পুজোয় প্রতি বার কোনও না কোনও নতুন ফ্যাশন হানা দিয়ে থাকে। কোনও বার ‘বাহা’ শাড়ি তো কোনও বার ‘কাঁটা লাগা’ জিনস। এ বারে দেখা যাচ্ছে, নতুন জামা-জুতোর চেয়ে নতুন দলের ফ্যাশনটাই বেশি জোরালো। দল ভাঙানিয়া যে হুড়ুমতাল জোয়ার বেশ কয়েক বছর ধরেই নানা রাজ্যে দেখা গিয়েছে, বাংলায় ভোটের আগে কিছু মাস ধরে সেটা প্রবল ভাবে বহতা ছিল। পুজোর মুখে সে এসেছে ফিরিয়া, শুধু হাওয়ার বেগটা উল্টো দিকে। প্রায় যে গতিতে বছরের শুরুতে রোজ নিয়ম করে কেউ না কেউ বেসুর বাজছিলেন, শরতের খেয়ালি আকাশের মতো এখন তাঁরাই ঘরে ফেরার গান ধরেছেন। টাটকা নবাগত, অর্থাৎ নিজের সাবেক দল ছেড়ে প্রথম বার বাইরে পা রাখার ঘটনাও ঘটছে, ডান-বাম সব শিবির থেকেই। দেশ জুড়েই বেশ একটা ‘চলো বদলাই’ হাবভাব জাঁকালো হতে দেখা যাচ্ছে।
কে কোন রাজনীতি করবেন, কোন দল কাকে নেবে বা নেবে না, সেটা নিশ্চয় ঠিক করার অধিকার তাদের আছে। তাদেরই আছে। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে যখন সেটা একটা ‘ট্রেন্ড’-এর চেহারা নেয়, তখন তা ব্যক্তি বা দলের সীমা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাঠ্যবস্তু হয়ে ওঠে। সংবাদমাধ্যমের ভাষায় যাকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলীয় অন্তঃকলহ ইত্যাদি বলা হয়, ভারতীয় রাজনীতি সেই উনিশ শতক থেকে তার সাক্ষী। বলা ভাল, পুরোদস্তুর দল তৈরি হওয়ারও আগে, নির্বাচনী রাজনীতিরও আগে থেকে ভাঙন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন অবধি তার অনিবার্য পরিণতি বলে ভাবা হত দল বা সংগঠন ভেঙে নতুন দল বা সংগঠনের উৎপত্তিকে। জাতীয় কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট পার্টি, জনতা শিবির থেকে দ্রাবিড় নিশান— এই রেওয়াজের ব্যত্যয় হয়নি। উনিশ শতকে ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে তিন টুকরো হয়েছিল, নাটকের দল থেকে লিটল ম্যাগাজ়িন আজও ভেঙে লিটলতর হতে থাকে।
সুতরাং ভাঙাভাঙি আমাদের মজ্জাগত অভ্যাসের উত্তরাধিকার মাত্র। কিন্তু হালফিল সেই প্রবণতার স্বরূপে একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। একাধিক স্তরে ঘটেছে সেই পরিবর্তন। প্রথমত, মতবিরোধ বা বঞ্চনাবোধ এখনও দলত্যাগের একটা বড় কারণ বটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আর তেমন জরুরিও থাকছে না। দ্বিতীয়ত, দল ছেড়ে বেরিয়ে নতুন দল তৈরির ঝোঁকও খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না— ব্যতিক্রম ত্রিপুরা। যাঁরা দল ছাড়ছেন, নতুন দল তৈরির সাধ বা সাধ্য কোনওটাই সম্ভবত তাঁদের নেই। অতএব— একটা দল ছেড়ে সটান অন্য একটা দলে চলে যাওয়া। আবশ্যিক ভাবে সেই দলে যাওয়া, যে দলের অবস্থা, ছেড়ে আসা দলের চেয়ে মজবুত বলে মনে হচ্ছে, ভোটের বাজারে যে দলের অবস্থা সুবিধাজনক বলে আঁচ করা যাচ্ছে। দল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শেয়ার বাজারে টাকা খাটানোর মতো করে দলের ‘প্রসপেক্ট’-এর দিকটাই প্রধানত গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজনৈতিক অভিমুখ এবং মতাদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটা চলে যাচ্ছে পিছনে। এমনকি খাতায়কলমে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলেও যোগ দিতে সমস্যা থাকছে না। বা অন্য দিকে ভিন্মেরুর বাসিন্দাকে দলে নিতে অন্য পক্ষেরও আপত্তি হচ্ছে না।