এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!...’ তৃণমূল কংগ্রেসের দুই শতাধিক আসনের পাশে ভারতীয় জনতা পার্টির আসন আশি ছাড়াল না; আর বাম, কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকির আইএসএফ-এর সংযুক্ত মোর্চার মাত্র এক!
বাংলার ভোটে এ বার বিপুল ভাবে কে জিতলেন, এ প্রশ্নের সর্বসম্মত উত্তর যদি হয় ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’, তবে মমতা কেন নন্দীগ্রামে শেষ গণনা অনুযায়ী ১৯৫৩ ভোটে হারলেন, এই প্রশ্নও ওঠা স্বাভাবিক। তবে কি ভবানীপুরের নিরাপদ আসন ছেড়ে ‘আবেগের বশে’ নন্দীগ্রামে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে গলদ ছিল? নন্দীগ্রামে দাঁড়ালেও তিনি তো ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যেমনটা একই সঙ্গে গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশে দাঁড়িয়েছিলেন, সে রকম নন্দীগ্রামের পাশাপাশি ভবানীপুরে দাঁড়াতে পারতেন। হয়তো পারতেন, কিন্তু তাতে তাঁর একদা বিশ্বস্ত সেনাপতি, পূর্ব মেদিনীপুরের সবচেয়ে বড় নেতা তথা নন্দীগ্রামের বিধায়ক, শুভেন্দু অধিকারী দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়ে যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তুলতে পারতেন না— ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’, তা করতে পারতেন না— এবং সেই সূত্রে পূর্ব মেদিনীপুর (১৬ আসন), পশ্চিম মেদিনীপুর (১৫ আসন) তথা ঝাড়গ্রামের (৪ আসন), অর্থাৎ সম্মিলিত ভাবে পূর্বতন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ৩৫টি আসনের অন্যগুলিকে সে ভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারতেন না। যার জেরে, নন্দীগ্রামে জিতলেও, সমগ্র মেদিনীপুরের ‘অবিসংবাদী’ নেতা হিসেবে খ্যাত, শুভেন্দু অধিকারীর সদম্ভ ঘোষণা— ‘অবিভক্ত মেদিনীপুরে ৩৫টাতে ৩৫টাই পাব’— আজ এক ফাঁপা ঠাট্টার মতো কানে বাজত না! নন্দীগ্রাম বাদ দিয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুরে আজ তৃণমূল কংগ্রেস যখন ৩০,তখন বিজেপি থমকে কেবল ৫-এ!
কিন্তু নন্দীগ্রামে সামান্য ব্যবধানে পরাজয় সত্ত্বেও বাংলা তথা ভারতের মানুষ যে মমতাকেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের অদ্বিতীয় কান্ডারি মনে করে, তাতেও সন্দেহ নেই। জয়-পরাজয়ের পিছনে বহুমাত্রিক, বস্তুগত অনেক উপাদান থাকে সত্যি, কিন্তু এই মিডিয়া-সর্বস্বতার যুগে, যে কোনও লড়াইয়ের ক্ষেত্রেই আমরা বহুবিধ দ্বন্দ্বগুলি— সাফল্য-বিফলতা— জড়ো করি পক্ষ ও প্রতিপক্ষের প্রধান দু’টি ‘মুখ’-এর পিছনে। যেমন, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতিস্পর্ধী আক্রমণের কৃতিত্ব ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী (রীতিমতো সেনার পোশাকে অবতীর্ণ হয়ে) দাবি করেছিলেন, এবং সেই মতো জনসমর্থন পেয়ে সব বিরোধীদের কার্যত কাত করে দিয়েছিলেন। একই ভাবে এ বার বাংলায় জয়ের কান্ডারি যদি ব্যক্তি হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হন, তবে পরাজিত পক্ষের ‘প্রধান’ মুখটি কে? এই প্রশ্নে অবশ্য পরাজিত পক্ষ, অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গীয় শাখার কোনও নেতা-নেত্রীকে বিব্রত হতে হবে না, কারণ, তাঁরা কেউই একক ভাবে মমতা-বিরোধী ‘প্রধান মুখ’-এর স্বীকৃতি পাননি। মমতার বিরুদ্ধে এই অভূতপূর্ব সংগ্রামে বিজেপি-কে যিনি ‘সামনে থেকে’ নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, যাঁর সরকারের কৃতিত্ব, নীতির জয়গানে বিজেপির সর্বস্তরের মানুষ একজোট হয়েছিলেন, যাঁর কণ্ঠে ‘দিদি-ই-ই-ই ও দিদি-ই-ই’ ডাকে উপস্থিত ‘ভক্তকুল’ আমোদে ফেটে পড়তেন— দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা অধুনা বিজেপির সেই সর্বশক্তিমান নেতা, নরেন্দ্র মোদীকেই এই হারের দায়ভাগও নিতে হবে। সোজা বাংলায়, এ বারের লড়াইটা অনেক কিছুর পাশাপাশি ছিল ‘দিদি বনাম মোদী’-র লড়াই। এবং তাতে (‘মুখ’ হিসেবে) দিদি জিতেছেন, মোদী হেরেছেন।
কী না করেছেন মোদী ‘বাংলা দখল’ করার ব্রত নিয়ে! নেহরু থেকে শাস্ত্রী, ইন্দিরা থেকে রাজীব গাঁধী, নরসিংহ রাও থেকে বাজপেয়ী অবধি জননেতা প্রধানমন্ত্রীরা (মনমোহন সিংহের কথা ছেড়ে দিলাম, পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও সুবক্তা নন বলে) সবাই মিলে বাংলায় লোকসভা ও বিধানসভায় যতগুলি ভোট-সভা করেছেন, মোদী একাই সেই সম্মিলিত রেকর্ড প্রায় ভেঙে দিয়েছেন! সঙ্গে প্রায় একই সংখ্যক সভা করেছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এ ছাড়াও ছিলেন নানা মাপের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির (বিশেষত উত্তরপ্রদেশের) মুখ্যমন্ত্রী প্রমুখ ‘হেভিওয়েট’ নেতৃবর্গ। পাশে ছিল আট দফার বিচিত্ররূপী ভোট মানচিত্র— এমনই কিম্ভূত কিমাকার যে, মনে হয় পশ্চিমবঙ্গ একটা মানুষের শরীর হলে, যেন তার কানের সঙ্গে পায়ের কড়ে আঙুল জুড়ে দেওয়া হয়েছে— ধরুন যে দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অংশে ভোট হচ্ছে, তারই সঙ্গে ভোট হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোনও জায়গায়! এর সঙ্গে ছিল বিপুল সংখ্যায় আধা-সেনার টহল এবং অনেক জায়গায় ‘বাড়াবাড়ি’, যার সবচেয়ে নৃশংস বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কোচবিহারের শীতলখুচিতে।
চতুর্থ দফায় এই শীতলখুচি কাণ্ডে সাধারণ মানুষ, বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিমদের মনে মনে ত্রস্ত করেছে। এবং কাকতালীয় হলেও নির্বাচনী নির্ঘণ্টের এমনই মহিমা যে, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অনেকগুলি অঞ্চলেই— উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের সব ক’টি, তথা উত্তর চব্বিশ পরগনার বেশ কয়েকটি আসনে— নির্বাচন তখনও বাকি। ফলাফল বেরোতে দেখা গেল, মালদহ-মুর্শিদাবাদে প্রয়াত গণি খান চৌধুরী ও অধুনা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সব ‘মিথ’ ধুলোয় মিশিয়ে এই দুই পরম্পরাগত কংগ্রেস গড়ে তাদের ভাঁড়ার খালি করে দিয়ে সব আসন তৃণমূলের ঝুলিতে, সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলে, যেখানে চতুর্থ দফার পরে ভোট হয়েছে, তার অধিকাংশ আসনই মমতার পক্ষে গিয়েছে! করোনায় দুই প্রার্থীর দুঃখজনক মৃত্যু হওয়ায় মুর্শিদাবাদে দু’টি আসনে নির্বাচন ১৬ তারিখে হবে। তার ফল যে কী হবে, তা জানতে জ্যোতিষবিদ্যার প্রয়োজন নেই!
এর সঙ্গে চতুর্থ দফার পরে যুক্ত হয়েছে আরও একটি উপাদান— অতিমারির আতঙ্ক। আট দফার ভোটে সারা রাজ্যের নানা জায়গায় প্রভূত বড়-মেজো সভা এবং ভোটকর্মী তথা নিরাপত্তারক্ষীদের অবাধ চলাচলে যখন করোনার গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী, যখন সারা দেশের সঙ্গে বাংলার চিকিৎসককুল ‘কাকস্য পরিদেবনা’ হলেও উচ্চকণ্ঠে সতর্ক করছেন জনগণকে, সংক্রমণ না-ছড়ানোর জন্য আবেদন করছেন নেতা-নেত্রীদের, যখন কলকাতা-মাদ্রাজের শীর্ষ আদালত নির্বাচন কমিশনকে প্রায় তুলোধুনা করছে— সেই আবহে, বিশেষত বড় শহর ও শহরতলির মানুষও যে প্রভূত শঙ্কা ও ক্ষোভ নিয়ে ভোট দিয়েছেন, তাতে সন্দেহ কী! শেষ তিন দফায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আতঙ্ক— মৃত্যুমিছিল সামনে দেখেও ভ্যাকসিন, অক্সিজেন ও হাসপাতালে ‘বেড’-এর জন্য হাহাকার, এবং পাশাপাশি বয়ে এসেছে দিল্লি-সহ নানা রাজ্যের আরও দুর্গতির ক্রমাগত সংবাদ। তার স্বাভাবিক প্রতিফলন হয়েছে কলকাতায় বিজেপির বিপক্ষে ১১-০ ফলাফলে। কলকাতা ঘেঁষা দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়া মহানগরীতেও তারই ছাপ।
এর পাশাপাশি বলতে হয়, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির অঞ্চলগুলি— অর্থাৎ, জঙ্গলমহলের ৪০টি আসন ও উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসন, আর উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ার মতুয়া সম্প্রদায় প্রভাবিত জায়গাগুলির কথা। এর সঙ্গে, শুভেন্দুর দলত্যাগের ফলে পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি আসন মিলে প্রায় ১২০টির মতো আসন। ভোটে দেখা গেল, একমাত্র কিছুটা নদিয়া ছাড়া বিজেপি কোথাও তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি। অথচ, তৃণমূল তার ভরকেন্দ্র— কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়ায়— শক্তি ধরে রেখেছে। এর সঙ্গে এ বারের নির্বাচনে অন্য অনেকগুলি সিরিয়াস বিষয় ছিল। মমতার নানা জনবাদী প্রকল্প ও নীতি রাজ্যের মহিলাদের বিপুল সমর্থন জুগিয়েছে। সঙ্গে বিজেপির বাদ সেধেছে আদি বনাম নব্যদের দ্বন্দ্ব, এবং ‘অভিযুক্ত’-নব্যদের নিয়ে জনমনে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্ন। মমতা তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বাংলার সংস্কৃতির ‘বহিরাগত’ তথা রাজ্যের স্বাভিমান রক্ষার বিষয়টি। অন্য দিকে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও মোদী এবং শাহ বার বার ‘ভাইপো’ ‘ভাইপো’ বলে প্রায় জাতীয় স্তরের নেতা বানিয়ে দিয়েছেন।
তবে, নন্দীগ্রামে হেরে গেলেও (এ নিয়ে কোর্ট-কাছারি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না) মমতাই যে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা বলা বাহুল্য। ছ’মাসের মধ্যে অন্য কোনও আসন থেকে জিতে আসার সময় পাবেন। এর পরে তাঁর গতিবিধি এ রাজ্যেই থেমে থাকবে না নিশ্চিত— বিভিন্ন অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে একটি ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ফ্রন্ট’ গড়ে তোলার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করবেন, মনে হয়। তবে, এই ভোটের ফল আরও এক জনকে প্রশ্নাতীত বিজয়ী ঘোষণা করল— তিনি তৃণমূলের ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর। বিজেপি একশো পেলে, যিনি তাঁর পেশা ছেড়ে দেওয়ার ‘পণ’ করেছিলেন। বিজেপি ‘৭১’-এ থেমে যাওয়ায় এ ব্যাপারে তাঁর নৈতিক দায় রইল না। অবশ্য, তিনি গাওস্করের মতো ফর্মে থাকতেই খেলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত করছেন, সেটা ভিন্ন কথা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়