সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, যৌন হেনস্থার মামলায় নিম্ন আদালত যেন বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে নিজেদের রায় সংযত ভাষায় লেখে— যাতে আবেদনকারীর চরিত্র, উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে অযথা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা যায়। মহামান্য শীর্ষ আদালত এই প্রসঙ্গে সাত দফা নির্দেশিকা জারি করল। উচ্চতম আদালতের এই সংবেদনশীল ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়, যদিও সাম্প্রতিক অতীতে ধর্ষণের ক্ষেত্রে করা প্রধান বিচারপতির কিছু মন্তব্যে বিতর্ক তৈির হয়েছে।
তবে, হয়তো আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, পুরুষতন্ত্রের নিগড় ভাঙার এই চেষ্টাটিও কিন্তু বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির দোরগোড়ায় এসে থমকে দাঁড়াল। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ, স্বামী যদি স্ত্রীর অমতে তাঁর সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন, তবুও তাকে কিছুতেই ধর্ষণ বলা যাবে না। স্ত্রী এই হিংসার থেকে প্রতিকার চাইলে তাকে দণ্ডবিধির ৪৯৮-এ ধারায় গার্হস্থ হিংসার অভিযোগ আনতে হবে, বা ক্ষেত্রবিশেষে ১৯৬১’র পণ নিরোধক আইনের উপর নির্ভর করতে হবে। এই দুই আইনে হিংসার সাজা থাকলেও স্বামীকে ধর্ষক প্রতিপন্ন করার কোনও উপায় নেই। এহেন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আগেও জানানো হয়েছে— কখনও নারীবাদী আন্দোলনের ভিতর থেকে, কখনও কোনও নৃশংস অপরাধের প্রেক্ষাপটে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি উঠেছে। যে দেশে গার্হস্থ হিংসা দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে, সেখানে স্ত্রীর অসম্মতিতে এই জাতীয় যৌন হিংসার ক্ষেত্রে স্বামীকে আইনি রক্ষাকবচ দেওয়াটা কত দূর সমীচীন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই।
ভারতীয় আইনব্যবস্থা ব্রিটিশ কমন ল’ ব্যবস্থার অনুসারী। সপ্তদশ শতকে বিলেতের দুই অতি প্রভাবশালী দার্শনিক ও আইন বিশেষজ্ঞ— ব্ল্যাকস্টোন এবং হেল— মত দিয়েছিলেন, বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘ধর্ষণ’-এর সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হোক। তাঁদের এই অবস্থানটিই ব্রিটিশ আইনে গৃহীত হয়েছিল। এই অবস্থানের পক্ষে তাঁরা দু’টি আলাদা তত্ত্বের অবতারণা করেন। প্রথম তত্ত্ব অনুসারে, স্ত্রীকে বিবাহপূর্বে পিতা ও বিবাহের পর স্বামীর ‘দায়’ হিসেবে গণ্য করা হয়। স্ত্রীর কোনও আলাদা সত্তা থাকে না, তিনি তাঁর স্বামীর সত্তায় বিলীন হয়ে যান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাঁর স্থান সম্পত্তির সমান। তাই বিবাহ স্থায়ী থাকলে (বিচ্ছেদ ছিল আইনবিরুদ্ধ) কোনও মহিলা তাঁর স্বামীকে তাঁর ‘সম্পত্তির ভোগ থেকে বঞ্চিত’ করতে পারেন না। দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি, যার মধ্যে নিহিত আছে সম্মতি, বিশেষত যৌনতার ক্ষেত্রে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রী নিজেকে সমর্পণ করেন স্বামীর কাছে, স্বামী যার বদলে তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই দুই তত্ত্বের মাধ্যমে ব্রিটিশ সমাজে বৈবাহিক ধর্ষণ মান্যতা পেল না, আর আজকেও তা ভারতীয় আইনে ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য। সপ্তদশ শতকের এক ব্রিটিশ আইন আজও ভারতীয় নারীদের অধিকার খণ্ডন করছে।
অথচ, গত কয়েক বছরে উচ্চতম আদালতের বিভিন্ন রায়ে যে সাংবিধানিক কাঠামো প্রস্তুত হয়েছে, তাতে এই আইনের অবলুপ্তি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করেছিল ওয়াকিবহাল মহল। এই প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে এস পুত্তাস্বামী বনাম ভারত সরকার মামলা, নবতেজ জোহর বনাম ভারত সরকার মামলা এবং জোসেফ শাইন বনাম ভারত সরকার মামলায় শীর্ষ আদালত যে রায়গুলি দিয়েছে, সেগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। সংবিধানের ১৪, ১৯ এবং ২১ ধারায় উল্লিখিত মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ বিপরীত এই বৈবাহিক ধর্ষণের ব্যতিক্রমটি। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার অন্তর্গত ব্যক্তিস্বাধীনতা নাগরিকের সর্বোত্তম অধিকার— যা জরুরি অবস্থাতেও নিষ্ক্রিয় করা আইনবিরুদ্ধ। যে কোনও যৌন সংস্রব বৈধতা পায় দুই পক্ষের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে— এক পক্ষের অনিচ্ছায় যৌন সম্পর্ক সর্বতো ভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি-ইচ্ছা এবং তার বৈধ প্রকাশভঙ্গি সাংবিধানিক কাঠামোয় রক্ষা করার কথা ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যা ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিস অথরিটি বনাম ভারত সরকার মামলায় ২০১৪ সালের রায়ে আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ন্যায়সঙ্গত কারণে ব্যক্তি-ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা আছে শুধু রাষ্ট্রের, কোনও ব্যক্তিবিশেষকে সেই অধিকার দেওয়া হয়নি।
সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে, সমতা এক মৌলিক অধিকার রূপে প্রতিষ্ঠিত— এই ধারা ব্যবহার করে যে কোনও বৈষম্যমূলক আইন রদ করার ক্ষমতা আছে উচ্চ আদালতের। ধর্ষণ যদি আইনত দণ্ডনীয় হয়, এবং একই আইনে বৈবাহিক ধর্ষণ যদি অপরাধ গণ্য না হয়, সে ক্ষেত্রে আইনের চোখে ধর্ষণের হিংসার থেকেও ধর্ষকের পরিচয় মুখ্য হয়ে যাচ্ছে স্রেফ বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এই ব্যতিক্রমটির মাধ্যমে অবিবাহিত এবং বিবাহিত নারীর অবস্থান আলাদা করা হয়েছে। ফলে, এই আইন অবিবাহিত নারীর ইচ্ছার মর্যাদা দিচ্ছে, কিন্তু বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে তা দিচ্ছে না— যা সর্বার্থেই বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক।
গণতান্ত্রিক দেশে আইন পাল্টানোর প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং রাজনীতির বাধ্যবাধকতার দ্বারা নির্ধারিত, এই সত্য মানুষ বোঝে। কিন্তু, আদালতের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। ভারতের বিবাহিত মহিলারা তাই আদালতের দিকেই চেয়ে রয়েছেন।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা