India Politics

‘ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন’

সিপিএম নেতারা একই সঙ্গে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে মাঠে নেমেছিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে তৃণমূলকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে আক্রমণ করেছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

সুচনা: ওড়িশার নতুন মুখ্য়মন্ত্রী মোহন মাঝি ও রাজ্যপাল রঘুনাথ বরের সঙ্গে রাজনাথ সিংহ, ধর্মেন্দ্র প্রধান অশ্বিনী বৈষ্ণব প্রমুখ। ছবি পিটিআই।

হয় তুমি বিজেপির সঙ্গে, না হলে বিজেপির বিরুদ্ধে। এর মাঝামাঝি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থানে থাকার অনিবার্য ফল হল, রাজনৈতিক অস্তিত্বের সঙ্কট। এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলির জন্য এটাই বৃহত্তম শিক্ষা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতাদের জন্যও।

Advertisement

দেশের রাজনীতিতে বিজেপি এখনও সবচেয়ে বড় শক্তি। কোনও দলকে হয় বিজেপির জোটে থাকতে হবে, অথবা বিজেপিকে প্রধান শত্রু ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হবে। সে পথে হেঁটেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটে নিজের আসন বাড়িয়েছেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, এ বারের ভোটের লড়াইটা বিজেপি বনাম বিজেপি-বিরোধী শক্তির। তাই পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় না গেলেও তিনি নিজেকে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যের প্রধান শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।

অন্য দিকে, সিপিএম নেতারা একই সঙ্গে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে মাঠে নেমেছিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে তৃণমূলকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে আক্রমণ করেছিলেন। এটা যে বিধানসভা ভোট নয়, লোকসভা নির্বাচন, সেটাই গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তাই ৩৪ বছরের বাম দুর্গে সিপিএমের ফল এ বারও শূন্য।একই দশা ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী, তেলঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও, হরিয়ানার দুষ্যন্ত চৌটালাদের। লোকসভা ভোটে তাঁদের জেতা আসনের সংখ্যাও শূন্য। তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে যাননি। আবার বিজেপির জোটেও ছিলেন না। এর মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলেন। ‘ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন’ তাঁদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।

Advertisement

ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন! দেশের রাজনৈতিক অভিধানে নতুন শব্দ। কথাটা প্রথম শোনা এ বারের লোকসভা নির্বাচনের মরসুমে তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইতে গিয়ে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পুত্রহারা ধৃতরাষ্ট্র ভীমকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলেন। আসল অভিপ্রায় ছিল, ভীমকে বুকের মধ্যে পিষে মারা। কৃষ্ণ তা বুঝতে পেরে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে লোহার ভীম এগিয়ে দেন। দুর্যোধন-দুঃশাসনের হত্যার রাগে ধৃতরাষ্ট্র সেই লোহার ভীমই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ কাহিনি সকলেরই জানা। তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে-র নেতারা ‘ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন বিজেপির সঙ্গে জোটের ফল বোঝাতে। জয়ললিতার দলের নেতাদের যুক্তি ছিল, বিজেপি প্রথমে কোনও রাজ্যে মাথা গলাবার জন্য সেখানকার আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট করে। তার পরে সেই দলেরই রাজনৈতিক জমি দখল করে ফেলতে চায়। সেই ছোট দলকে তিমি মাছের মতো গিলে ফেলতে চায়। এক বার বিজেপির সঙ্গে কোলাকুলি করে ফেললে আর মুক্তি নেই। তার পরে আপনি জোট ভেঙে বেরিয়ে গেলে, বিজেপি আপনার দলেই ভাঙন ধরাবে। অর্থ, ক্ষমতার লোভ বা ভয় দেখিয়ে আপনার দলের নেতাদের নিজের দিকে টেনে নেবে। দীর্ঘ দিন ধরে তামিলনাড়ুতে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াইয়ের পরে এআইএডিএমকে নেতারা সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন। আর সে কারণেই এ বারের লোকসভা ভোটে তাঁরা একা লড়েছিলেন।

কিন্তু শেষরক্ষা হল না। লোকসভা ভোটে এআইএডিএমকে খালি হাতেই ফিরেছে। এমজি রামচন্দ্রন-জয়ললিতার উত্তরাধিকারীরা একটি আসনও জিততে পারেননি। শুধু এআইএডিএমকে নয়, এ বারের লোকসভা ভোটে পাঁচটি আঞ্চলিক দল শূন্য হাতে ফিরেছে। এআইএডিএমকে ছাড়া সেই তালিকায় রয়েছে নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্র সমিতি, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি এবং হরিয়ানার দুষ্যন্ত চৌটালার জননায়ক জনতা পার্টি।

নবীনের দল শুধু যে লোকসভায় শূন্য পেয়েছে তা-ই নয়, ওড়িশার বিধানসভা ভোটে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর গদিও গিয়েছে। কে চন্দ্রশেখর রাও এই সে দিন পর্যন্ত তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এঁরা কেউই বিজেপির সঙ্গে জোট করেননি। কিন্তু বিজেপি-বিরোধী দলগুলির ‘ইন্ডিয়া’ জোটেও যোগ দেননি। উল্টে ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থানে থেকে গিয়েছেন। নবীনের বিজু জনতা দল এনডিএ-র শরিক দল না হলেও গত কয়েক বছর ধরে সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে। কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি তৃতীয় ফ্রন্টের ধুয়ো তুলে বিজেপির হয়ে ইন্ডিয়া জোটে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছেন। মায়াবতী নিজে স্বীকার না করলেও বহু দিন ধরেই তাঁর দলের গায়ে ‘বিজেপির বি-টিম’-এর তকমা লেগে গিয়েছে। কারণ তিনি উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ভোট কেটে বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়ার খেলায় নেমেছেন।

তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে গত বছর পর্যন্ত বিজেপির সঙ্গে জোটে ছিল। কিন্তু এআইএডিএমকে নেতারা বুঝতে পারছিলেন, তাঁদের ঘাড়ে চেপে তামিল রাজনীতিতে পা রাখার পরে বিজেপি এখন তাঁদের দল ভাঙছে। ডিএমকে-কংগ্রেসের বিরোধী হিসেবে এআইএডিএমকে-র রাজনৈতিক জমি দখল করতে চাইছে। এর পরে জোট থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। দুষ্যন্ত চৌটালার জেজেপি হরিয়ানায় বিজেপির সঙ্গে জোট সরকারে ছিল। বিজেপি-বিরোধী হাওয়ার আঁচ থেকে বাঁচতে জোট ভেঙে বেরিয়ে যান দুষ্যন্ত। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এআইএডিএমকে, বিজেডি, বিআরএস, জেজেপি ও বিএসপি— পাঁচ দলেরই আসনসংখ্যা শূন্য।

অন্ধ্রের জগন্মোহন রেড্ডি এত দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এ বার লোকসভায় তাঁর ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা বাইশ থেকে চারে নেমে এসেছে। তাঁর ওয়াইএসআর কংগ্রেসও এত দিন বিজেপির সঙ্গে হাত মেলায়নি। কিন্তু সংসদে যাবতীয় বিতর্কিত বিষয়ে বিজেপিকে সমর্থন করে গিয়েছে। তার প্রতিদান? বিজেপি অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু নায়ডু, পবন কল্যাণদের সঙ্গে জোট করে জগন্মোহনকে গদিচ্যুত করেছে। আগামী দিনে বিজেপি ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সাংসদদের দলে টানতে চলেছে বলে দিল্লিতে গুঞ্জন। নবীন, মায়াবতী, চন্দ্রশেখর রাওরা টের পাচ্ছেন— আজ নয়তো কাল, বিজেপি তাঁদের দলকে গ্রাস করে ফেলবে। আর নীতীশ কুমার, এইচ ডি কুমারস্বামীর মতো যাঁরা এখন বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছেন, তাঁরাও একই ভবিতব্যের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ‘ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন’-ই বটে!

উল্টো দিকে, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, মহারাষ্ট্রের শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে, বিহারে আরজেডি— যে যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরাই ভাল ফল করেছেন।

এটাই বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূল ও সিপিএমের জন্য শিক্ষা। এ বারের লোকসভা ভোটে বিজেপির জাতীয় স্তরে আসন কমেছে। পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু জাতীয় স্তরে বিজেপির ভোটের হার কমলেও পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের তুলনায় বিজেপির ভোটের হার বেড়েছে। তবে ২০১৯-এর গত লোকসভা ভোটের তুলনায় কমেছে। তৃণমূলের ভোটের হার গত লোকসভা ভোটের তুলনায় বাড়লেও, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের তুলনায় কমেছে। তৃণমূল নেতৃত্ব বলতেই পারেন, লোকসভা ভোট ও বিধানসভা ভোট আলাদা খেলা। কিন্তু ভোটের হার ও বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকা— দুই মাপকাঠিতেই বিজেপি ২০২১-এর তুলনায় এ বারের লোকসভা ভোটে ভাল ফল করেছে।

এখানেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন তৃণমূলের কাছে শিক্ষণীয়। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই তৃণমূল নেতৃত্ব ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেস বাদে অন্য শরিক দলগুলির সঙ্গে আলাদা করে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। বিরোধী শিবিরের মধ্যেই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে একটি ছোট শিবির তৈরির চেষ্টা। এর ফলে তৃণমূল আসলে বিজেপির হয়ে বিরোধী জোট ভাঙতে নেমেছে কি না, সেই সংশয় তৈরি হতে পারে। তার খেসারত ২০২৬-এর ভোটে তৃণমূলকে দিতে হতে পারে।

আর গত কয়েক দশক ধরে সিপিএম নেতারা বিজেপি না কংগ্রেস, কে বড় শত্রু, তা নিয়ে বিস্তর কথা ও কাগজ খরচ করেছেন। এ বার তাঁদের ঠিক করার সময়, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের প্রধান শত্রু কে! এই ধোঁয়াশা কাটাতে না পারলে শূন্যতা থেকেও সিপিএমের মুক্তি নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement