সিদ্দিক কাপ্পান
সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা একটি অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করেছিলেন যে, অতীতে বড় বড় দুর্নীতি, অপশাসনের খবর বেরোত, আর সাড়া পড়ে যেত। গুরুতর ফলাফল হত সেই সব খবরের। এখন তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ধারণাটাই সংবাদমাধ্যম থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
এমন সত্যকথনের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি খোলা চিঠিতে প্রবীণ সাংবাদিক পি সাইনাথ লিখেছেন, “হায়, আজ যে সব সাংবাদিকরা তেমন খবর করে, গুরুতর ফল ভুগতে হয় তাদেরই। এমনকি যারা স্রেফ সোজাসুজি রিপোর্ট করে, তাদেরও। যেমন উত্তরপ্রদেশের হাথরসে গণধর্ষিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে গ্রেফতার হন সিদ্দিক কাপ্পান, যিনি এক বছরেরও উপর রয়েছেন জেলে, জামিন পাচ্ছেন না, এক আদালত থেকে অন্য আদালতে মামলা ঘুরতে দেখছেন, দ্রুত ভাঙছে স্বাস্থ্য।”
ইতিহাস এমন ভাবেই এক-একটি মুখকে জাতির সঙ্কটের প্রতিনিধি করে তোলে। বছর দেড়েক আগে কে চিনত সিদ্দিক কাপ্পানকে? বছর বিয়াল্লিশ বয়স, পাতলা চুল, লেখেন কেবল মালয়ালি ভাষায়, শুধুই মাঝারি বা ছোট কাগজে, ওয়েবসাইটে। কেরলে বাড়ি বানাচ্ছেন, তা আট বছরেও শেষ হয়নি। গ্রেফতার যখন হন, পকেটে নাকি ছিল দুশো টাকা। অনেক বাঘা বাঘা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বর্তমান ভারত সরকার— বিনোদ দুয়া, মৃণাল পাণ্ডে, রাজদীপ সরদেশাই, কে নেই সে তালিকায়। কেবল ২০২১ সালেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে জেলবন্দি ছিলেন মোট ছয় জন সাংবাদিক। তবু সিদ্দিক কাপ্পান যেন সাংবাদিকতা সম্পর্কে রাষ্ট্রের অবস্থান নির্ণয়ের কম্পাস হয়ে উঠেছেন। কেন?
সম্ভবত তার একটি কারণ কাপ্পানের অ-বিশেষত্ব। তাঁর সম্পর্কে যা কিছু তাঁর বন্ধু-সহকর্মীরা বলেছেন, তা থেকে মনে হয় যে, যাঁদের কাছে সাংবাদিকতা প্রভাব-প্রতিপত্তি হাসিলের পথ নয়, নেহাতই সংসার চালানোর উপায়, তাঁদের এক জন কাপ্পান। দেশের অধিকাংশ সাংবাদিকের মতোই তিনিও রিটেনার, অর্থাৎ মাস-মাইনেটুকু মেলে, কাজের স্থায়িত্ব নেই। সাংবাদিকের পরিচয়পত্র নেই, কোনও একটা প্রেস ক্লাবের সদস্যপদকেই ব্যবহার করেন পরিচিতি বলে। একা একটা গাড়ি ভাড়া করার সাধ্য নেই। শেয়ার গাড়ি খুঁজতে হয়।
তাই সাংবাদিকের ‘স্পটে যাওয়া’ যদি পুলিশের বয়ানে ‘সদলবলে দাঙ্গা করতে যাওয়া’ হয়ে যেতে দেখলে ঘাম ছুটে যায় সাংবাদিকদের। পুলিশের দাবি, পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া নামে একটি কট্টর ইসলামি সংস্থার (যদিও নিষিদ্ধ নয়) সদস্য কাপ্পান। তিনি হাথরসে গণধর্ষণ কাণ্ডে ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর, অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন। পাঁচ হাজার পাতার চার্জশিটে পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স নানা তথ্যের মধ্যে পেশ করেছে কাপ্পানের নিজের লেখা ৩৬টি রিপোর্টও। চার্জশিটে বলা হয়েছে, ওই সব রিপোর্ট প্রমাণ করছে, কাপ্পান কেবলমাত্র মুসলিমদের উস্কানি দেওয়ার জন্য লেখেন, মাওবাদী এবং কমিউনিস্টদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল। যদিও দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা একটি রিপোর্টের ইংরেজি অনুবাদে দেখা যাচ্ছে, পিএফআই-এর সমালোচকদের বক্তব্যও রয়েছে। শাহিন বাগে নাগরিকত্ব আইনের অবস্থানকারীদের উপর কপিল গুর্জরের গুলিচালনাকে গান্ধীহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন কাপ্পান, পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার ব্যর্থতার জন্য দিল্লি পুলিশের সমালোচনা করেছেন, তা-ও প্রমাণ হিসেবে দাখিল হয়েছে। ভীমা-কোরেগাঁও সংক্রান্ত বা দিল্লির দাঙ্গা সংক্রান্ত রিপোর্ট, আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের সাক্ষাৎকার, সবই চার্জশিটে স্থান পেয়েছে। কাপ্পান পিএফআই-এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়েছেন। তাঁর দাবি, সাংবাদিক হিসেবে যেটুকু সম্পর্ক রাখার কথা কোনও সংগঠনের সঙ্গে, সেটুকুই রেখেছেন তিনি।
সত্য কী, তার বিচার করবে আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, চার্জশিট প্রস্তুতিতেই এত রকম আইন ভাঙা হয়েছে (যেমন, পুলিশি হেফাজতে নেওয়া বয়ানকে ‘প্রমাণ’ বলে পেশ করা) যে মামলা দাঁড়ানোর সুযোগ কম। কিন্তু তাতে কী? সন্ত্রাসের ধারায় মামলা, জামিনহীন দীর্ঘ বন্দিদশা, চিকিৎসাবঞ্চনা, চরিত্রহনন, এক জন সাংবাদিকের সঙ্গে এ সব ঘটলেই সকলের কাছে বার্তা পৌঁছে যায়— চুপ না করলে চুপ করিয়ে দেব।
বাস্তবিকই কাপ্পান গ্রেফতার হওয়ার পরে হাথরাসের ঘটনা নিয়ে শোরগোল থিতিয়ে এসেছে মিডিয়াতে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কর্মরত ‘ফ্রি স্পিচ কালেক্টিভ’-এর সম্পাদক গীতা শেসু বলেন, “গোড়া থেকেই হাথরসে সাংবাদিকদের গতিবিধি বন্ধ করতে চাইছিল যোগী আদিত্যনাথ সরকার, এলাকা ঘিরে রেখেছিল, নিহতের পরিবারকে চাপ দিচ্ছিল মুখ না খোলার জন্য। কিন্তু উনিশ বছরের দলিতকন্যার গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। কাপ্পান গ্রেফতারের পর প্রথমে নজর ঘোরে তাঁর দিকে, তার পর কাপ্পান আর হাথরস, দুটোই ক্রমশ সরে যায় মিডিয়ার নজর থেকে।” আজ সেই দলিতকন্যার পরিবার কী করছে, মামলা কী পর্যায়ে রয়েছে, তার খবর কোথায়?
গীতার মতে, সাংবাদিকের রিপোর্ট বেরোনোর পর তাঁর উপর নানা আক্রমণে নেমে আসার ঘটনা অনেক ঘটেছে ভারতে। কিন্তু কাপ্পান হাথরসে পৌঁছনোর আগেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, নিহত মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বলার, রিপোর্ট লেখার সুযোগই দেওয়া হয়নি তাঁকে। সেন্সরশিপ-এর এই ভয়ানক রূপ আগে দেখেনি ভারত। অনেক সাংবাদিক উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তবে কি যা ঘটছে তা রিপোর্ট করার কাজটাই অপরাধ বলে গণ্য হবে ভারতে? যেমন ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছে কাশ্মীরে?
সিদ্দিক কাপ্পানের মামলায় আরও যা দেখছে ভারত, তা হল সাংবাদিকের জাত-ধর্ম দিয়ে তার গ্রহণযোগ্যতার বিচার। সুপরিচিত সাংবাদিক সমর হরলঙ্কার লিখছেন, “সিদ্দিক কাপ্পান যে সব বিষয়ে লেখেন, তার অনেকগুলো নিয়ে আমিও লিখি, যেমন ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য, মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য। তিনি যে জেলে আছেন, আমি নেই, তার কারণ আমি হিন্দু, এবং ইংরেজিতে লিখি।”
সুতরাং প্রচলিত জাত-ধর্মের উপরে সাংবাদিকের ধর্ম বলে কিছু আছে কি না, কাপ্পানের মামলায় তারও বিচার হবে।