জনৈক ব্যক্তি লেখককে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন?” চোখা নাকের উপর বসে থাকা ডাঁটিবিহীন চশমার ভিতর দিয়ে জ্বলজ্বলে এক জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ উত্তর দিল, “আমি ইউলিসিস লিখছিলাম মশাই। আপনি?” উপন্যাসটিকে নিয়ে চালু বিপুল কিংবদন্তির মধ্যে এটা অন্যতম, কিন্তু এর সত্যতা যাচাই এ লেখার উপজীব্য নয়। বরং এ কাহিনিকে দেখা যাক অন্য ভাবে। ইউরোপ কাঁপানো ওই পাঁচ বছরে পতন হয় চারটে সাম্রাজ্যের— অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, অটোমান, রোমানোভ, জার্মান। মৃত্যু হয় অগুনতি মানুষের, ক্ষয়ক্ষতি বিরাট। শেষ হয়ে যায় প্রায় দেড় হাজার বছরের খ্রিস্টান ইউরোপ ও তার বিশ্বজোড়া আস্ফালন।
অথচ, জেমস জয়েস-এর (ছবিতে) ইউলিসিস-এর বিষয় এর কোনওটাই নয়। হোমারের মহাকাব্যের মূলে ট্রয়ের যুদ্ধ-শেষে ওডিসিয়ুস-এর ইথাকা ফেরার দশ বছরের বিপদসঙ্কুল যাত্রা, তাকে ঘিরে ঝড়ঝাপটা, লোকক্ষয়, আর ইথাকায় পেনিলোপির প্রতীক্ষা। জয়েস সেই মহাকাব্যেরই ছায়ায় লিখলেন বটে, কিন্তু তাতে এল না যুদ্ধ, মহামারি, প্লেগ, ধ্বংস। দশ বছর হয়ে গেল এক দিন; ইজিয়ান সমুদ্র নেহাতই ডাবলিনের রাস্তাঘাট; গ্রিসের মধ্যবয়স্ক নায়ক পাল্টে গেল বছর আটত্রিশের খামখেয়ালি এক হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিতে— ছোট কাগজে সামান্য বিজ্ঞাপন জোগাড়ের দায়িত্ব তার। এই ওডিসিয়ুস—লিয়োপোল্ড ব্লুম— আধুনিক সভ্যতার প্রকাণ্ড যন্ত্র-ঘরে সামান্য পেরেক মাত্র; ইউলিসিস ১৯০৪ সালের ১৬ জুনের ডাবলিনে এক মামুলি মানুষের মামুলি ঘরে ফেরার গান। আর আখ্যানের ব্যাপ্তি? প্যারিসের ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রকাশিত প্রথম স্ট্যান্ডার্ড এডিশন-এ ছিল ৭৩০ পাতা! কী এমন লিখলেন জয়েস যে অবিস্মরণীয় হল ব্লুম, ডাবলিন হয়ে উঠল গত শতাব্দীর যে কোনও শহরের মূর্ত প্রতীক, হেলে গেল উপন্যাস নামক অচলায়তনের রাজনীতি ও রীতি, জন্ম নিল ‘আধুনিক উপন্যাস’?
ইউলিসিস-এর মাধ্যমে জয়েস সভ্যতার সঙ্গে শিল্পের, উপন্যাসের সঙ্গে জীবনের প্রাচীন সম্পর্কে তিন রকম বিঘ্ন ঘটালেন। জীবনের যে পাঠ তুলে আনলেন তা এতই পরিণতমনস্ক ও সূক্ষ্ম যে, সাহিত্য জীবনকে কী ভাবে দেখবে তার সংজ্ঞাই বদলে দিল এই উপন্যাস। একে বাস্তববাদের ‘ক্রিটিক’-এর আওতায় ফেলা যায়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই প্রথম বিঘ্নের আয়োজন জয়েসের একার কৃতিত্ব নয়। ফরাসি বিপ্লবকে সূচক ধরলে দেখা যাবে, পুরো উনিশ শতক জুড়ে শিল্প বিপ্লব, বৈপ্লবিক প্রযুক্তি ও ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে ইউরোপের বড় দেশগুলোতে আছড়ে পড়ল একের পর এক যুগান্তকারী বদল, যা নাড়িয়ে দিল বেশ কিছু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা শিলায়িত জনজীবন, বস্তুর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন ছন্দ। সেই ঝড় অচিরেই আছড়ে পড়ল সাহিত্যের গায়ে: ফ্রান্সে বোদল্যেয়র থেকে জার্মানিতে রিলকে, পর্তুগালে পেসোয়া থেকে রাশিয়াতে আন্দ্রে বেলি বা মায়াকোভস্কি, এমনকি ইটালির ‘ফ্যাসিস্ট’ মনস্কতায়ও ধরা পড়ল এই বদলে যাওয়া জীবনের ব্যাখ্যার প্রয়োজনে সাহিত্যের নিরন্তর ফর্ম খোঁজার নিজস্ব এক ‘ওডিসি’। ইয়েটস, এলিয়ট তো ছিলেনই; জয়েস ইউলিসিস-এ সাহিত্যের ওই ওডিসি-কে ইথাকার পথ বাতলে দিলেন, অন্তত উপন্যাসের ক্ষেত্রে। কিছুটা ওই একই কাজ তখন ফরাসিতে করছিলেন প্রুস্ত, জার্মানে কাফকা। কিছু দিন পরেই এই ভাঙনখেলায় হাত লাগালেন পোল্যান্ডে উইটোল্ড গোমব্রোউইজ়, অস্ট্রিয়াতে রবার্ট মুসিল আর হারমান ব্রক। ভেঙে পড়ল সাবেক, ডিকেন্সীয় উপন্যাসের আধিপত্য।
শুধু বাস্তববাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা সমকালীন জীবনের মহাকাব্য হিসেবে ইউলিসিস-কে বোঝা যাবে না। জয়েস শুধু ভাষার খামখেয়ালিপনাতেই থামলেন না, ন্যারেটিভের পরতে পরতে বুনে দিলেন অবচেতনের অনায়াস বিচরণ: কোথায় চেতনার ইতি, কোথায় বা অবচেতনের অভিক্ষেপ তা পরিষ্কার হয় না, যেমন বোঝা যায় না জীবনেও। এতেও যে জয়েস পথিকৃৎ তা নয়, তবে জীবনের সঙ্গে বাস্তবের, চিন্তার সঙ্গে অবচেতনের এই বুননকে অন্য মাত্রা দিলেন তিনি।
তৃতীয় যে বিঘ্নটা ঘটালেন তার উৎস, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি— আইনস্টাইন। কসমোলজি, অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স, স্পেস সায়েন্স ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের ১৯০৫-এর স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি আর ১৯১৬-র জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি যে যুগান্তরেরও বেশি তা আমরা জানি। ঠিক ওই সময়েই জয়েস লিখছিলেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস। ইউলিসিস জুড়ে আছে মহাবিশ্বে মহাকাশে আমাদের মামুলি অস্তিত্বের, অণু-পরমাণুর মতো দৈনন্দিন ক্ষয়িষ্ণুতার আপেক্ষিকতা। তা ফিরে ফিরে আসে কারণ এর থেকে যুগান্তর ঘটে না, গ্রিক ‘হিরো’র বা বুকভাঙা ট্র্যাজেডির উদ্গিরণ হয় না। বরং আধুনিক কালের এই আপেক্ষিকতা পরিষ্কার করে দেয়: ক্ষুদ্র চাহিদা, মুহূর্তের পাওয়া, কয়েক মুহূর্তের দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকাই ‘হিরোইজ়ম’, আস্ত মহাকাব্যের পদার্থবিশেষ।
এই সব কিছুকে ন্যারেটিভে তুলে আনতে জয়েস সাহিত্যের বিস্তারিত ইতিহাসের দিকে তাকালেন না। তাকালেন কৈশোরপ্রাপ্ত, তখনও ভদ্রলোকের কাছে অপাঙ্ক্তেয় এক শিল্পের দিকে— সিনেমা। সময়কে অনুক্রমের শৃঙ্খল থেকে, গতিকে বিধিবদ্ধতা থেকে, বাস্তবতাকে গণনার আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে, আধুনিকতার ক্ষিপ্রতা ও তার ভঙ্গুর আপেক্ষিকতাকে নিজস্ব ঢঙে নিজের পরতে পরতে ধারণ করতে পারে শুধু সিনেমাই, জয়েসের এই ধারণা ছিল। তাই ইউলিসিস-এর ন্যারেটিভ সিনেমার ন্যারেটিভ, এক সঙ্গে অনেকগুলি আপেক্ষিক অস্তিত্বের ন্যারেটিভ।
এই কারণেই বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন এই উপন্যাস বেছে নেয় যুদ্ধকে নয়, যৌনতার সুখ ও আক্ষেপকে; সাম্রাজ্যের পতন নয়, দৈনন্দিন জীবনালেখ্যকে; ধ্বংস নয়, বেঁচে থাকার মৌলিক বাসনাকে। শতক-ছোঁয়া এই উপন্যাস এই কারণেই অনন্য।
স্কুল অব লেটারস, আম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়