নিজের জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তাঁরা। সেই পাকা ধান চোখের সামনেই কিছু লাঠিসোঁটাধারী লোক এসে কেটে নিয়ে গেল। যাঁরা প্রতিবাদ করলেন তাঁদের কারও মাথা ফাটল, কারও বা হাত-পা। সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন-ঘেঁষা অঞ্চলে একের পর এক ভেড়ির মাছ লুট হয়ে গেল, তাঁরা অসহায় চেয়ে দেখলেন। কারণ তাঁরা দেখেছেন, প্রতিবাদ করতে গেলে মারধর, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেওয়া, এমনকি মেয়েদের যৌন নির্যাতনও সইতে হতে পারে। দোকানে খদ্দের সামলাচ্ছিলেন এক জন, হানাদাররা ঢুকে সজোরে বুকে লাথি কষায়। তার পর মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারধর, সঙ্গে লুটপাট, সবই অবাধে, প্রকাশ্যে। অন্য এক ব্যবসায়ীর বাড়ি ঢুকে ভাঙচুর, বেদি থেকে দেববিগ্রহ নামিয়ে ভাঙা, বাড়ির পুরুষদের প্রহার ও মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে চলে গেছে এক দল মানুষ।
শিক্ষক ও সরকারি পদাধিকারীদের কাছ থেকে বলপূর্বক পদত্যাগপত্র আদায়, অন্যথায় বেধড়ক মার, জুতোর মালা পরিয়ে পাড়া ঘোরানোর মতো চরম অবমাননাকর ঘটনাও ঘটেছে একাধিক স্থানে। নিরাপত্তা চাইতে গেলে মিলছে না, উপরন্তু পড়তে হচ্ছে বিপদে। সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে পুলিশ আক্রান্তদের ধরে গারদে পুরে দিচ্ছে, মামলাও রুজু করছে তাঁদের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক কারণেই জনগোষ্ঠীর একাংশ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ রেখেও সব সময় মিলছে না রেহাই। অথচ তাঁরা সেই দেশেই জন্মেছেন, নাগরিক হিসেবে বংশানুক্রমে বাস করছেন সেই দেশেই। সবাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, কোনও রাজনৈতিক কাজিয়া বা ধর্মবিরোধিতায় নেই। তাঁদের একটাই ‘অপরাধ’, ধর্মপরিচয়ে তাঁরা সংখ্যালঘু।
এই সবই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশের খণ্ডচিত্র। শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে সে দেশের বাসিন্দা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ দিন কাটাচ্ছেন ভয়ে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে শেখ হাসিনা বা তাঁর আগের শাসকদের আমলে সে দেশে সংখ্যালঘুরা খুব নিরাপদে ছিলেন। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর সৃষ্টি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই সেখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ধারাবাহিক ভাবে নিপীড়নের শিকার। বলপূর্বক সম্পত্তি দখল থেকে শুরু করে গবাদি পশু লুট, নারী নির্যাতন, পরিকল্পিত ভাবে ধর্মান্তরণ— নানা ভাবে বহু বার তাঁদের অপদস্থ করার প্রচেষ্টা হয়েছে। প্রাণ-সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে দলে দলে তাঁরা ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তখন থেকেই।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই যুদ্ধ শেষে অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বটে, তবে তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ক্রমবর্ধমান কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের দাপটের কাছে নতি স্বীকার বা আপস করা শাসকেরা একের পর এক এমন সব সাংবিধানিক সংস্কার ও আইন প্রবর্তন করেছেন, যার ফলে সংখ্যালঘুরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত। সংখ্যালঘুদের উপর ঘটে চলা অত্যাচারে সামাজিক নীরবতাও একটা বড় সত্য, ফলে অ-মুসলমান জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে হিন্দুদের অবৈধ ভাবে ভারতে প্রবেশের ধারা কখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
তার পরেও সুযোগ ও সাহসের অভাবে বা জন্মভূমির প্রতি টানে যাঁরা সে দেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা আজ নিজভূমে পরবাসী। দেশভাগের সাতাত্তর বছর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাহান্ন বছর পরেও সেখানে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ তো কমেইনি, বরং মৌলবাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সমানুপাতে বেড়েছে নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন। সম্প্রতি এরই প্রতিবাদে ‘সনাতনী হিন্দু’ সমাজের প্রতিবাদের পরিণতিতে ইস্কনের এক সন্ন্যাসী-সহ একাধিক সন্ন্যাসী রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এঁদের পক্ষে আদালতে সওয়াল করা আইনজীবীদের অনেকে প্রহৃত, কারও বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। বিক্ষোভরত বিরোধী আইনজীবীদের বাধাদান ও প্রাণের হুমকির কারণে আদালতে আইনজীবীরা দাঁড়াতে পারেননি।
এই পরিস্থিতিতে আশঙ্কা এটাই— আগামী দিনে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা যে রাজনৈতিক দলের হাতেই যাক, চিন ও পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট কট্টরপন্থীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতায়নে সে দেশের সংখ্যালঘুদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিবৃতি দেওয়া ছাড়া প্রকৃত সদর্থক পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। পাছে ভারতের সংখ্যালঘুরা রুষ্ট হন, তাই কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ছাড়া এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ হয় নীরব, নয়তো বিবৃতি দিয়ে দায় সারতে ব্যস্ত। ভারতের মানবাধিকার সংগঠন, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, এমনকি কিছু দিন আগেও আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে শামিল নাগরিক সমাজকেও উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এই ঘটনা নিয়ে আশা-সঞ্চারী প্রতিক্রিয়া মেলেনি। ভারত বিপুল জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ। সীমান্তে কড়াকড়ি। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এ সর্বশেষ ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের পরে আসা মানুষদের এ দেশে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ভবিতব্য তবে কী?