উন্মোচন: বিশ্বভারতী-র ছাত্রদের সঙ্গে খোলা আকাশের তলায় শ্রেণিকক্ষে রবীন্দ্রনাথ
দিন কোথা? দিন নেই, দিন প্রতি রাত্রি প্রতীক্ষায়।
রাত্রি যায়, আসে।
(বিষ্ণু দে, ‘রাত্রি যায়, আসে’)
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পঁচাত্তর বছরে অমৃত মহোৎসব উদ্যাপনের মুহূর্তে সবচেয়ে আগে যা প্রয়োজন ছিল তা হল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষাসংস্কৃতির নির্মোহ পুনর্মূল্যায়ন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্টক-টেকিং’। এই আত্মসমীক্ষার প্রয়াস আমাদের আপন স্থানাঙ্ক নির্ধারণে সাহায্য করত, হয়তো ভবিষ্যতের অনিশ্চিত যাত্রাপথে খানিকটা আত্মবিশ্বাস জোগাত, নতুন ভাবনার দুয়ার খুলত। দুঃখের বিষয়, তা হয়নি।
এই বত্রিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিরাট দেশে শিক্ষার বিপুল জাহাজটি ডুবতে ডুবতে যে কোনও ক্রমে ভেসে আছে, সে কথা অস্বীকার করলে অসত্য বলা হবে। শিক্ষাসংক্রান্ত অসংখ্য কমিশন আমাদের এই জটিল ও বহুস্তর বহুভাষিক দেশের সমস্যাগুলির সুরাহা করতে পারেনি। ঔপনিবেশিক অতীত ফাঁসের মতো গলায় আটকে থেকে চিন্তার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে কি না, এই প্রশ্নে এখনও আমরা দ্বিধাবিভক্ত। গত একশো বছরে শিক্ষাসংক্রান্ত সবচেয়ে সাহসী পরীক্ষাগুলির একটি নিশ্চয় বিশ্বভারতী, যা ক্রমশ ঘুণে জর্জরিত হয়েছে, এবং শতবর্ষেও যার ন্যূনতম মর্ম আমরা বুঝিনি। জাতির জনকের শিক্ষাচিন্তাকেও আমরা স্বাধীন ভারতে ক্ষমাঘেন্না করে স্মরণ করেছি শুধু মৌখিক ভাবে, প্রকৃতপক্ষে তাঁকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় দিয়েছি সবার আগে। আমাদের বয়ানে তিনি অনুপস্থিত, ‘লোকহিত’ শব্দটির মতো।
রাজনৈতিক দলগুলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কব্জা করার জন্য তাদের প্রকল্প অব্যাহত রেখেছে। বাম জমানা এই সন্ত্রাসের এক অদ্ভুত উদাহরণ। বাম নেতারা গ্রামশ্চি পড়েননি, মননের মুক্ত উন্মীলন তাঁদের আতঙ্কের কারণ হতে পারত। ভারতবর্ষ সেই দেশ যেখানে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ করে বলার সময় এসেছে, ‘আমরা শিক্ষামন্ত্রী চাই না, চাই মন্ত্রীদের শিক্ষা’। আয়না ভাঙতে ভাঙতে-তে পড়েছি, ‘এদেশে শিক্ষাসংস্কারের কিছু হলো না কেন’, এই প্রশ্নের উত্তরে তপন রায়চৌধুরী বলছেন, ‘নেতাবাবুদের সৌজন্যে’ “স্বাধীন ভারতে হাতকচলানো সংস্কৃতি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে। এই ব্যাপারে যার যত পটুত্ব তার তত পোয়াবারো। ওই পথে শনি প্রবেশ করলেন।”
নিয়মরক্ষার্থে অথবা নিছক ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য একের পর এক যথেচ্ছ ভাবে শিক্ষাপদ্ধতি বদলানো হয়েছে, সেই সব বদলের পিছনে কোনও গভীর ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল বলে মনে হয় না। সেগুলি যেন অনেকটা পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন, আখেরে কী লাভ হল, আদৌ হল কি না, রাজনৈতিক দল থেকে নেতামন্ত্রী কেউ বিশেষ ভাবেননি। সম্প্রতি পাঠ্যক্রমে বড় রকমের পরিবর্তন আনার সময় শিক্ষাবিদদের মধ্যে কোনও বিতর্কের ব্যবস্থা হয়নি। দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপজ্জনক ভাবে একই পাঠ্যক্রম আরোপ করা যে শিক্ষার মৌলিক চিন্তার বিরোধী, এ কথা সারা পৃথিবীর চিন্তকেরা জানেন।
