অন্তরেই হেরে বসে আছেন
CPM

সিপিআইএম অপারগ হলে নতুন বামপন্থী বিকল্প গড়া দরকার

কংগ্রেস ও সিদ্দিকির দলের সঙ্গে বামফ্রন্টের জগাখিচুড়ি জোট মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

Advertisement

প্রসেনজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২১ ০৫:৫৯
Share:

রাজ্যে চৌত্রিশ বছরের শাসক বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারানোর এক দশকের মধ্যেই নির্বাচনী পরিসরে যে ভাবে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল, তা কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। বরং সোভিয়েট ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ধসে পড়ার সঙ্গে তুলনীয়।

Advertisement

কেন এই নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটল, তা ‘বৃহত্তম’ বাম দলটির নেতৃত্বের নিরুত্তাপ এবং অনুশোচনাহীন প্রতিক্রিয়া থেকেই খানিকটা বোঝা যায়। সিপিআইএম-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি নির্বাচনী ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে শুরুতে বলা হয়েছে, ‘বামপন্থীদের এবং সংযুক্ত মোর্চার ফলাফল বিপর্যয়কর হয়েছে’; তার পরই আবার বলা হয়েছে: “সিপিআইএম যে ১৩৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তার ৯৪টিতে ২০১৯-এর তুলনায় ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে।” নির্বাচন হল ২৯২ আসনে। মোর্চা সব আসনে লড়ে পেল ১০ শতাংশ ভোট। ২০১৬-র নির্বাচনে হেরে গেলেও বাম-কংগ্রেস জোটের সম্মিলিত ভোট ছিল প্রায় ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ, বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকির নবগঠিত দলকে যুক্ত করেও ২৯ শতাংশ-বিন্দু ভোট কমেছে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ৭.৫ শতাংশ ভোটও কমে ২০২১’এ ৫.৭ শতাংশ হয়েছে। তবু সিপিআইএমের নেতৃত্ব মাত্র ৯৪ আসনে সামান্য কিছু ভোট বৃদ্ধির শাক দিয়ে নির্বাচনী বিপর্যয়ের হাঙর ঢাকতে চাইছেন। এই ভোট বৃদ্ধির এমনই বহর যে, ১৩৮ আসনের মধ্যে সিপিআইএমের জামানত রক্ষা হয়েছে ১৮টি কেন্দ্রে।

আসলে সিপিআইএমের রাজ্য নেতৃত্ব দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রথমত, তৃণমূল সরকারের চরিত্র বা কার্যকলাপ যতই নেতিবাচক হোক, তাদের সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিজেপির সমার্থক করে দিয়ে রাজ্য সিপিআইএম যে ‘বিজেমূল’-লাইন নামিয়েছে, সেটা মস্ত ভুল। এমনকি, এটা সিপিআইএমের জাতীয় স্তরের ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গেও সামঞ্জস্যহীন। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস ও সিদ্দিকির দলের সঙ্গে বামফ্রন্টের জগাখিচুড়ি জোট মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

Advertisement

পর্যালোচনায় এক জায়গায় বলা হয়েছে: “জনগণ তৃণমূলকে বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে বেছে নেন... তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তীব্র মেরুকরণ হয়ে যায়। নির্বাচনী ফলাফলের এটিই সম্ভবত মূল কারণ।” একই অনুচ্ছেদে আবার লেখা আছে: “সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে এই ফলের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা ভুল হবে। পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে বিজেপি তৃণমূল উভয়ই ব্যবহার করেছে, তার মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি।”

এই নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়েছে না হয়নি, সেটাই সিপিআইএম নেতৃত্ব ঠিক করতে পারছেন না। অথচ, নন্দীগ্রামের নির্বাচনের দিন শুভেন্দু অধিকারী কোন ভাষায় কথা বলেছেন, চতুর্থ দফার ভোটের দিন শীতলখুচির হত্যাকাণ্ড এবং তার পর বিভিন্ন বিজেপি নেতার মুখে আরও শীতলখুচি করে দেওয়ার হুমকি, এগুলো সকলেই দেখেছেন। তা সত্ত্বেও বিজেপির উগ্র-সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘পরিচিতি সত্তার রাজনীতি’র সঙ্গে সিপিআইএম নেতৃত্ব এক আসনে বসিয়ে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে এই প্রশ্নও ওঠে যে, আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিপিআইএম ঠিক কোন সত্তার রাজনীতির মোকাবিলা করতে চেয়েছে?

