প্রাণঘাতী: প্লাবিত অসহায় খাদ্য-পানীয়-আশ্রয়বিহীন শহরে বিমান থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলার প্রয়াস, শিলচর, ২৩ জুন। রয়টার্স
একটা জলজ্যান্ত শহর শিলচর। জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক আকার, দুয়ের নিরিখেই অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনপদ। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণের অভাব নেই নগরীতে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এন আই টি, পলিটেকনিক, আইটিআই, মেডিক্যাল কলেজ, গাদা গাদা কলেজ, স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের কোচিং সেন্টার। রাস্তার দুই পাশের বিপণি-বিতানে থরে থরে সাজানো পণ্য-সম্ভারের সামনে উপচে পড়া ভুবনমোহনবিজ্ঞাপনবিমোহিত সারি সারি মুখ। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি গমগম করছে যত রাজ্যের ফুড কোর্ট। মধ্যযামিনী পর্যন্ত রাস্তায় ছুটতে থাকে আধুনিক রানাররূপী গিগবয়রা। জমিজমার দামে জেলা শহরটি দিব্যি পাল্লা দিতে পারে দেশের মহানগরীগুলোর সঙ্গে। যানজটের যন্ত্রণা মনে করাতে পারে ঢাকা শহরকে। প্রতিশ্রুতি দিয়েও উত্তর-দক্ষিণ জুড়তে সাধের উড়ালপুল কেন হল না, তা নিয়ে জোর তরজা চলে কংগ্রেস আর বিজেপিতে। রামেন্দ্র দেশমুখ্যের ‘শ্রাবস্তী বিদিশা থেকে শিলচর শহর আরো মনোরমা’ এখনও মুখে মুখে ফেরে অতীতচারী মাঝবয়সি কবিতাপ্রেমীদের অপস্রিয়মাণ আড্ডায়।
একশো চল্লিশ বছর আগে রিপন সাহেব যখন ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন চালু করলেন, তখনই আমাদের এই জনপদটিতেও মিউনিসিপ্যাল প্রশাসনের কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। এই লোকালয়ের নগর-পরিচিতি তাই অধিবাসীদের দীর্ঘ দিনের কৌলীন্যের দোসর। এই ক’দিন আগেই রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বরাক উপত্যকার প্রাণকেন্দ্রটি এ বার কর্পোরেশনের মর্যাদা পাবে।
হ্যাঁ, শহরের নিকাশি ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এক ঘণ্টার টানা বর্ষণে তাই শহর চলে যায় জলের তলায়। তা এই সমস্যা কলকাতা থেকে মুম্বই কোথায় নেই! জনবিস্ফোরণের চাপ নিতে পারছে না দেশের প্রায় সব বড় শহরই। সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে যাওয়া আমাদের নাগরিক অভিজ্ঞতার নিয়ত সঙ্গী।
শেষ বার বড়সড় বন্যা হয়েছিল ২০০৪ সালে। শহরময় জলে নাকাল হয়েছিলেন শিলচরবাসী। গত চার দশকে অন্তত পাঁচ বার বন্যায় ডুবেছে শিলচর-সহ গোটা কাছাড় জেলা এবং বরাক উপত্যকা। এক মাস আগেই, অর্থাৎ মে মাসের মাঝেই বরাকের উপচে পড়া জলে শহরের অনেকটাই বন্যাক্রান্ত হয়।
কিন্তু জুনের বন্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বন্যা মানে হাঁটু কিংবা কোমর জল। নদীমাতৃক বরাক উপত্যকা তথা অসম রাজ্য এমন জলছবিতে অভ্যস্ত। কিন্তু বুকজল থেকে ডুবজল! উত্তর-পূর্বের বৃহত্তম মলের বেসমেন্ট ডুবে আছে দশ ফুট গভীর জলে! এমন ঘটনা নাগরিক অভিজ্ঞতায় বিরল।
২০ জুনের কালসন্ধ্যায় যখন শহরের নামীদামি এলাকায় বহুতল আবাসনগুলোকে হুহু করে গ্রাস করছে তীব্র বেগে বয়ে আসা বরাক, দোতলায় থেকেও থরথর করে কাঁপছিলাম জল না সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে! পানীয় জল, আলো, ইন্টারনেট আর মোবাইল সংযোগহীন শহরে পরবর্তী দিনগুলো শুধুই দুর্ভোগ আর আতঙ্কের। মনে পড়ছিল শিলচরে ১৯২৯-এর মহাপ্লাবনের সময়ে লেখা দু’টি রচনার কথা। সুন্দরীমোহন দাস ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ও সমাজসেবক। ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট ও চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সুন্দরীমোহন ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং স্বাস্থ্য সমিতির প্রধান। ‘বন্যা-পীড়িত শ্রীহট্ট-কাছাড়’ শিরোনামে তাঁর একটি মূল্যবান প্রতিবেদন প্রবাসী পত্রিকায় (শ্রাবণ, ১৩৩৬) প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের অনবদ্য স্মৃতিকথা শিলচরের কড়চায় (সম্পাদনা, অমিতাভ দেব চৌধুরী) রয়েছে ১৯২৯-এর প্লাবনের উপাখ্যান। চরাচর জুড়ে অথৈ জলে ডুবে থাকা শহরে যখন নেমে আসত নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, মনে আসত সেই বন্যার সঙ্গে এ বারের বন্যার নানা ধরনের মিলের কথা। সে বারও শ্রীহট্ট এবং কাছাড়ে একই সঙ্গে নদীগুলিতে জলস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। বরাক, কুশিয়ারা, সুরমার জলস্ফীতি বরাক-সুরমা সহোদরা উপত্যকার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। বরাকের জল বাংলাদেশ হয়েই বঙ্গোপসাগরে পড়ে। শ্রীহট্টের নদীতে জলস্ফীতি অব্যাহত থাকলে বরাকের জলস্তর সহজে কমে না। এই একই চিত্র এ বারের বন্যায়ও দেখা গেছে কারণ সে বারের মতো এ বারও বৃহত্তর শ্রীহট্ট বিভাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গভীর জলে প্লাবিত হয়েছে। সে বারও শিলচরে বন্যা হয় এই জুন মাসেই। কালীপ্রসন্নবাবুর বিবরণে ধরা আছে হৃদয়বিদারক নানা ঘটনা। যেমন শহরের মাঝ-বরাবর ভেসে যাচ্ছে এক মহিলার মৃতদেহ। সেই সময় শহরে দোতলা বাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা। লোকজন একতলা বাড়ির চালে উঠেছেন প্রাণ বাঁচাতে। তবে ৯৩ বছর আগে ইংরেজশাসিত এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে জলপ্রলয়ে এমন খণ্ডচিত্র খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এক শতাব্দী পেরিয়েও দুর্যোগ ও দুর্ভোগের একই চালচিত্র দেখলে এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রকে বড়ই দুর্বল মনে হয়।
দীর্ঘস্থায়ী দুর্গতি থেকে বাঁচতে অবশেষে সপরিবার প্রাণ হাতে নিয়ে নৌকা এবং অপটু প্রয়াসে তৈরি বাঁশ আর থার্মোকলের ভেলায় চেপে হোটেলে এসে আশ্রয় নিতে হল। হোটেলঘরের মহার্ঘ ব্যবস্থাপনায় ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে পেলাম। এবং তখনই সমাজমাধ্যমে আছড়ে পড়তে শুরু করল একের পর এক কান্না আর মনুষ্যেতর জীবনযাপনের গায়ে কাঁটা দেওয়া সব কাহিনি। চোখের সামনে দেখছি, জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে মোড়কে মোড়া মৃতদেহ। কোনও এক হতভাগ্য পুত্র তার মাকে দাহ করার শ্মশান খুঁজে না পেয়ে শবদেহের সঙ্গী করেছে কাগজে লেখা তার এক আকুল আকুতি। কোনও সহৃদয় ব্যক্তি যদি এক টুকরো ডাঙায় দাহ করেন তার মায়ের পার্থিব দেহটি! মায়ের কোল খালি করে শিশু ডুবছে জলে। পানীয় জল সংগ্রহে গিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি কত পুত্র কিংবা স্বামী। প্রায় প্রতি দিনই শুনেছি শহরের রাস্তায় লাশ ভেসে ওঠার কথা। জলাভাবে বন্যার জলই খেতে বাধ্য হয়েছেন কত মানুষ! এমন প্রাণঘাতী শহুরে বন্যার কথা কেউ কি শুনেছেন কখনও!
ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গেছেন যে, এই বন্যা প্রকৃতির রোষে নয়, মানুষের ‘দোষে’ হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই ‘ম্যানমেড ফ্লাড’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর আদেশে রাজ্য পুলিশ এখন পর্যন্ত চার জনকে বাঁধ কাটার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। এরা সবাই একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ার ফলে প্রচারমাধ্যম ‘জলজেহাদ’ বলে একটি নতুন শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। স্বস্তির কথা এই যে, জেলার পুলিশ সুপার এবং মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এই সাম্প্রদায়িক কটূক্তি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন। কিন্তু তাতে কী! এত বড় মুখরোচক ‘স্টোরি’ কি আর বৈদ্যুতিন মাধ্যম ছেড়ে দিতে পারে! শিলচর শহরের প্রান্তে থাকা এক অখ্যাত স্থান ‘বেতুকান্দি’ তাই সংবাদ শিরোনামে! অথচ, ঠিক কোথায় কে এবং কারা কী অপরাধটা করল তা এখনও অধিকাংশের কাছেই অজানা।
শিলচরের নালা খাল নর্দমার জলের এক বিশাল অংশ গিয়ে জমা হয় শহর সংলগ্ন মহিষাবিলে। শিলচরে ‘মেঘ গাভীর মতো চরে’। ফলে বর্ষণকাতর অন্তত নয় মাসই এই বিল থাকে জলে ভরা। উপরি যন্ত্রণা হিসেবে গত মে মাসের বন্যার জলও বেরোয়নি সেই বিল থেকে। আশপাশের বাসিন্দারা, যাঁদের বৃহৎ অংশ অবশ্যই মুসলমান, এই জলযন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইছিলেন। ২২ মে রাতে, স্থানীয় খবরের কাগজের প্রতিবেদন মতে, বাঁধের একটি অংশ কেটে দেওয়া হয়, যাতে জমা জল ফের বরাকে ফেরত যেতে পারে। স্লুইস গেট থাকলে এ ভাবে বাঁধ কেটে জল বার করার প্রয়োজন অবশ্যই পড়ত না। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই স্লুইস গেটের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পরও কোনও অজ্ঞাত কারণে পুরো প্রকল্পটিই মাঝপথে বাদ দেওয়া হয়। বাঁধ যে কাটা হয়েছে, তাও কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ এবং শাসক দলের স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের অজ্ঞাত ছিল না। সাংবাদিক অরিজিৎ আদিত্যের একাধিক প্রতিবেদনে এই কথাগুলোর উল্লেখ রয়েছে। এবং সরকারি স্তরেও কেউ তথ্যগুলি নস্যাৎ করেননি। বাঁধ কেটে দেওয়ার মতো অবিমৃশ্যকারী কাজের পরও কিন্তু অন্তত কুড়ি দিন সময় ছিল। এর মধ্যে কাটা বাঁধ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করাই যেত। কিন্তু কোনও পক্ষেরই হেলদোল ছিল না। আসলে সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে, মহিষাবিলের বাড়তি জল যখন বরাকে ফিরে গেছে তা হলে আপদ মিটল। এবং বলা বাহুল্য, এই হাঁ-মুখ বরাক দিয়েই যে কিছু দিন পর তোড়ে জল ঢুকে শহর ভাসিয়ে দেবে তা হিন্দু-মুসলমান, নেতা-জনতা, প্রশাসন-সরকার কারও কল্পনাতেই উঁকি দেয়নি। এই সামূহিক গাফিলতি এবং ১২১ বছরের রেকর্ড বৃষ্টিপাতের নিট ফল এই মহাপ্লাবন।
বন্যার জল নামবে। নদী ‘মহাদেবের জটায়’ ফিরে যাবে। কিন্তু একটি প্রশ্ন কি ন্যায়প্রণেতাদের বিব্রত করবে না? অমর্ত্য সেন তাঁর দি আইডিয়া অব জাস্টিস-এ প্রতিবিধানযোগ্য অন্যায়ের (রিমেডিয়েবল ইনজাস্টিস) কথা বলেছিলেন। একটি শক্তপোক্ত স্লুইস গেট কি এই ভুক্তভোগীদের জীবনযন্ত্রণা কমিয়ে দিত না? এতেই কি বেঁচে যেত না শহরটি! এমন অসংখ্য প্রতিবিধানযোগ্য অন্যায় চোখে দেখেও নিঃশব্দে নীরবে বইতে থাকে বুড়ো লুইত থেকে তরুণী বরাক!
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর