‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার স্লোগান দেওয়াই যথেষ্ট নয়
PM Modi

মোদীর নয়, নেহরুর পথ

ভারতে শিল্প উৎপাদনের প্রসার ঘটাতে হবে, নরেন্দ্র মোদীকে এই ধারণাটির জনক বলে ধরে নিলে মোক্ষম ভুল হবে।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২২ ০৪:৪৩
Share:

দূরদর্শী: প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা। ১৯৫৪

কিছু দিন ধরে আমরা মেক ইন ইন্ডিয়া এবং আত্মনির্ভর ভারতের কথা শুনছি। ভারতে শিল্প উৎপাদনের প্রসার ঘটাতে হবে, নরেন্দ্র মোদীকে এই ধারণাটির জনক বলে ধরে নিলে মোক্ষম ভুল হবে। দেশের ভিতরে যে বহুমুখী শিল্পের প্রয়োজন, ভারত স্বাধীন হওয়ার অন্তত দশ বছর আগে থেকেই এই কথাটি নিরন্তর বলেছিলেন যিনি, তাঁর নাম জওহরলাল নেহরু। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি থেকে সেই ভাবনার রাষ্ট্রীয় রূপায়ণের সূচনা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাগজপত্রে তার চূড়ান্ত প্রকাশ। তবে, বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পায়ন নয়, নেহরুর সরকার রাষ্ট্রীয় শিল্পসংস্থা তৈরি করেছিল বা তৈরি করার পক্ষে সওয়াল করেছিল। তখন আশঙ্কা ছিল, সদ্য স্বাধীন ভারত নিজে শিল্প তৈরি না করলে বণিকের মানদণ্ড আবার রাজদণ্ড হয়ে দেখা দিতে পারে। কিংবা আবার কার্যত অর্থনৈতিক কলোনি হয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

Advertisement

নেহরু-মহলানবিশ মডেলের এই ‘সমাজবাদী’ অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে পরে অনেক সমালোচনা হয়েছে। শিল্প করতে গিয়ে কৃষিকে উপেক্ষা করা হয়েছে— এই সমালোচনার জন্য পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোতে নীতি শোধরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। আরও পরে শুধু আত্মনির্ভর হয়ে থাকার জন্য এবং নিয়ন্ত্রণের দুর্নীতি সারা দেশকে গ্রাস করায় অর্থনৈতিক উদারনীতি ও সংস্কার আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসম্বন্ধীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার, বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার একটা উচ্চতর গুণমানের ট্র্যাডিশন তৈরি, দক্ষ শ্রমিক ও বিদেশি প্রযুক্তি আয়ত্ত করার শিক্ষা— সে সবেরও প্রসার ঘটে এই আমলেই। নেহরুর সেল্ফ রিলায়্যান্ট বা আত্মনির্ভর ভারতের সঙ্গে এখনকার আত্মনির্ভরতার একটা বড় ফারাক আছে। তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হত, তাদের মাধ্যমে প্রচুর বিনিয়োগ করত সরকার। এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দিন। অনেক প্রতিষ্ঠান হয় বাজারে দাঁড়াতে পারছে না দক্ষতার অভাবে, নয়তো জোর করে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং বেসরকারি কুপ্রভাবের ফলে সেখানে লালবাতি জ্বলছে। আর এই দুর্ভাগ্যের ইতিহাস শুধু সাম্প্রতিক নয়। তখন ছিল গড়ার পালা, এখন ভাঙার।

এখন আমাদের দেশের শিল্পের হাল, এবং সরকারি ও বেসরকারি, উভয় বিনিয়োগের পরিমাণই ঐতিহাসিক ভাবে তলার দিকে। তাতেই আমাদের শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে। তবে সত্যি কথা হল, চিনের কারণে দুনিয়ার কোনও দেশই আর প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভর হতে পারছে না। কারণ, চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেওয়া দুষ্কর। কম মজুরি, কম বয়সি শ্রমিক, এ সব থাকা সত্ত্বেও ভারত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিতে চিনের চেয়ে পিছিয়ে— শ্রমের দক্ষতা, প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ। চিনের ক্ষেত্রেও কিন্তু সরকারি লৌহ-নিয়ন্ত্রণের আধারে লালিত-পালিত হচ্ছে শিল্পে বিশ্বজয়ীর সংসার। একটা কথা মনে রাখা জরুরি— মুখে যা-ই বলি না কেন, ভোটের রাজনীতি যত ক্ষণ মোক্ষ, তত ক্ষণ চিনের মতো শিল্পায়নের স্বপ্ন অধরাই থাকবে।

Advertisement

প্রশ্ন হল, বেসরকারি উদ্যোগপতিদের সাহায্যে এখনও কেন আমাদের শিল্পায়নের এই অবস্থা? আমরা কি তাঁদের উপর ভরসা করতে পারি? মনে রাখতে হবে যে, ভারতে অন্তত গত দু’দশকের যা সমৃদ্ধি, সবেরই মূলে রয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের আয় বৃদ্ধির ঘটনা। চিনের তুলনায় শিল্পক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগের হার অনেক দিন ধরেই অনেক কম। এ দেশে ব্যবসা বলতে ১০ টাকায় কিনে ২০ টাকায় বিক্রি করা বোঝায়। বিনিয়োগ বোঝায় না। সরকারি বিনিয়োগের হার গত দু’দশক ধরে জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশে আটকে আছে আর বেসরকারি বিনিয়োগের হার ওই বিশ বছরে ৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। চিনের বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশি।

বাজেটে যদি বলা হয় যে, ১০০ টাকা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করা হবে, তা হলে দেখতে হয় এখন আমাদের আয়ের কতটা আমরা বিনিয়োগ করছি। যদি কাল আমাদের রোজগার ১০০০ টাকায় আমরা ৮০ টাকা বিনিয়োগ করে থাকি, আর আজ ২০০০ টাকার রোজগারে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করি, তা হলে বিনিয়োগের হার কমে যাবে। জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার বাড়াতে বিনিয়োগের হারে বৃদ্ধি ঘটাতে হয়— বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ালেই হয় না। অর্থাৎ, আগের বছর আমার বিনিয়োগের হার ছিল ১০০০ টাকায় ৮০ টাকা মানে ৮ শতাংশ, আর ২০০০ টাকায় ১০০ টাকা মানে ৫ শতাংশ— তাই ১০০, ৮০-র চেয়ে বেশি হলেও আমরা কিন্তু ৩ শতাংশ কম হারে বিনিয়োগ করছি।

দক্ষিণ কোরিয়ার যেমন স্যামসং বা হুন্ডাইয়ের মতো গোটা দুনিয়ায় বহুলপরিচিত ব্র্যান্ড আছে, ভারতের একটিও শিল্পজাত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড নেই। এখানে কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কেউ কেউ আছেন, যাঁদের জিনিসপত্রের নাম বিশ্বে তেমন কেউ জানেন না। তাঁরা অনেকেই ১০ টাকায় কিনে ১৫ টাকায় বিক্রি করে বড়লোক হচ্ছেন। শিল্প আর ব্যবসা এক জিনিস নয়— আমাদের সংজ্ঞায় গন্ডগোল আছে। এ দেশের পরিষেবাক্ষেত্রের বড় নামগুলোকে বিশ্বে, বিশেষ করে বড়লোক দেশগুলোতে, সবাই এক ডাকে চেনে। সফটওয়্যার সম্পর্কিত ব্যবসায় ভারতের খুব নাম। কিন্তু আইফোন বা গ্যালাক্সি আমরা তৈরি করতে পারি না। নিদেনপক্ষে একটা মোটরগাড়ি।

অথচ, ১৯৭০ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়া আর ভারতের মধ্যে তেমন কোনও অর্থনৈতিক ফারাক ছিল না। এখন সারা বিশ্বে চিনের পরেই দক্ষিণ কোরিয়ার জয়জয়কার, তাও চিন অনেক নকল জিনিস তৈরি করে— আসল জিনিসে দক্ষিণ কোরিয়া তাকে টেক্কা দেয়। ভারতে বেসরকারি উদ্যোগ টাকা রোজগার করতে চায়, বিনিয়োগে খরচা করতে চায় না। যেটুকু লগ্নি, তা ওই সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা ধার করে। প্রচুর ধারদেনা করে শোধ না দিলে সরকার বাঁচিয়ে দেবে, ব্যাঙ্কটা বিক্রি হয়ে যাবে, যাক। আর পাহাড়প্রমাণ সম্পদ থাকলেও অন্যের পয়সায় বিনিয়োগেই এদের উৎসাহ।

সুদের হার কমলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে হেলদোল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, এ দেশে সুদ একটু বেশি হলেই মনে হয় শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস উঠছে। বিনিয়োগের জন্য নয়, মুনাফা কমছে বলে। সুদের হার কমলে মুনাফার পরিমাণ বাড়ে। ভারতের ব্যবসায়ীরা ভুলেও সেই মুনাফার টাকায় নতুন কারখানা তৈরি করেন না। কাজেই, সরকারের স্লোগান যা-ই হোক না কেন, আত্মনির্ভরতা দূর অস্ত্।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement