loneliness

নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ মন্ত্রক

একা মানুষদের ফোন নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, যে কোনও সমস্যায় স্রেফ গল্প করতেও ফোন করতে পারেন।

Advertisement

বুবুন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২১ ০৪:৪৮
Share:

একা মানুষদের জন্য পূর্ণ মন্ত্রক। যে কোনও বয়সের একা মানুষের অসুবিধা, সমস্যা, চাহিদা শোনা হয়। ব্যবস্থা করা হয়। যাতে তিনি আরও কিছু দিন বাঁচার মতো বাঁচেন। নিঃসঙ্গতায় দগ্ধ হয়ে শেষ না হয়ে যান। বছর চারেক আগে ব্রিটিশ সরকার ‘জো কক্স’ কমিশনকে এ রকম একটি সরকারি মন্ত্রক করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-র তত্ত্বাবধানে মন্ত্রকের সূচনা। মে উপলব্ধি করেন দেশে অধিকাংশের খাওয়া-পরা-থাকার অসুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনে কাঁধে হাত রাখার মতো মানুষ। সমীক্ষা জানিয়েছে, পাঁচ জনে অন্তত এক জন নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। হয়তো দীর্ঘ এক মাস কেউ চলচ্ছক্তিহীন বা অংশত সচল। ঘরবন্দি। তাঁকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। অথবা তিনি স্বেচ্ছাবন্দি। মাসাধিককাল ফোনে কথা বলেননি। মানুষের মুখ দেখেননি। আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। অধিকাংশই অবসাদে বা মনোবৈকল্যে আকুল। মানসিক স্বাস্থ্য চুরমার। তার থেকে ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন, স্থূলতা, অ্যালঝাইমার্সের মতো হাজারটা রোগ। স্ট্রোক বা অনতিবিলম্বে স্ট্রোকের আশঙ্কাও রয়েছে। জো কক্স কমিশন আগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করেছে। দেখেছে সারা দেশ জুড়ে নিঃসঙ্গতার সামাজিক ব্যাধি অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। প্রয়োজন সহৃদয়তা। কারণ, মনের অসুখ ওষুধের চেয়ে মানুষের স্পর্শেই বেশি সারে।

Advertisement

জো কক্স ছিলেন লেবার পার্টির মন্ত্রী। ২০১৬-র জুনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সংক্রান্ত গণভোট প্রস্তাব পেশ করতে যাওয়ার সময় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের হাতে খুন হন। কক্সের অর্ধসমাপ্ত কাজ চালু রাখতে মে ’১৭-য় ব্রিটেনে নিঃসঙ্গতা মন্ত্রকের উদ্ঘাটন করেন। ক্রীড়ামন্ত্রী ট্রেসি ক্রাউচ দফতরের ভার পান।

ব্রিটেনের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স বোর্ড একটি অত্যাধুনিক যন্ত্রের সহায়তায় নির্বান্ধব মানুষের নিঃসঙ্গতাকে পরিমাপ করতে পারে। দেখা গিয়েছে, পঁচাত্তর-ঊর্ধ্বদের মধ্যে ২০ লক্ষই একা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার মতো বন্ধু-বান্ধব, পরিজন নেই। মাসের পর মাস তাঁদের হয়তো শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলে দিন কাটে। নিঃসঙ্গতা কতটা গ্রাস করেছে— গবেষণা করে তিনটি মৌলিক প্রশ্নকে ব্রিটিশ সরকার মান্যতা দিয়েছে। একে ইউসিএলএ স্কেল বলা হয়। প্রশ্নগুলি হল— দিনে কত বার মনে হয় আপনি সঙ্গীহীন? ক’বার মনে হয়, কেউ আপনাকে চায় না এবং আপনি সমাজ, পরিবার-পরিজন থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন? কত বার মনে হয় যে আপনি বিচ্ছিন্ন? এই প্রশ্নমালার পাশাপাশি বয়স, লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিক অবস্থানও বিচার্য। উত্তরগুলি থেকে কে কতটা একা, কতটা সমাজ-বিচ্ছিন্ন বোঝা যায়। হয়তো প্রত্যেকটি দিন কারও একই ভাবে একই নিষ্ফলা কাজ দিয়ে শুরু হয়। কেউ বা শখের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট। অনেকটা সময় একা কাটান। তাঁর সার্বিক বুদ্ধিমত্তা কোথায় দাঁড়িয়ে, দেখা হয়। এমন কিছু লক্ষণের উপর নিঃসঙ্গতার মাত্রা নির্ভর করে।

Advertisement

সমীক্ষাটি করোনা-পূর্ব। করোনা, লকডাউন, কাজ হারানোর পরে এই তালিকা দীর্ঘতর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের চাপ বেড়েছে। শিশু থেকে প্রবীণ, সব বয়সেই মানসিক স্বাস্থ্য করোনাকালে কোনও না কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সামাজিক ভ্রষ্টাচার, বিকল রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ মানুষকে দুমড়েমুচড়ে একা, বিষণ্ণ করে দেয়। করোনা কাজটি সুচারু ভাবে করে দিয়েছে। আকস্মিক অতিমারি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছে, বিনাযুদ্ধেও মানুষের সমাজ, মন ভেঙে দেওয়া যায়। দেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাভেদে সমস্যা কমবেশি হলেও মানব মনের পঙ্গুত্বের ছবিটি সর্বত্রই স্পষ্ট।

২০১৬ থেকে লেবার পার্টির রেচেল রিভস এবং কনজ়ারভেটিভ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী সীমা কেনেডি একাকী মানুষের পাশে থেকে নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। সঙ্গে আছে ১৩টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সাহায্যপ্রার্থীর তালিকায় বহু নবদম্পতি, যুবক-যুবতী, শরণার্থী। কর্মযজ্ঞে শামিল অনেকে। লন্ডনের বিশেষ বিশেষ এলাকায় পত্রবাহকদের বলা হয়েছে চিঠি দিতে গিয়ে নির্দিষ্ট মানুষটির সঙ্গে দুটো কথা বলে হালহকিকত জেনে আসতে। যদি মনে হয় তিনি অনেক দিন ধরে দুঃসহ নির্জনতায় আক্রান্ত, তবে সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানাতে হবে। একা মানুষদের ফোন নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, যে কোনও সমস্যায় স্রেফ গল্প করতেও ফোন করতে পারেন। জানবেন, টেলিফোনের ও পারে ২৪ ঘণ্টা কেউ না কেউ আপনার ফোনের অপেক্ষা করছেন। প্রতিটি প্রদেশে সেলাই, রান্না, হালকা খেলাধুলোর মতো উদ্দীপনামূলক ক্লাসের আয়োজন হয়েছে বিনামূল্যে। সমাজমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৪ থেকে ১৮ জুন নিঃসঙ্গতার সপ্তাহ পালিত হল। যাঁরা সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না, বাইরে বেরোতে পারছেন না, তাঁদের এই সপ্তাহ জুড়ে সঙ্গ দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার, নার্স, সেবাপ্রদানকারী, সমাজসেবী সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— সাহায্যে সবাই এগিয়ে এসেছেন বছরভর। নিঃসঙ্গতা দফতরের মন্ত্রী ব্যারনেস ব্যারান বলেছেন, লড়তে হবে অনেক দিন। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক রং ব্যতিরেকেই একাকী, নির্বান্ধব মানুষকে পরস্পরের হাত ধরার আশ্রয়টুকু দেওয়া।

অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো অনেক দেশই বহু দিন এই পথের যাত্রী। দেখা যাক, অতিমারির ঝড় সামলেও সভ্যতা ও আধুনিকতার এই সঙ্কটকে ব্রিটেন কাটিয়ে উঠতে পারে কি না, আর আমরা কিছু শিখতে পারি না কি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement