হারানো জমি ফিরে পাওয়ার লড়াই চালাচ্ছেন সাংবাদিকরা
Journalists

চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ

সম্প্রতি প্রবীর পুরকায়স্থর মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্ট জোরালো রায় দিয়েছে। প্রবীর কেবল মুক্তি পাননি, তাঁর গ্রেফতারিই যে বেআইনি ছিল, সুপ্রিম কোর্ট এমনই বলল।

Advertisement

মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ০৮:২৪
Share:

শক্তিরূপেণ: দিল্লিতে নিউজ়ক্লিক অফিসে তল্লাশির খবরে সমাজকর্মী ও সংবাদকর্মীদের আন্দোলন, হায়দরাবাদ, ৫ অক্টোবর ২০২৩। পিটিআই।

ভয়ে-ভরা চিত্ত, দৃষ্টি সর্বদা ঘোরানো পিছনপানে— কেউ কি নজর রাখছে, আড়ি পাতছে? রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ভারত থেকে বহু দূরে এই আতঙ্ক, সদা-সতর্কতা, অস্বস্তি। এই হল আজ ভারতে সাংবাদিকতার চরিত্র। সংবাদমাধ্যম যেন ক্ষমতাসীনের সামনে সত্য কথনের দায় ভুলেই গিয়েছে।

Advertisement

সম্প্রতি প্রবীর পুরকায়স্থর মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্ট জোরালো রায় দিয়েছে। প্রবীর কেবল মুক্তি পাননি, তাঁর গ্রেফতারিই যে বেআইনি ছিল, সুপ্রিম কোর্ট এমনই বলল। এই রায় আর এক বার ঝাঁকুনি দিয়ে গেল আমাদের। মনে করিয়ে দিল, গত দশ বছরে কী ভাবে বার বার মিডিয়ার উপরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের রোষ বর্ষিত হয়েছে। কখনও টিভির খবরের চ্যানেলের সম্প্রচার হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কখনও শাসকের সমালোচক সংবাদ সংস্থাকে কিনে নিয়েছে শাসক-ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সংস্থা। সরকারি বিজ্ঞাপন না দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পথে আনা হয়েছে বড় সংবাদপত্রগুলিকে। কেরলের সিদ্দিক কাপ্পান থেকে নিউজ়ক্লিক-এর কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থ— সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে জেলে ভরা হয়েছিল কঠোর ধারা আরোপ করে। গুজরাতের গণহত্যায় (২০০২) মোদীর ভূমিকা নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করায় বিবিসি-র দফতরে তল্লাশি হয়েছে, কৃষক আন্দোলনের খবর করার জন্য দু’টি পত্রিকার দফতরে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। গ্রেফতারের ভয় যে দেখানো হয়েছে কত সাংবাদিককে, বলে শেষ করা যাবে না।

এমন দমন-পীড়নের পাশাপাশি নানা সূক্ষ্ম কৌশলে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের প্রতি অনাস্থা তৈরি করার চেষ্টা চলেছে। স্মার্ট ফোনের প্রসারকে কাজে লাগিয়ে মোদী সমাজমাধ্যমে, রেডিয়োতে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি দেশবাসীর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছেন। একটাও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি, খোলাখুলি সাক্ষাৎকার দেননি কোনও সাংবাদিককে। অতীতে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশযাত্রার সঙ্গী হত দেশের নানা কাগজ-চ্যানেলের সাংবাদিকদের একটি দল। কিন্তু মোদীর সঙ্গী হয় কেবলমাত্র দূরদর্শন। তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করার সব রাস্তা বন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও শশী শেখর ভেম্পতি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মোদী সরাসরি জনসংযোগ করেন, তাই সাংবাদিক সম্মেলন এখন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তিনি যা বলেননি তা হল, গোটা সংবাদমাধ্যমকেই অপ্রাসঙ্গিক, নিষ্প্রয়োজন করে তোলার উদ্যোগ করা হয়েছে মোদী জমানায়।

Advertisement

যারা সরকারের কথা মেনে চলে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। ইমার্জেন্সির সময়ে লালকৃষ্ণ আডবাণী নাকি বলেছিলেন, সরকার নিচু হতে বলামাত্র কিছু সংবাদমাধ্যম হামাগুড়ি দিয়েছিল। এ বারেও তেমনই কিছু কিছু সংবাদ সংস্থা রাজার চাইতেও বেশি রাজভক্তি দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। টিকে থাকার জন্যই হোক, বা অন্য কোনও কারণে, তারা অকাতরে ভুল তথ্য, বিদ্বেষ বার্তা, ‘ফেক নিউজ়’ পরিবেশন করেছে। তারা যা করেছে, তা সাংবাদিকতা নয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ তার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ২০০২ সালে ভারতকে রেখেছিল আশি নম্বরে। ২০১৪ সালে, মোদী জমানার শুরুতে, ভারত ছিল ১৪০-এ। ২০২৪ সালে তার স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫৯। এতে আশ্চর্য কী?

তার মানে কি এই যে ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দীপটি নিবু নিবু, আর একটু দমকা হাওয়া এলেই চিরকালের মতো নিবে যাবে?

একেবারেই তা নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সৎ সাংবাদিকতা এখন ফেরার, চারিদিকে অসত্য আর কাপুরুষতার অন্ধকার। কিন্তু ঠাহর করলে দেখা যায়, এক ধরনের গেরিলা সাংবাদিকতা ক্রমশ মাথা চাড়া দিচ্ছে।

প্রখর ভাবে স্বাধীন কিছু ব্যক্তি সাংবাদিক, এবং সাংবাদিকদের নিজস্ব কিছু সংগঠন এগিয়ে আসছে সাংবাদিকতার জগতের শূন্যতা পূরণ করতে। তারা হয়তো খানদানি সংবাদ সংস্থা নয়, নামীদামি মিডিয়া কোম্পানির পরিচিতি তাদের নেই, কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতার প্রতি তারা দায়বদ্ধ। যে দায়বদ্ধতা হয়তো তারা অতীতে দেখেছে— কেবল ভারতে নয়, সারা বিশ্বে।

কলকাতার মেয়ে পুনম আগরওয়াল যথার্থ রিপোর্টারের মানসিকতার অনুসরণ করেই নির্বাচনী বন্ড কিনেছিলেন, এবং সেটির পরীক্ষা করিয়েছিলেন ফরেন্সিক ল্যাব-এ। তা না হলে বন্ডের ভিতরে লুকোনো ‘ইউনিক আইডেন্টিটি’ সংখ্যা, যা কেবল অতিবেগুনি রশ্মির নীচে দেখা যায়, তার খোঁজ মিলত না। সাম্প্রতিক কালে ভারতের সর্ববৃহৎ স্ক্যাম ধরাই পড়ত না।

নির্বাচনী বন্ডের খবর যখন সামনে আসতে লাগল, তখন বেশ কিছু ছোট, স্বাধীন মিডিয়া সংস্থা জোট বাঁধল। উদ্দেশ্য, আরও গভীর ভাবে অনুসন্ধান। এগুলি প্রধানত ডিজিটাল মিডিয়া। এ সংস্থাগুলি নিজেদের মানবসম্পদ একত্র করে তৈরি ছিল। নির্বাচন কমিশন নিজের ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ করামাত্র বন্ডের ক্রেতার সঙ্গে প্রাপকের এবং টাকার অঙ্ককে মেলানোর কাজটি দ্রুত করে ফেলল। তাদের প্রথম দিকের খবরগুলিতে লেখক পরিচিতি থাকত, ‘প্রোজেক্ট ইলেক্টোরাল বন্ড’।

সংবাদ সংস্থাগুলি সাধারণত প্রতিযোগী হলেও, সঙ্কটের মুখে সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভিয়েতনামে আমেরিকার সামরিক কার্যকলাপ বিষয়ে মিথ্যা প্রচার ফাঁস করতে নিউ ইয়র্ক টাইমস এগিয়ে এসেছিল। ‘পেন্টাগন পেপারস’ ১৩ জুন, ১৯৭১ প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। পাঁচ দিন পরে তা প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্ট। তার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আরও কুড়িটি দৈনিক তা প্রকাশ করতে শুরু করে। শেষ অবধি ৩০ জুন সুপ্রিম কোর্ট বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক রায় দিয়ে, এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের অনুমতি দেয়।

আরও সম্প্রতি ‘পানামা পেপারস’ (২০১৬) এবং ‘প্যারাডাইস পেপারস’ (২০১৭) ধনী, ক্ষমতাশালীদের প্রতারণাকে সামনে এনেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ নামে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক মঞ্চ এই তদন্ত করেছিল। ২০২০ সালে ইজ়রায়েলের ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও অন্যান্যের মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে দেওয়ার কেলেঙ্কারিও সামনে আনে এমনই একটি যৌথ প্রকল্প, ‘অর্গানাইজ়ড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্ট’। এগুলির শরিক ছিল নানা ভারতীয় সংবাদ সংস্থা, বা স্বতন্ত্র সাংবাদিক।

আজ টিভির সংবাদ চ্যানেলগুলি বিজেপির ক্ষমতা প্রসারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, সংবাদপত্রগুলি তদন্ত, বিশ্লেষণ, উত্তর দাবি করার দায় থেকে সরে এসেছে। যখন সত্য প্রকাশের উপায় নেই, তখন নীরব হয়ে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতি ক্ষমতাসীনের এই চ্যালেঞ্জের উত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে যৌথ সাংবাদিকতার মডেল। যদিও ভারতে এখনও টিভিই খবরের প্রধান উৎস, তবু ইউটিউবে সক্রিয় বেশ কিছু সাংবাদিক নিজেদের জন্য একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। রবীশ কুমার বা অজিত অঞ্জুমের দর্শক সংখ্যা প্রচুর। সম্প্রতি সংবাদ পরিবেশনায় অন্যতম তারকা হয়ে উঠেছেন ২৯ বছর বয়সি ধ্রুব রাঠী, সাংবাদিকতার পেশায় যাঁর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। স্বতন্ত্র সাংবাদিকদের মধ্যে পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা মোদী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গৌতম আদানির উপরে তীব্র আলো ফেলেছেন। বিভিন্ন ভাষায় এমন অনেক সাহসী, আপসহীন সাংবাদিক কাজ করে চলেছেন।

এঁরাই সাংবাদিকতার সেই নির্ভয় মুখ, যাঁরা একক বা যৌথ ভাবে সাবেক সংবাদের শূন্যস্থান পূর্ণ করছেন। প্রমাণ করছেন যে, সংবাদের প্রতিষ্ঠানগুলি যতই দুর্বল হোক, সাংবাদিকতার আত্মা এখনও সবল, সক্রিয়, এবং হারানো জমি ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই করতে তৈরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement