প্রতীকী ছবি।
একটা ছবি চোখে পড়ত প্রাইমারি স্কুলের পাশের দেওয়ালে। একটা লম্বা পেনসিলের দু’ধারে দুই ছেলেমেয়ে হাতে খাতা-বই নিয়ে বসে আছে, নীচে লেখা: সর্বশিক্ষা মিশন, সবার শিক্ষা, সবার অধিকার। ২০২০-২১ সালে ওই দেওয়াল লিখনের মর্মার্থ কার্যত পরিত্যাগ করা হয়েছে। সবার শিক্ষা— সর্বশিক্ষার দশা দেখে অসহায় লাগে।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে জেরবার দেশ। এর মধ্যে কাউকে স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের বিপদ ও বোকামির মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু দু’-তিন মাস আগে যখন চার পাশ একটু স্বাভাবিক হয়েছিল, তখনও সমস্ত শিক্ষাঙ্গনের গেটে ছিল তালা। রাজনৈতিক সভা, সিনেমা হল, জিম, নাইট ক্লাবের দরজা খোলা গেলে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ কেন?
শিক্ষা যে প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত অধিকার, এই ধারণা কার্যত অস্বীকার করাই এ সমস্যার মূল কারণ বলে মনে হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে চলছে অনলাইন ক্লাস।
অথচ আমাদের মতো দেশে, যেখানে দু’বেলা পেটের ভাত জোটাতে নাজেহাল হতে হয়, সেখানে অনলাইন ক্লাস সোনার পাথরবাটি ভিন্ন কিছু নয়। ২০২১-এর জানুয়ারি মাসের তথ্য বলছে, দেশে অর্ধেকেরও কম মানুষ ইন্টারনেট পরিষেবা পায়, মোটের উপর ৪৫ শতাংশ। যদিও ‘পরিষেবা পায়’ নয়, ‘পরিষেবা নেয়’ বলা উচিত। পূর্ববর্তী লকডাউন মানুষের বাঁচার অধিকারই কেড়ে নিয়েছিল প্রায়। বছর ঘুরতেই সাময়িক লকডাউন ও মৃত্যুভয় কাবু করেছে বিরাট জনগোষ্ঠীকে। এই অবস্থায় কি তাদের পক্ষে ইন্টারনেট পরিষেবা নেওয়া সম্ভব?
শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ প্রশ্ন তুলেছে যে, কেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাঙ্গনের দরজা খোলা হবে না? কয়েক দিনের জন্য কিছু জায়গায় নামমাত্র স্কুল খোলার ব্যবস্থা করা হলেও তা যথেষ্ট কার্যকর হয়নি। ক্লাসরুম শিক্ষা শুধু বই মুখস্থ নয়, মানসিক ও শারীরিক বিকাশেরও অঙ্গ। দিনের পর দিন বাড়িতে থেকে শিশুদের মন বিকশিত হতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রজীবন। আর উচ্চশিক্ষায় স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্ররা ও পিএইচ ডি গবেষকরা পরবর্তী স্তরের পড়াশোনা, গবেষণা বা অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে যে, শহরাঞ্চলের বহু সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের এ সমস্যা পোহাতে হচ্ছে না। তাদের হাতে স্মার্টফোন ও নেট পরিষেবা। কিন্তু, প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলের যে সব শিশুর বাড়িতে তার সামর্থ্য নেই, সেখানে তারা প্রায় দেড় বছর শ্রেণিকক্ষ হতে বঞ্চিত। তাদের ছোট বয়সে শিক্ষার বুনিয়াদই নষ্ট হতে বসেছে। এখানেই প্রশ্রয় পাচ্ছে এক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য— ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। এটা এক শ্রেণির ছাত্রকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পিত ব্যবস্থা নয় তো? কফিনে সম্ভবত শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি।
তবে, সবচেয়ে সমস্যা সরকারের এটা ধরে নেওয়ার বিলাসিতায় যে, প্রত্যেক প্রান্তে সবার স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। মিড-ডে মিলের আশায় স্কুলে যাওয়া গরিব, অসহায় ভারতীয় সন্তান স্মার্টফোনের সুযোগ থেকে বহু দূরে— এ কথা বুঝতে মহাজ্ঞানী হতে হয় না। ট্যাব প্রদানের মাধ্যমে কিছু চেষ্টা করেছিল রাজ্য সরকার, তবে সমগ্র ছাত্রসমাজ উপকৃত হয়নি। অনলাইন শিক্ষা যে ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প নয়, তা মানেন অধ্যাপকেরাও— “কত দিন আর ফার্নিচারের দিকে চোখ রেখে পড়ানো যায়!”
এ আসলে শিক্ষাঙ্গনকে সঙ্কুচিত করে আনার প্রয়াস। ফিরে যাওয়া ব্রিটিশ শাসনে, যেখানে ‘বাবু’ সম্প্রদায় ব্যতীত শিক্ষালাভ অসম্ভব। দেশ যখন ব্রিটিশ-মুক্ত হয়, তখন শিক্ষার হার ১৬ শতাংশ। এখন তা প্রায় ৭৪— বিশাল অগ্রগতি। কিন্তু, এখন সেই গণশিক্ষাই সর্বত্র বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। স্মার্টফোন না থাকায় আত্মহত্যার খবর যার চরমতম উদাহরণ। সরকারি শিক্ষাঙ্গনকে বেসরকারি হাতে সমর্পণ করার প্রাথমিক সোপান বললেও ভুল হয় না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন: স্কুল খোলার পর দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে কী অবস্থা হয়েছিল? পাল্টা জিজ্ঞাসা করব: স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার পরেও কি মহারাষ্ট্র বা দিল্লিতে দ্বিতীয় ঢেউ আটকানো গিয়েছে? জিম বা রেস্তরাঁ খোলাতে হয়তো সংক্রমণের হার বেড়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকৃত কারণ তা না-ও হতে পারে। সংক্রমণ কোথা থেকে, কী ভাবে হয়, তার কোনও সুস্পষ্ট জানাশোনা আমাদের হাতে এখনও নেই।
মোট কথা, বিপজ্জনক সত্য হল, সরকার রাজনৈতিক সভাকে যতটা অগ্রাধিকার দিয়েছে, শিক্ষাঙ্গনকে ততটা দেয়নি! তবে কি ভারতে সর্বজনীন শিক্ষা অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিক?
সর্বজনীন স্বাস্থ্যের অবহেলায় কী ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়, দ্বিতীয় ঢেউ তারই সাক্ষী। সর্বজনীন শিক্ষায় অবহেলার মাসুল আগামী প্রজন্মকে জীবন দিয়ে দিতে হবে না তো?