সিপিআইএমের পর্যালোচনায় নির্বাচনী প্রচার দাগ না কাটতে পারা, জনগণের সঙ্গে বামফ্রন্টের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হওয়া এবং সাংগঠনিক কাজকর্মে ‘গুরুতর’ ত্রুটির মতো কিছু বিষয়কে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মূল রাজনৈতিক লাইনটাই যেখানে ভুল, সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই সেই লাইনের প্রচারও দাগ কাটতে পারবে না, জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করবে এবং সংগঠনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দেবে।

২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট গত ১৫ বছর ধরে প্রতিটি নির্বাচনে ধারাবাহিক ভাবে কমতে কমতে আজ যখন ৫ শতাংশের আশেপাশে, তখন পার্টি নেতৃত্বের মনে সন্দেহ উঁকি দিয়েছে যে তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন। শুধু এই নির্বাচনে নয়, দীর্ঘ দিন ধরে অনুশীলিত রাজ্য সিপিআইএম নেতৃত্বের ‘বেঙ্গল লাইন’ যে পুরোটাই ভুল ছিল, সেই সহজ কথাটা তাঁরা কিছুতেই মানছেন না। এটাই বামফ্রন্টকে অবলুপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে। ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’-তে মোহাচ্ছন্ন বামফ্রন্ট সরকার শিল্পায়নের নামে জোর করে জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হল, পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীদের মৃত্যু হল, গ্রামের গরিব, ভাগচাষিরা বামফ্রন্টের থেকে মুখ ফেরালেন। অথচ, আজ পর্যন্ত সিপিআইএম নেতৃত্ব সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাকে স্রেফ বিরোধীদের চক্রান্ত হিসেবেই প্রচার করে যাচ্ছেন, নিজেদের বিচ্যুতির চিহ্নিতকরণ ও তার শুদ্ধিকরণ, কোনওটাই হয়নি। গুজরাতের কারখানায় ন্যানো গাড়ির উৎপাদন বন্ধ। তবু সিপিআইএমের অরণ্যে ন্যানো-রোদন থামেনি।

চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের কি কোনও নেতিবাচক দিক ছিল না? শ্রমজীবী গরিব মানুষ ক্রমে পার্টির উপর আস্থা হারালেন কেন? শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের কী হাল হয়েছিল বাম জমানার শেষ দশকে? কী পরিণতি ঘটেছিল গণতন্ত্র, বিকেন্দ্রীকরণ, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বা সমবায় আন্দোলনের? নারী, দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি থেকে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমান, এই বহুজন সমাজের সামাজিক ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষাকে এবং সংবিধান-সম্মত দাবিগুলিকে কেন ‘পরিচিতি সত্তার রাজনীতি’ বলে অবদমন করা হল? সাচার কমিটির রিপোর্টও কি তা হলে চক্রান্ত ছিল? ক্ষমতা হারানোর এক দশক পরেও বামশাসনের কোনও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন বা আত্মসমালোচনা সিপিআইএম করে উঠতে পারেনি। এর ফলে নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে। তৃণমূলের অত্যাচারে মানুষের ক্ষোভ বাড়লেও বামফ্রন্ট জমানার ব্যর্থ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন তৃণমূল সরকারের স্বাস্থ্যনীতির সমালোচনা করেছেন, এক সময় সারদা অফিসের ফিতে কেটে উদ্বোধন করা প্রাক্তন সাংসদ গলা ফাটিয়েছেন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে, জনগণ সেই দ্বিচারিতা-পূর্ণ বিরোধিতা গ্রহণ করেননি।

শুদ্ধিকরণের পথকে বর্জন করে ২০১৬-র নির্বাচনে সিপিআইএম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় ফেরার শর্টকাট কৌশল নেয়। ক্ষমতায় ফেরা তো হলই না, এই সুবিধাবাদী জোটের ফলে বামফ্রন্ট বিধানসভায় তৃতীয় স্থানে চলে যায়। এর থেকেই সৃষ্টি হয় বিরোধী পরিসরের শূন্যস্থান, যেটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগিয়ে ভরাট করতে থাকে বিজেপি। এই সময়ে সিপিআইএম মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় মতাদর্শগত অবস্থান নিয়ে তীব্র বিজেপি-বিরোধী প্রচার না করে, তার বিপরীত পথে হেঁটে ‘মোদীভাই-দিদিভাই সেটিং’-এর গল্প ফেঁদে বস্তুত বিজেপিকে জায়গা বানাতে সাহায্য করে। এই ভ্রান্ত অবস্থানের কারণেই প্রথমে ২০১৬’র লোকসভা উপনির্বাচনে, তার পর ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবং অবশেষে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিশাল সংখ্যায় বাম ভোটার বিজেপির দিকে চলে যান। এই রাজনৈতিক হারাকিরির জবাবদিহি করা তো দূরে থাক, এই বাম ভোট রামে যাওয়ার বাস্তবতাকেই এখনও সিপিআইএমের রাজ্য নেতৃত্ব স্বীকার করেননি।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার ফলে সিপিআইএম বিজেপির ক্ষমতায় আসার বহুমাত্রিক বিপদ সম্বন্ধেও নির্লিপ্ত থেকেছে। যার ফলে গত দুই বছরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনে সিপিআইএমের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে নিস্পৃহ। এই ভুল দিশার ধারাবাহিকতাতেই এসেছে ‘বিজেমূল’-এর নির্বাচনী লাইন, যার পরিণতিতে বামফ্রন্ট আজ শূন্য।

এই ভুল লাইনের নাগপাশে সিপিআইএম আজ এতটাই আবদ্ধ যে, এর থেকে কোনও সহজ মুক্তির সম্ভাবনা নেই। পার্টির অভ্যন্তরে ভুল লাইনের বিরুদ্ধে জোরালো মতামত থাকলেও নেতৃত্বের কোনও অংশের মধ্যে অন্তঃপার্টি সংগ্রামের মাধ্যমে শুদ্ধিকরণের সদিচ্ছা নেই; প্রায় সকলেই অন্তরের লড়াইটা হেরে বসে আছেন। না হলে এই রকম ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের পর রাজ্য কমিটির বৈঠকে পর্যালোচনার নামে প্রহসন হয় না।

রেড ভলান্টিয়াররা যত ভাল কাজই করুন, শুধু সমাজসেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা বা সমর্থন, কোনওটাই ফিরবে না। তার জন্য আজ প্রয়োজন মতাদর্শগত পুনরুজ্জীবন, রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এবং সর্বোপরি দিগ্ভ্রান্ত নেতৃত্বের আপাদমস্তক পরিবর্তন। সিপিআইএম অপারগ হলে অন্যান্য ছোট বাম দল এবং প্রগতিশীল গণ-আন্দোলনের কর্মীদের এক নতুন বামপন্থী বিকল্প নির্মাণের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে। অধঃপতিত সিপিআইএম নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র, বিকল্প বামপন্থাই হয়তো পারবে এক দিকে ‘বিজেমূল’ জাতীয় বিচ্যুতির থেকে মুক্ত হয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক আর সুবিধাবাদী দলবদলুদের বাংলার রাজনীতির বিরোধী পরিসরেও কোণঠাসা করতে; অন্য দিকে তৃণমূল কংগ্রেস শাসনের অন্যায়-অবিচার, অগণতান্ত্রিক কুকর্মগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement