জীবনানন্দের চৈত্রের ধানকাটা মাঠে মানুষের কোলাহল শুনলে এখনও কবিতা ভুলে মাঝে মাঝে ফিরে যাই অনেক বছর পেরিয়ে। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭১-এর মার্চ মাসে, এক বসন্তে পূর্ববঙ্গ লাল হয়ে উঠেছিল— কৃষ্ণচূড়া বা পলাশে নয়— মানুষের রক্তে।
কলকাতা থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বহু দল যাচ্ছিল বর্ডারে, বর্ডার পেরিয়েও। তেমনই একটি দলের সঙ্গে আমি ও আমার ভাই পৌঁছে গেলাম পূর্ব পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব, স্থির করে ফেলেছিলাম। কিন্তু, ঘটনাক্রমে তা আর হয়নি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম, কিন্তু ফিরে আসার আগেই দেখতে পেলাম, যশোর রোড, চৈত্রের ধানকাটা মাঠের মধ্য দিয়ে ভারতের দিকে পা চালিয়েছে শয়ে শয়ে মানুষ। বুড়ো, বাচ্চা, মেয়েরা— হাতে কাঁধে মাথায় যে যতটুকু পেরেছে, সংসারের জিনিস নিয়ে চলেছে। সেই উদ্বাস্তু স্রোতের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমরাও ফিরলাম।
সেই মাথায় বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে শঙ্কিত মানুষের পদযাত্রা আজও মনে আছে। সে দিনের উদ্বাস্তু মিছিল কিছু দিনের মধ্যেই রূপান্তরিত হল উদ্বাস্তুর বন্যায়। সংখ্যাটা দাঁড়াল লক্ষে লক্ষে। যে কোনও দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে উপদ্রুত অঞ্চল থেকে সাধারণ নাগরিকদের পালানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের এই গৃহযুদ্ধে কারা পালিয়েছিলেন? ভারত সরকারের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি ক্যাম্পে ছিলেন ৬৭,৯৭,৬১৫ জন ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থায় ছিলেন ৩১,০১,৬৬০ জন— অর্থাৎ মোট ৯৮,৯৯,২৭৫ জন। এর মধ্যে ৯২.৭% ছিলেন হিন্দু, ৯১,৭৬,৬২৭ জন। যুদ্ধের পরে এঁরা প্রায় সবাই ফিরে যান। ১৯৭৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫%, মোটামুটি ৯৬,৭৩,০০০ জন। অর্থাৎ, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯৫ শতাংশ মানুষ দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কেন? কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার ও গণহত্যা সংঘটিত হলে একটি সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়, তা কি আমরা মনে রেখেছি?
এ সব ঘটার কারণ ছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল। সেটাই ছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ভারতে ইতিমধ্যে চারটি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, এবং পঞ্চমটি হওয়ার অপেক্ষায়। এই নির্বাচনে পাকিস্তানি সংসদের মোট আসন ছিল ৩০০টি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পূর্ব পাকিস্তানে ১৬০টি ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪০টি। নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পেয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানে ১৫৮টি আসন। অর্থাৎ, একক ক্ষমতায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিব এবং সরকার গড়বে আওয়ামী লীগ। অবশ্যই তা পছন্দের নয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শাসনক্ষমতায় থাকা সামরিক বাহিনীর এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দল জুলফিকর আলি ভুট্টোর পিপিপি-র। সুতরাং, কী ভাবে আওয়ামী লীগকে বাগে আনা যায়, তারা সেই চেষ্টা চালাল কিছু দিন; এবং তা না পেরে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ, গণহত্যা এবং হিন্দু বিতাড়ন।
কিন্তু এই নির্বাচনী জয়ে ভোট দেওয়া ছাড়া হিন্দুদের ভূমিকা তেমন কিছুই ছিল না। ১৯৭১ সালে হিন্দুরা ছিলেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে কোনও বড় হিন্দু নেতা ছিলেন না। তা ছাড়া লীগের বিখ্যাত ছয় দফা নির্বাচনী দাবির মধ্যেও হিন্দুগন্ধী বা ইসলাম-বিরোধী কিছু ছিল না। ছিল না বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত কোনও দাবি। খুব সংক্ষেপে এই ছয় দফা দাবি ছিল— পাকিস্তান হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র, কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্কের দায়িত্ব; মূলধন পাচার ঠেকাতে দেশের দুই অংশের জন্য পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা; কর ও সম্পদ আহরণের দায়িত্ব প্রদেশগুলির; বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য দু’টি অংশের আলাদা অ্যাকাউন্ট; এবং, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটা আলাদা সামরিক বাহিনী। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসার আক্রমণ আওয়ামী লীগের উপর কিছুটা এলেও পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার প্রায় পুরোটাই নেমে এল হিন্দুদের উপর। কেন?
পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের উপর আক্রমণ, অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ ও চরম বৈষম্য— সবই চলছিল এক সঙ্গে। একই সঙ্গে ছিল ভারত সরকারের ও পশ্চিমবঙ্গের নির্লিপ্ততা, ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি থেকে ১৯৭০— এই ২৩ বছরে ১৯৫১-র ২২% হিন্দু ১৯৭০-এ নেমে এসেছিল প্রায় ১৫%-এ। কিন্তু ১৯৭০-এর নির্বাচন দেখিয়ে দিল, জনসংখ্যার কিছু আধিক্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় সংসদে বেশি আসন থেকে যাচ্ছে এবং তার সুফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সমস্যার আশু সমাধান: হিন্দু বিতাড়নের কাজটিকে দ্রুত সম্পূর্ণ করে পূর্ব পশ্চিমের জনসংখ্যার বৈষম্যকে দূর করা। তা করার একটি পথ যথেচ্ছ গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় স্থান ধ্বংস, সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ধ্বংস, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা— এই সবকেই এক কথায় রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞায় বলা হয় গণহত্যা বা জেনোসাইড। এই কাজটিই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় সম্পন্ন করে ফেলে কয়েক মাসের মধ্যেই।
কিন্তু কেবল সংসদের আসনসংখ্যা নয়, পাকিস্তানি সেনা প্রতিষ্ঠানটির দৃঢ় ধারণা ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধারাটি এখনও হিন্দুদের ভাবধারায় চলে। এ বিষয়ে পাকিস্তান ঘুরে এসে লেখা ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের দু’টি বই সেই সব পাকিস্তানী (১৯৯৯) ও পাকিস্তানী জেনারেলদের মন (২০১০) পাঠক দেখতে পারেন। দ্বিতীয় বইটির ভূমিকায় মামুন পাকিস্তানি মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের লেখা বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন— “পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সঙ্কটের বীজটি বপন করেছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধ্যাপক ও শিক্ষকেরা, যা ভাল ফসল ফলিয়েছে। চব্বিশ বছরে ক্রমাগত ভারতীয় প্রচারের সঙ্গে যে ধরনের শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে তা পূর্ব পাকিস্তানিদের বাঙালিতে পরিবর্তিত করেছে।” (অনুবাদ এই লেখকের)। তার পর মামুন বলেছেন যে, “অধিকাংশ পাকিস্তানি এ তত্ত্বে বিশ্বাস করে।” সুতরাং, হিন্দু প্রভাব দূর করতে প্রয়োজন গণহত্যা বা জেনোসাইড।
গণহত্যার বিবরণে যাব না, সে আর এক মহাভারত। ঢাকার গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভের প্রায় একশোটি পুস্তক রয়েছে প্রতিটি গণহত্যার বিবরণ দিয়ে। প্রথম রাতে ২৬ মার্চেই ঢাকার শাঁখারীপাড়ায় গণহত্যা হল শতাধিক, চলল দিনের পর দিন, ২০ মে খুলনার চুকনগরে ভরদুপুরে খানসেনারা হত্যা করল কয়েক হাজার হিন্দুকে। এই ভাবে গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। একটি সম্প্রদায়কে শেষ করতে বেছে বেছে হত্যা করা হল তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের— ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রণদাপ্রসাদ সাহা, নূতন চন্দ্র সিংহদের। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র অনিল বাগচীর একদিন এই সময়ের এক প্রায় নীরব কবিতা। এই দুর্যোগের মধ্যে তরুণ অনিল বাগচী বাসে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে বোনের খোঁজে। সে জানে বাসসুদ্ধ লোকের মধ্যে সে একমাত্র হিন্দু এবং এই পরিচয় পেলেই পাকিস্তানি সেনারা তাকে মেরে ফেলবে। তাই হল। এই হচ্ছে জেনোসাইড।
লেখক-গবেষক সালাম আজাদের ভাষায়, “আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায়— ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হিন্দু নরনারী ও শিশুদের উপর পাকিস্তানিদের বর্বরতা।” পথিকবর, চৈত্রের পলাশ বা কৃষ্ণচূড়া দেখলে দাঁড়িয়ো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনে মনে করো সেই সব গণহত্যার শিকার যাঁরা, তাঁদের কথা। যাঁরা ইতিহাস ভুলে যায়, সেই ইতিহাস আবার তাঁদের কাছে ফিরে আসে।