উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়া জেলার যশোবন্তনগরের এক কুস্তির আখড়া জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বছর তেইশের যুবক মুলায়ম সিংহ যাদবের। বিধানসভা ভোটের প্রচার চলাকালীন এলাকায় আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় একের পর এক ‘চরকা দাও’ প্যাঁচ দিয়ে চলেছেন মুলায়ম। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে শূন্যে তুলে মাটিতে আছাড়! তিনি নিজেও জানতেন না, কুস্তির সেই মঞ্চ থেকে প্রতিটি আছাড়ের শব্দ আসলে রাজনীতির বৃহত্তর রঙ্গমঞ্চের দিকে কালের যাত্রার ধ্বনি। কুস্তির প্রতিটি প্যাঁচ এর পর দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের উপরে বিভিন্ন কৌশলে আছড়ে পড়বে।
ওই প্রতিযোগিতা দেখতে সে দিন হাজির ছিলেন সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির টিকিটে দাঁড়ানো নত্থু সিংহ, যিনি নিজেও ছিলেন কুস্তিগির। মুলায়ম সিংহ সে দিন চ্যাম্পিয়ন হন। তাঁর প্যাঁচপয়জারে মুগ্ধ হন নত্থু। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনপড়, ইটাওয়ার সাইফাই গ্রামের বাসিন্দা, ‘কর্মক্ষেত্র পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ’ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক, শিকোহাবাদের ‘একে কলেজ’ থেকে বিটি, আগরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিআর কলেজ’ থেকে স্নাতকোত্তর, স্কুল শিক্ষক মুলায়ম ধীরে ধীরে অনুপ্রাণিত হন রাম মনোহর লোহিয়া, রাজ নারায়ণদের রাজনৈতিক বীক্ষায়। সেই যশবন্তনগর থেকেই ৬৭ সালে সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির টিকিটে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে লড়াই এবং সাফল্য। সোমবার সকালে যখন গুরুগ্রামের হাসপাতালে শেষ করলেন দীর্ঘ যাত্রাপথ, তখন তথ্য বলছে, মুলায়ম উত্তরপ্রদেশের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী, দশ বারের বিধায়ক এবং সাত বারের সাংসদ। ছিয়ানব্বইয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সর্বোপরি সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তো বটেই।
একই অঙ্গে বহু রূপের সহাবস্থান ও প্রকাশ মুলায়মের ক্ষেত্রে যে ভাবে ঘটেছে, ভারতীয় রাজনীতিতে তার তুলনা বিরল। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা যেমন, তাঁর বন্ধু ও শত্রুরাও তেমনই হিমসিম খেয়ে গিয়েছেন মুলায়মের পরবর্তী চাল বুঝতে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির প্রবক্তা, তৃতীয় ফ্রন্টের অন্যতম মুখ, মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘মৌলা’ মুলায়ম, ধর্মনিরপেক্ষতার মসিহা তিনি। আবার সেই মুলায়মই রাজনৈতিক ডিগবাজিতে চৌখস, চূড়ান্ত নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য প্রখ্যাত, গোটা জীবন বিজেপি-বিরোধী রাজনীতি করে জীবনের উপান্তে, উনিশের লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদীর জয় প্রার্থনা করে, বিরোধী পক্ষ এবং পুত্র অখিলেশ সিংহকে আতান্তরে ফেলে দেন! নিরানব্বইয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ী মাত্র একটি ভোটে আস্থা ভোটে পরাজিত হলে, এই মুলায়মই সনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে কাঁটা রোপণ করেন, তাঁর বিদেশিনি প্রসঙ্গ তুলে। আবার ২০০৭ সালে ইউপিএ সরকার থেকে বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে তিনি কংগ্রেসের পাশে এসে দাঁড়ান, যাতে রাজ্যে মায়াবতী মাথা তুলতে না পারেন।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় তিনি উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক অরণ্যে টিকে থেকেছেন এ রকমই বৈপরীত্যে ভরপুর, পূর্বাভাসহীন কৌশলে। তাঁর কোনও স্থায়ী শত্রু ছিল না, ছিল না কোনও চিরস্থায়ী বন্ধুও। রাজধানীর রাজনৈতিক জগতের প্রবীণরা প্রায়শই বলে থাকেন, শৈশবে গবাদি পশুর দলকে দিনের পর দিন সামলানো এবং সাইকেলে চড়ে রাজ্য চষে ফেলার অভিজ্ঞতা কোনও না কোনও ভাবে পরবর্তী সময়ে তাঁর রাজনৈতিক লড়াইকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি চিরকাল আস্থা রেখেছেন মেঠো রাজনীতিতে। মুলায়মের ভাষা, বক্তৃতা, চালচলন প্রত্যন্ত গ্রামের হৃদয়কে ছুঁয়েছে। জনসংযোগের জন্য কোনও কর্মকর্তাদের উপরে নির্ভর করতে হয়নি মুলায়মকে কোনও দিন। উত্তরপ্রদেশের মানুষের সাধারণ আবেগ তাঁকে ‘নেতাজি’ নামে পরিচিত করে তুলেছে। তাঁর তিন দফার মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদে গ্রামের রাস্তা,সেচ ব্যবস্থার চোখে পড়ার মতো উন্নতি ঘটেছে। রাজ্যের প্রকল্পগুলি পৌঁছেছে প্রত্যন্ত জনবর্গের কাছে। পিছড়ে বর্গকে তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন।
বিরানব্বই সালে মুলায়ম গঠন করলেন সমাজবাদী পার্টি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সঙ্গীদের নিয়ে নিরীক্ষা রইল অব্যাহত। ১৯৯৪-এ মায়াবতীর হাত ধরলেন। ১৯৯৫-এ তা কুৎসিত প্রকাশ্য কাজিয়ায় শেষ হল। যে ক্ষত আর মিটল না। ২০০৩-এ দীর্ঘ দিন পর উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ফেরা ছিল মুলায়মের কাছে পুনরুজ্জীবনের মতো। রাজনৈতিক গুঞ্জন, তা নাকি সম্ভব হয়েছিল বাজপেয়ীর সক্রিয় আশীর্বাদে। অথচ বাম এবং কংগ্রেসের পাশাপাশি তিনিই অন্যতম নেতা, যিনি কখনও বিজেপি-র সঙ্গে জোট গড়েননি। ‘পিছড়া’ বর্গের নেতা কে, তা নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে নিত্য কলহ চলত মুলায়ম ও লালুপ্রসাদ যাদবের। কিন্তু দেখা গিয়েছে দুই যাদব পাশাপাশি এসেছেন। লালুর ছোট মেয়ে রাজলক্ষ্মী যাদবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে মুলায়মের ভাইপো রণবীর সিংহ যাদবের ছেলে তেজপ্রতাপের।
মুলায়ম এ কথাও জানতেন, তাঁর মাটি জল হাওয়ার প্রতি পরতে মিশে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার বাষ্প। তিনি জানতেন তাঁর ভোটব্যাঙ্ককে। তাই একের পর এক চরম নারী-বিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। ধর্ষণবিরোধী আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে এক জনসভায় মুলায়ম বলেছিলেন, “ধর্ষণের সাজা কি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে? ছেলেরা ছেলেই। কখনও কখনও তারা ভুল করে ফেলে।” স্বাভাবিক ভাবেই এর পর দেশজোড়া বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসেননি মুলায়ম। আবার সেই তিনিই মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে বিরোধিতা করে বলেন, “গ্রামের মহিলাদের কাছে এর কোনও মূল্য নেই, এর ফলাফল পাবেন শহরের বড়লোকেরা। গ্রামের মহিলারা ততটা আকর্ষণীয় নন!”
তবে তিনি কি ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুগটা বদলাচ্ছে? সেই সঙ্গে তাঁর দুই স্ত্রীর দুই পুত্র (প্রতীক ও অখিলেশ) ও পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব, এক সময়ের ডানহাত ভ্রাতা শিবপাল সিংহের সঙ্গে অখিলেশের সংঘাত ভিতর থেকে হয়তো ক্ষইয়ে দিচ্ছিল এক সময়ের ‘পহেলওয়ান’কে। তুলনায় অনেকটাই উদারপন্থী, বিদেশে পড়াশুনো করে আসা পুত্রের হাতে তাই ২০১২ সালে রাজ্যপাট তুলে দিয়েছিলেন মুলায়ম। যদিও তার পরেও দীর্ঘ সাত-আট বছর চলা যাদব বংশের মুষলপর্বে বিভিন্ন সময়ে কলকাঠি হাতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। শেষ কয়েক বছর কার্যত অথর্বপ্রায় মুলায়মের হাতে কোনও ‘প্যাঁচ’-ই আর অবশিষ্ট ছিল না।