শিকড় এখন অনেক গভীরে
BJP

হিন্দুত্ববাদের ছাতার তলায় এসে পড়েছেন দলিত-নিম্নবর্গরাও

বিজেপি-আরএসএস’এর মোকাবিলা করতে হলে যে তার হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করতেই হবে, তাতে কোনও ভুল নেই।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৩৯
Share:

প্রচার: বিজেপি ও নিষাদ পার্টির যৌথ জনসভায় অমিত শাহ। লখনউ, ১৭ ডিসেম্বর। পিটিআই।

অমিত শাহ সে দিন লখনউয়ের জনসভায় তুলসীদাসের রামচরিতমানস-এর কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। রাম ও নিষাদরাজের বন্ধুত্বের গল্প। নিষাদরাজ তাঁর নৌকায় রাম, লক্ষ্মণ, সীতাকে গঙ্গা পার করিয়েছিলেন। বনবাসের শেষে রাম আবার নিষাদরাজের বাড়িতে রাত কাটাতে এলেন। অযোধ্যার রামকে মেঝেতে শুতে দেখে নিষাদরাজের চোখ জলে ভাসল।

Advertisement

মহাকাব্য শেষ। এ বার রাজনীতি। অমিত শাহ বললেন, বছরের পর বছর রাম ত্রিপলের মন্দিরে ছিলেন। তা দেখে হিন্দুদের দুঃখের অন্ত ছিল না। আপনারা কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে জিতিয়ে আনলেন। এ বার রামের গগনচুম্বী মন্দির তৈরি হয়ে যাবে।

সপ্তাহ দুয়েক আগে বিজেপি ও নিষাদ পার্টির যৌথ জনসভায় সে দিন নিষাদ, গোন্ড, মাঝি, মাল্লা, কৈবর্ত সম্প্রদায়ের দলিতদের ভিড়ই বেশি ছিল। জয়ধ্বনি উঠল, ‘জয় শ্রী রাম!’ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের রামের জন্মস্থানে তাঁর মন্দির ঘিরে আবেগের সঙ্গে জুড়ে গেল নিষাদরাজকে নিয়ে দলিত ভাবাবেগ। দলিতদের বোঝানো হল, রামমন্দির শুধু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের নয়। ওতে দলিতদের আরাধ্য নিষাদরাজের আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে। নিজের অজানতেই দলিতরা ঢুকে পড়লেন হিন্দুত্বের ছাতার তলায়।

Advertisement

এখন রাহুল গাঁধী যদি হঠাৎ করে বলেন, নিষাদরাজ হিন্দু হতে পারেন হিন্দুত্ববাদী নন, হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীর মধ্যে ফারাক হল এক দিকে সত্য অন্য দিকে মিথ্যা, এক দিকে ভালবাসা অন্য দিকে হিংসা, এক দিকে মহাত্মা গাঁধী অন্য দিকে নাথুরাম গডসে— তা কি নিষাদ-গোন্ড-কৈবর্ত-মাঝি-মাল্লা’রা বুঝবেন?

কেউ বুঝুন না বুঝুন, রাহুল গাঁধী এখন হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীর ফারাক ব্যাখ্যা করতে চান। তাঁর কাছে এটা কংগ্রেসের মতাদর্শের লড়াই। এত কাল তিনি বিজেপি-আরএসএস’এর হিন্দুত্বের মোকাবিলায় মন্দিরে-মন্দিরে ঘুরেছেন। আচমকাই নিজেকে শিবভক্ত বলে দাবি করেছেন। কংগ্রেস তাঁকে পৈতেধারী হিন্দু বলে পরিচয় করিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নামে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগও সেই ‘নরম হিন্দুত্ব’ দিয়ে মুছে ফেলা যায়নি। এ বার সরাসরি হিন্দুত্ববাদকে নিশানা করার মনস্থির করেছেন। তাই রাজস্থান থেকে রায়বরেলী— মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে পদযাত্রায় গিয়েও তিনি হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীর পার্থক্য কয় প্রকার ও কী কী, তা ব্যাখ্যা করছেন।

বিজেপি-আরএসএস’এর মোকাবিলা করতে হলে যে তার হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করতেই হবে, তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু রাহুল গাঁধী আসলে যে হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করছেন, তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আসল অংশটি চোখে ধরা পড়ে না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা হরিদ্বার-রায়পুরের ধর্ম সংসদ থেকে গডসের বন্দনাকারী, ধর্মীয় বিদ্বেষের ডাক দেওয়া সাধুরা আসলে আরএসএস-এর ছায়া। তার সঙ্গে লড়াই করে গাত্রবেদনা ছাড়া বিশেষ লাভ হবে না।

রাহুল গাঁধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব যেটা বুঝতে পারছেন না, বা বুঝেও অস্বীকার করছেন, তা হল— গত কয়েক দশকে আরএসএস সমাজের অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে ফেলেছে; রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতী, বিদ্যা ভারতী, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস, সরস্বতী শিশু মন্দির, সহকার ভারতী-র মতো অজস্র ছোট ছোট সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে, যারা সরাসরি আরএসএস-এর সংগঠন না হলেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এদের মাধ্যমেই সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি, দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, এমনকি সংখ্যালঘুদেরও বিজেপি-আরএসএস’এর ছাতার তলায় আনার চেষ্টা চলে। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের কারণ হিন্দি বলয়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের পাশাপাশি দলিত, আদিবাসী, ওবিসিদের ভোটও ঝোলায় পুরে ফেলা। তা নিছক নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা বা অমিত শাহের সাংগঠনিক কেরামতিতে হয়নি। আরএসএস নীরবে তার ভিত তৈরি করেছে।

নিষাদ পার্টির কথাই ধরা যাক। ২০১৬-য় দল তৈরির আগে সঞ্জয় নিষাদ মায়াবতীর বিএসপি-তে ছিলেন। কাঁসিরাম নিষাদদের দলিত পরিচয়ে বিএসপি-তে টেনে এনেছিলেন। পরে নিষাদ, কৈবর্ত, মাঝি, মাল্লাদের পৃথক পরিচিতি সত্তা তৈরি হল, পৃথক দল হল। এখন তাঁরা বিজেপির সঙ্গে জোট করেছেন। সাধারণত হিন্দুত্বের রাজনীতির বাইরে থাকা দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য প্রান্তিক সমাজের মানুষকে টেনে নেওয়ার কৌশলে শাণ দিয়ে চলেছে আরএসএস। এ তারই ফল।

যাঁরা ভাবেন, আরএসএস মানে শুধুই অযোধ্যার রামমন্দির আন্দোলন, তাঁরা বোধ হয় মনে করেন, ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে যাওয়ার পরে গত তিন দশক আরএসএস হাত গুটিয়ে বসে ছিল। অথবা, নরেন্দ্র মোদী শুধু কাশী বিশ্বনাথ করিডরই সাজিয়েছেন। তাঁদের বারাণসীর কাছে জয়পুরা এলাকার অটল নগর বস্তিতে যাওয়া উচিত। দলিত মুসহর সম্প্রদায়ের বাস। মুসহরের অর্থ, যাঁরা ইঁদুর ধরে খান। রামায়ণের গল্পের শবরী মা তাঁদের আরাধ্য দেবী। অটল নগর বস্তিতে তৈরি হয়েছে শবরী মায়ের মন্দির। মুসহরেরা সে জন্য ধন্যবাদ দেন নরেন্দ্র মোদীকে।

উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতারা প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরাকে কিছু দিন আগে লখনউয়ের কাছে অর্জুনগঞ্জে মোরী মাই-এর থানে পুজো দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্ব উত্তরপ্রদেশে গ্রামের নিম্নবর্গের মহিলারা মোরী মাইয়ের থানে পুজো দেন। প্রিয়ঙ্কা দেরি করে ফেলেছেন। নরেন্দ্র মোদীর মুখে বহু আগেই মোরী মাইয়ের বন্দনা শোনা গিয়েছে। শুধু রামমন্দির দেখিয়ে তিনি আর ভোট চাইছেন না।

কেবল দেবদেবী নয়, আরএসএস-এর প্রচারকরা ছোট ছোট প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সামাজিক আইকনদেরও খুঁজে বার করেছেন। নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর পরিপূরক হিসাবে সেই ইতিহাসে বিস্মৃত চরিত্রদের তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদ্‌যাপনেও তাই গাঁধী-নেহরুর স্বাধীনতা আন্দোলনের বাইরে প্রান্তিক চরিত্রদের কাহিনি তুলে আনার উদ্যোগ। মোদী এক দিকে দিল্লির জনপথে সনিয়া গাঁধীর চোখের সামনে ভীমরাও আম্বেডকরের নামে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার তৈরি করেছেন, আর এক দিকে আরএসএস খুঁজে বার করেছে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের রাজা সুহেলদেব, পশ্চিমাঞ্চলের গোকুল জাটের মতো রাজা-জমিদারদের, যাঁরা মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের সঙ্গে লড়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শিবাজির লড়াইয়ের কথা বললে তাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আত্মশ্লাঘা বোধ করেন। তিনি যখন মুসলিম হানাদারদের বিরুদ্ধে সুহেলদেব, গোকুল জাটের লড়াইয়ের কথা বলেছেন, তখন দলিত, প্রান্তিক মানুষের গর্বে বুক ফুলে উঠেছে।

বিজেপি-আরএসএস পশ্চিমবঙ্গেও ঠিক এই সমীকরণ মেনেই এগিয়েছিল। কলকাতার আগে তাই বিজেপির ঝান্ডা উড়েছিল জঙ্গলমহলের আদিবাসী এলাকায়। আরএসএস দীর্ঘ দিন ধরে বীরসা মুন্ডার জয়ধ্বনি দিয়ে নীরবে কাজ করছে। আদিবাসীদের সঙ্গে দলিতদের টানতে নরেন্দ্র মোদী ২০১৯-এ মতুয়া সমাজের বড়মা-কে প্রণাম করে বাংলায় লোকসভা ভোটের প্রচার শুরু করেছিলেন, বিধানসভা ভোটের সময় বাংলাদেশে মতুয়া-তীর্থ ওড়াকান্দিতে যেতে ভোলেননি। আর, দলিত-আদিবাসীর সঙ্গে বর্ণহিন্দুর ভোট টানতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তো ছিলই।

পশ্চিমবঙ্গে এই সূত্র পুরোপুরি কাজ করেনি। কারণ, বাংলায় জাতপাতের হিসাব হিন্দি বলয়ের মতো উগ্র নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিনা যুদ্ধে নিজের জমি ছাড়েননি। তিনি এর সঙ্গে বাঙালির পরিচিতি সত্তাকে হাতিয়ার করে বিজেপিকে বহিরাগত তকমা দিতে সফল হয়েছেন।

রাহুল গাঁধীর লড়াই অনেক কঠিন। তাঁর জমি অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। শুধু হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীর ফারাক বুঝিয়ে সেই জমি ফেরত পাওয়া সহজ নয়। তাঁকে বুঝতে হবে, আরএসএস মানে আর শুধুই রামায়ণের রাম আর নাথুরাম নয়। আরএসএস-এর হিন্দুত্ব মানে এখন নিষাদরাজ, শবরী মাতা, মোরী মাই, সুহেলদেবও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement