেনার ভাবমূর্তি কিছুটা টাল খেয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রচার চালিয়েছেন যে, গত এপ্রিলে তাঁেক‌ গদি থেকে টেনে নামাতে কলকাঠি নেড়েছে সেনাই।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৫৬
Share:

পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মুনির (ছবি), অবসর নিচ্ছেন জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। নভেম্বরের শেষে তাঁর ছ’বছরের মেয়াদ শেষ হবে। কোনও দেশের সেনাপ্রধানের অবসর বা নিয়োগ নিয়ে এত চর্চা সচরাচর হয় না। কিন্তু পাকিস্তানে সেনাপ্রধানের পদের গুরুত্ব প্রধানমন্ত্রীর পদের চাইতে কিছু কম নয়। পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসের প্রায় অর্ধেকটা সময় কেটেছে সামরিক শাসনে। বাকি অর্ধেক সময়কালে নির্বাচিত নেতা টিকেছেন তত দিনই, যত দিন সেনাবাহিনীর কাজে এসেছেন। আজ অবধি পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

Advertisement

গত কয়েক মাসে অবশ্য সেনার ভাবমূর্তি কিছুটা টাল খেয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রচার চালিয়েছেন যে, গত এপ্রিলে তাঁেক‌ গদি থেকে টেনে নামাতে কলকাঠি নেড়েছে সেনাই। তাঁর জোটসঙ্গীদের ভাঙিয়ে, আস্থা ভোটের পরিস্থিতি তৈরি করে, তাঁকে হারানোর পিছনে ছিল সেনা। তাঁর উপর বন্দুকহামলার দায়ও চাপিয়েছেন সেনা এবং শরিফ সরকারের উপর, যদিও সে দাবি তেমন আঁচড় কাটতে পারেনি।

তবু বাজওয়ার অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তের পিছনে হয়তো ইমরানের সেনা-বিরোধী প্রচার খানিকটা কাজ করেছে। ইঙ্গিত মিলেছে, ব্রিগেডিয়ার ও তার নীচের পদমর্যাদার অনেকে ইমরানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাঁর স্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরির ঘোষণায় আস্থাশীল। অবশ্য শীর্ষ পদাধিকারীর মেয়াদবৃদ্ধি মানে নীচের অফিসারদের প্রোমোশন আটকে যাওয়া, এটাও একটা কারণ। তবে সেই ক্ষোভ দেখেই হয়তো পরিস্থিতির অবনতি চাননি বাজওয়া।

Advertisement

কেন আসিম মুনির? দুটো কারণ আলোচিত হচ্ছে। এক, তিনি বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ। দুই, ইমরানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ত। এর আগে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল পদ পেয়েছিলেন মুনির। আট মাসের মধ্যে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে ইমরান সেই পদে বসান নিজের ঘনিষ্ঠ জেনারেল ফৈজ় হামিদকে। মুনির থাকাকালীন ইমরান হয়তো ইচ্ছেমতো চাপ তৈরি করতে পারবেন না শাহবাজ় শরিফের সরকারের উপর।

ইমরানকে ক্ষমতায় এনেছিল সেনাবাহিনীই। সেনা তখন একটি তৃতীয় বিকল্প খুঁজছিল— ভুট্টোদের পাকিস্তান পিপলস পার্টি, আর শরিফদের পাকিস্তান মুসলিম লিগ— এই দুইয়ের বাইরে অন্য কাউকে। ইমরান পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাবমূর্তিও ছিল স্বচ্ছ। সে সময়ে এক দিকে তীব্র আর্থিক সঙ্কট, অন্য দিকে কূটনৈতিক সঙ্কট— পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমেরিকা ক্ষুব্ধ। এই অবস্থায় মনে হয়েছিল, স্বচ্ছ, শিক্ষিত ভাবমূর্তির মানুষ ইমরানই হবেন যথার্থ প্রধানমন্ত্রী। শেষ অবধি অবশ্য দেখা গেল, ট্রাম্প বা তাঁর উত্তরাধিকারী বাইডেন, আমেরিকার দুই প্রেসিডেন্টের কেউই ইমরানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ভরসা করতে পারেননি তাঁর উপরে।

আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার বা আইএমএফ-এর থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক শর্তের জন্য দরাদরি করতেও ব্যর্থ হলেন ইমরান। আর্থিক সঙ্কট সামাল দেওয়ার জন্য আইএমএফ ঋণ দেয়, কিন্তু সঙ্গে কঠিন শর্তও দেয়। ভর্তুকি-অনুদানের খাতে খরচ কমাতে বাধ্য করে। তাতে নেতার জনপ্রিয়তায় আঘাত লাগে। তার চাইতে ইমরান সৌদি আরবের মতো মিত্র দেশের থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। শেষ অবধি শাহবাজ় শরিফের সরকার আইএমএফ-এর সঙ্গে সহমতে পৌঁছে ঋণ নেয় বটে, কিন্তু এই সরকারও আটাশটি শর্তের ষোলোটাই পূরণ করতে ব্যর্থ। কে-ই বা জনরোষের মুখে পড়ে পরবর্তী নির্বাচনে হারতে চায়?

এই সুযোগে ইমরান এখন শীঘ্র নির্বাচনের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ যে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তার ক্ষোভ শরিফ সরকারের উপরে পড়বে, ইমরানের তেহরিক-এ-ইনসাফ দল ভোটে জিতে আসবে, এমনই মনে করছেন ইমরান। শরিফ সরকার একই কারণে এখন নির্বাচনে রাজি নয়। চেষ্টা চলছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনার— সেখানে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন। নওয়াজ় এখনও পঞ্জাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। পঞ্জাবে পার্লামেন্টের প্রায় অর্ধেক আসন রয়েছে বলে রাজনৈতিক ভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য।

ইমরানের বিপরীতে সবচেয়ে কার্যকর হতে পারতেন নওয়াজ়, তাঁর প্রচারের গতি রুখে দিতে পারতেন। কিন্তু নওয়াজ়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা দুর্নীতির মামলা। সে অবশ্য ইমরানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিদেশি অভ্যাগতদের থেকে পাওয়া উপহার চড়া দরে বিক্রি করে দেওয়ার। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানোই বন্ধ হতে পারে।

ইমরান ভয় দেখিয়েছেন, তিনি ২৬ নভেম্বর সমর্থকদের নিয়ে ইসলামাবাদে মিছিল করে ঢুকবেন নির্বাচনের দাবিতে। যদি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এই বিপুল জনসমাগমের সংঘাত বাধে, তা হলে ভয়ানক কাণ্ড হতে পারে। বরং রাজনৈতিক কৌশলে প্রধান নেতাদের সঙ্গে নির্বাচনের দিনক্ষণ সম্পর্কে বোঝাপড়া করে নিলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এড়ানো যায়।

পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে এখন ভারতের আদানপ্রদান কম। আপাতত ভারত দর্শকের ভূমিকায়। যদিও পাকিস্তানে বেশি দিন অস্থিরতা চললে ভারতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা-ও জানা কথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement