কিন্তু ওকে দোষ দেব কী করে, ও কেবল অন্যদের খেলার বোড়ে” (বাট হি ক্যান নট বি ব্লেমড, হি ইজ় ওনলি আ পন ইন দেয়ার গেমস)— বব ডিলানের গানের এই কথাগুলোই যেন সম্প্রতি প্রতিধ্বনিত হল কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি বিবেক চৌধুরীর রায়ে। হাওড়া জেলার শ্যামপুর পঞ্চায়েতে সিপিএম এবং তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের মারামারিতে এক ব্যক্তি মারা যান ২০০৮ সালে। হত্যার অভিযোগে ন’জনের সাজা হয়। চোদ্দো বছর কারাবাস, বার বার আপিলের পর বিচারপতি চৌধুরী তাঁদের সাজা কমিয়ে দিয়েছেন। তাঁর রায়ে লিখেছেন, “আপিল আবেদনকারীরা সকলেই গ্রামবাসী। ...এই আবেদনকারীরা রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বা তাত্ত্বিক ভাবধারা সম্পর্কে আদৌ অবহিত না হয়ে কোনও না কোনও দলের সমর্থক হয়ে গিয়েছেন। রাজনীতির কিছুই তাঁরা বোঝেন না। তাঁরা আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার শিকার, অথবা তাঁরা রাজনীতির বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন।”
গ্রামের দিনমজুর বা গৃহবধূমাত্রেই রাজনীতি না বুঝে রাজনৈতিক দলের কার্যসূচিতে শামিল হন, এ কথা অনেকের কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে সংগঠন তৈরি করা, রাজনৈতিক চেতনা তৈরি করে আন্দোলনে নিয়ে আসার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তা হলে দরিদ্র মানুষ রাজনীতিতে কেবল ব্যবহৃত হচ্ছে, বলা যায় কী করে?
আবার, পর্যবেক্ষণটির অন্তর্নিহিত সত্যতাকেও অনেকে সমর্থন করবেন। প্রতি বছর এ রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বহু মৃত্যু ঘটে। নিহতরা অধিকাংশই হতদরিদ্র শ্রমজীবী, আবার অন্য পরিচয়ে তাঁরা দলিত বা সংখ্যালঘু। যাঁরা মারেন তাঁরাও প্রধানত গরিব, শ্রমজীবী মানুষ। রংবেরঙের পার্টির পতাকার আড়ালে লড়াইটা হয় গরিবে-গরিবে, শ্রমজীবী বনাম শ্রমজীবী। শ্যামপুরের ঘটনার পূর্বাপর খতিয়ে দেখে বিচারপতির মনে হয়েছে, তাঁরা নির্দোষ না হলেও রাজনীতির শিকার। এই দরিদ্র খেতমজুররা এই লড়াই তৈরি করেননি, করেছে অন্য কেউ। তারা এঁদের ব্যবহার করছে।
পীড়ন-বৈষম্য থেকে মুক্তির আশায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ, কিন্তু শেষাবধি কেবল ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহৃত হচ্ছেন, এর নিদর্শন অঢেল। বামপন্থীরা শ্রমজীবীদের সংগঠিত আন্দোলনের শক্তিতেই কংগ্রেসের দীর্ঘ আধিপত্য শেষ করেছিলেন। কিন্তু বাম নেতারা ক্ষমতায় এসে শ্রমজীবীদেরই কণ্ঠরোধ করেছেন প্রাণপণে। তাঁদের ‘শ্রেণিসংগ্রাম’-এ গরিবই মরেছে বেশি। আদর্শের লড়াই বার বার পর্যবসিত হয়েছে ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইতে। একই ভাবে, বামফ্রন্ট শাসনের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবীকে সংগঠিত করেছিল তৃণমূল— আজ খেতমজুর, দিনমজুর পরিবারের নারী-পুরুষরাই বার বার পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। প্রতি বার নির্বাচনের আগে যে বিপুল সন্ত্রাস দেখা যায়, তার রূপকাররা থাকেন আড়ালে। রাস্তায় মারামারি হয় গরিব বনাম গরিব, কর্মহীন বনাম কর্মহীনে।
এখন বিজেপি ধর্মের জিগির তুলে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষকে দলে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে। অসংখ্য দলীয় সংঘর্ষের ঘটনায় কত পরিবার যে শেষ হচ্ছে প্রতি দিন, কে তার হিসাব রাখে? যাঁরা চিরকাল পাশাপাশি বাস করেছেন, তাঁদের হাতে আসছে অস্ত্র, মুখে চিৎকৃত কোনও স্লোগান, যা তাঁদের নিজেদের তৈরি নয়। দলের ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাঁর মতো শ্রমজীবী মানুষের কতটা স্বার্থরক্ষা করতে পারবে, কতটা মর্যাদার জীবন দিতে পারবে তাঁকে, সেটা বোঝার কোনও সুযোগই শ্রমজীবীরা পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতির ভাগাভাগিতে কোনও এক দলে পড়ে গিয়েছেন তাঁরা। কখনও গ্রামে নিজের বসবাস টিকিয়ে রাখতে, কখনও রোজগার টিকিয়ে রাখতে, নিজেরই পড়শির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছেন।
নানুরের সুচপুরে ২০০০ সালে এগারো জন তৃণমূল-সমর্থক খেতমজুরকে হত্যা করে সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা। এই হত্যায় অভিযুক্তরা প্রায় সকলেই, হাওড়ার ঘটনার মতোই, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ। কাছেই নানুর ব্লকে আর একটা ঘটনায় ছ’জন নিহত হন। মৃতদের পরিবারের অভিযোগ, তৃণমূল সমর্থকরা হত্যা করেছে সিপিএম সমর্থকদের। এমন ‘বদলা’ নেওয়ার ঘটনা গ্রামে গ্রামে। পূর্ব বর্ধমানের করন্দায় ২০০৩ সালে ছ’জন দিনমজুরকে হত্যা করেছিল সিপিএম সমর্থকরা। নিহতরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সমর্থক। আজও লিবারেশন এই ঘটনাকে শ্রেণিসংগ্রামের আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখে, করন্দায় শহিদ দিবস পালন করে। তাতে কিন্তু সিপিএম ও লিবারেশনের পরস্পরের হাত ধরতে অসুবিধা হয়নি।
রাজ্য রাজনীতির এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারপতি বিবেক চৌধুরীর বক্তব্যকে দেখতে হবে। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে কেউ একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু আদালতে বিচারের সময়ে মামলার সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত দেখার চেষ্টা করা, শুধুমাত্র ঘটনার পরে তথ্য-প্রমাণে আটকে না থেকে গভীরে গিয়ে বিচার করা, দু’পক্ষের সামাজিক অবস্থান দেখা এবং রায়ে সেটাকে নিয়ে আসা— এগুলি অভিনন্দনযোগ্য প্রচেষ্টা। প্রতিটি হত্যার পিছনে কোনও কাহিনি থাকে। সেই কাহিনি হত্যার ঘটনার অর্থ নির্মাণ করে। সার্বিক বিচারের এই যে উদাহরণ বিচারপতি বিবেক চৌধুরী তৈরি করলেন, তা ন্যায়বিচারের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।