নিন্দুকেরা বলবেন, আসল কারণ হল, একতরফা একাধিপত্য জারি করার ফন্দি হিসেবে এমন পাঠ্যক্রমের জুড়ি নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাগামছাড়া দুর্নীতি, ও লোভ, যার চূড়ান্ত নমুনা সম্প্রতি ইস্কুলে নিয়োগ কাণ্ডে আমাদের সামনে উদ্ঘাটিত হল।
এই সব প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি যেটা আমাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে, সেটা হল আর্থসামাজিক নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে (বিশ্বায়নের অভিঘাত নিঃসন্দেহে যার প্রধান কারণ) আমাদের রক্তমজ্জায় ক্রমক্ষীয়মাণ ভালবাসা। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও মমতা না থাকলে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠদান কী ভাবে পঙ্গু হয়ে যায় তার উদাহরণ আমরা প্রতি দিন দেখছি। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-তে আছে, “শিক্ষকদের মধ্যে একজনের কথা আমার মনে আছে, তিনি এমন কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিতেন যে তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত তাঁহার কোনও প্রশ্নেরই উত্তর করিতাম না। সম্বৎসর তাঁহার ক্লাসে আমি সকল ছাত্রের শেষে নীরবে বসিয়া থাকিতাম।” এই অশ্রদ্ধেয় জড় জগৎ সম্পর্কে তাঁর প্রতিবাদই বিশ্বভারতী, যার মূল্য ও তাৎপর্য আমরা আজও বুঝিনি— বুঝলে হয়তো কিছু চিন্তার সূত্র মিলত।
নিজে শিক্ষক হিসেবে বলতে লজ্জা পাই যে, যা খোয়াতে বসেছি তা হল শিক্ষার মধ্যে শ্রদ্ধার বিষয়টি। গবেষণার সংখ্যা ও বৈচিত্র শতগুণ বাড়লেও বিনয়বিদ্বান অধ্যাপকের অভাব বয়ে এনেছে আমাদের সর্বনাশ। যাবতীয় ভুলত্রুটির জন্য ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো নিকৃষ্ট শিক্ষকদের একটি দৈনিক বিলাস। বিভাগীয় শিক্ষক কক্ষে মিটিংয়ে বসে যখন অনুতাপ করেছি যে, যথেষ্ট ভাল করে পড়াতে পারিনি, প্রায় কাউকে সে-কথার প্রতিধ্বনি করতে শুনিনি। এই অকারণ আত্মশ্লাঘা এবং সীমাহীন উদাসীনতা যে এই হতভাগ্য দেশে শিক্ষার বিকাশকে পদে পদে প্রতিহত করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
বেশ কিছু শিক্ষকের উদাসীনতায় বহু ছাত্রছাত্রীর জীবন বিস্রস্ত হতে দেখেছি। ক্লাসে ভাল (অর্থাৎ ভালবেসে) পড়ানো হলে দেশ জুড়ে লেখাপড়ার কালোবাজার স্ফীত হয় কী করে, এর উত্তর বোধ হয় শিক্ষক-অধ্যাপকদেরই দিতে হবে। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাইনি আমরা, আয়নার উপর সভয়ে চাদর চাপা দেওয়ার মতো। অথচ সুনিশ্চিত ভাবে এই ভালবাসার অভাবের মধ্যে বহুলাংশে নিহিত আছে আমাদের এই ‘টাইটানিক’-প্রতিম শিক্ষাব্যবস্থার বিপুল ব্যর্থতা আর দীর্ঘশ্বাস।
রক্ষাকর্তার ভূমিকায় এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বণিকবৃত্তি আরও বিপজ্জনক। সেখানে শিক্ষা হয়ে উঠেছে সমাজে ফাটল বাড়িয়ে দেওয়া একটি পণ্য। ফলে শিক্ষাজগৎ থেকে নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ কোনও ভালবাসা না পেয়ে আপিস কাছারি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্টে সেই ভালবাসাহীনতার স্বাক্ষর রাখবে, এটা কি আমরা ভুলে গিয়েছি? খোঁজ করলে জানা যাবে, কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষিকার স্নেহ ও বিশ্বাস তাদের সম্পদ। সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্কুলশিক্ষকের কথা আমার মনে নেই যাঁর মধ্যে ক্ষমতার দাপট ছাড়া আর কিছু দেখিনি, মনে আছে সেই স্নেহশীল মানুষটির কথা যিনি বলেছিলেন, “তুই পারবি, আমি জানি। আচ্ছা, এই সোয়েটারটা কে বানিয়েছেন রে? মা?”
‘আমি ছাত্রের ভৃত্য’, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের (সাক্ষাৎকার, বইয়ের দেশ, জুলাই ২০১০) এই কথাটি আমরা ভুলব না। এটা একটা কথার কথা নয়। সময়ের চাহিদা, পৃথিবীর চাহিদা পাল্টালেও ভালবাসার জন্য কাঙালপনা তো ফুরোয় না। ছাত্রছাত্রীরা রুহিতন ইস্কাবন নয়। ‘নিখিলের হৃদয়স্পন্দ’ না শুনলে, ‘অন্তর কম্পিত’ না হলে তারা মারের সাগর পাড়ি দেবে কী করে? কোনও আচার্য, উপাচার্য, বা মন্ত্রী-মহোদয় এর সমাধান করতে পারবেন না। এর চাবিকাঠি শিক্ষকের হৃদয়ে। এখানেই তাঁর শক্তি।
আজও এমন বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, ‘মন্দ যদি তিন চল্লিশ, ভালর সংখ্যা সাতান্ন’। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এখনও শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার সোনার কাঠিতে জেগে উঠতে পারে এক-একটি মুহূর্তের প্রাণ। এক জন ছাত্র বা ছাত্রী এখনও তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে সেই আশ্চর্য শিক্ষক বা শিক্ষিকার জন্য, যাঁর কাজ স্বপ্ন দেখা ও দেখানো। জ্ঞানচর্চা যখন প্রায় সম্পূর্ণ পার্শ্বরেখায়িত হয়ে গেছে, তখন এই কাজটি একটি একক লড়াই। মানবিকতার মুখোশ পরা আজকের নিয়োলিবারালিজ়ম-এর চৌহদ্দিতে এ সব কথা আর ভাবা যায় কি?
সমস্ত কুয়াশা পেরিয়ে সেই শিক্ষক সংযুক্ত করতে চান সমুদ্রের সঙ্গে, স্মৃতির সঙ্গে, ঘরকে বাহিরের সঙ্গে, শঙ্খ ঘোষের শব্দ ব্যবহার করে বলি, ‘সমগ্রের’ সঙ্গে। নইলে ‘ভূতের উপদ্রব’ আর ‘অদ্ভুতের শাসন’ থেকে মুক্তি পাব কী করে (রবীন্দ্রনাথ, ‘শিক্ষার মিলন’)? বিদ্যা তো ‘এঞ্জিনে’ চলে না! আমাদের লড়াই ‘ভূতের সঙ্গে, অবুদ্ধির সঙ্গে, অবাস্তবের সঙ্গে’ (‘সমস্যা’, কালান্তর)।
বাইরের জগৎ যখন মনের মধ্যে প্রবেশ করে অন্য আর একটা জগৎ তৈরি হয়। ক্লাসঘর হয়ে ওঠে জাহাজ, যা অকূল দরিয়ায় পাড়ি দিতে চায়। এত নিঃশ্বাস বন্ধ করা পরিবেশে সেটাও কি কম বড় আশীর্বাদ?