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, এ-দল থেকে ও-দলে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম ঘটল। বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে কংগ্রেস, বা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাতায়াতের একাধিক দৃষ্টান্ত সকলেই মনে করতে পারবেন। বাম শিবির থেকে অন্য দলে যাওয়ার নজিরও এই প্রথম নয়। কিন্তু সে সবের সঙ্গে আজকের একটা তফাত অবশ্যই আছে। যে ভাবে মুহুর্মুহু দলত্যাগ একটি হিড়িক বা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, সেটা এই আকারে আগে দেখা যায়নি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, যে ভাবে দলবদল প্রায় জলভাতের শামিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, চাইলেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে শিবির বদলে ফেলা যাচ্ছে, সেটা আগে এই ব্যাপকতায় নেতৃস্থানীয় স্তরে অন্তত ভেবে ওঠা যায়নি। ‘এই আছি এই নেই আমি যেন পাখি মেলে পাখনা’, এই সুর আর যা-ই হোক রাজনীতিকদের মুখে মানায় বলে আগে মনে হয়নি।
ইচ্ছেখুশি মতো ঘর বদলে নেওয়ার এই উর্বর জমি কী ভাবে তৈরি হল? অনেকেই বলতে চাইবেন, এই সংস্কৃতি অনেকখানি সাম্প্রতিক রাজনীতির নিজস্ব গতিবিধিরই অবদান। এ রাজ্যে তৃণমূল পুর এবং পঞ্চায়েত স্তরে যে দল ভাঙানিয়া খেলা শুরু করেছিল, বিজেপি সেটাই আরও বড় এবং ব্যাপ্ত আকারে বিভিন্ন রাজ্যে প্রয়োগ করেছে। ঘোড়া কেনাবেচা ক্রমশ একটা শিল্পের পর্যায়ে (আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি, দুটোই) উত্তীর্ণ হয়েছে। এ রাজ্যে ভোটের আগে সেই ফর্মুলাই তারা প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু ভোটের ফল বিরুদ্ধে যাওয়ায় খেলার দানও উল্টে গিয়েছে। অন্য দিকে, কংগ্রেসে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বের সঙ্কট চলছে। সাবেক কংগ্রেসি রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিতি তৈরি হয়েছে। সুতরাং একাধিক রাজ্যেই তাকে লোকবল হারাতে হচ্ছে।
ঘটনা-পরম্পরা বিচার করলে ছবিটা এ রকমই বটে। তবে আরও একটু তলিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, ভারতীয় রাজনীতিই সামগ্রিক ভাবে তার প্রকরণে, অনুশাসনে, কৌশলে এবং মূল্যবোধে একটা বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা দলীয় কার্যকলাপের মধ্যে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সংখ্যাগুরুবাদের উত্থান প্রকৃত প্রস্তাবে কেবল একটি নির্দিষ্ট দলের রাজনৈতিক অভীষ্ট নয়। তার চেহারাও শুধুমাত্র আগ্রাসী হিন্দুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ছলে বলে কৌশলে কলেবর বৃদ্ধি এবং বিরোধী পরিসরকে প্রায় দুরমুশ করে ফেলার আকাঙ্ক্ষাও তার অঙ্গ। সেই প্রকল্পে ময়দানি এলাকা দখলের পাশাপাশি ভার্চুয়াল সাম্রাজ্য বিস্তারও একটা বড় লক্ষ্য। সংখ্যার গুরুত্ব সেখানেও কিন্তু কিছু কম নয়।
বস্তুত, যে কোনও সমষ্টিগত প্রয়াসের ভাগ্যই ইদানীং খুব দ্রুত সংখ্যার আধিপত্যে নির্ণীত হচ্ছে। ‘ভাইরাল’ হয়ে ওঠাই তার সাফল্যের মাপকাঠি। এতটাই যে, সেখানে ‘কদাকার’-এরও বাজার আছে। উৎকট বেসুরো গানও এখন হিট করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক যেমন ট্রোল এবং কুকথার ফোয়ারা রাজনীতিতে এখন দক্ষতা বলে বিবেচিত হয়। কারণ, তা সংখ্যা আকর্ষণের শক্তি ধরে। শ্রোতা-দর্শক বাড়ে, খবর হয়, ফলোয়ারের ঝুলি ভরে ওঠে। এই আধারেই নতুন ধারার রাজনীতির জন্ম, যেখানে অমুক নেতা তমুক নেতার নামে কুৎসার বান ডাকিয়েছিলেন কিংবা অসংসদীয় আচরণে আপাত ভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন— এটা আর কোনও কালো ঢেরা নয়। বরং তাঁর ওই গালি দেওয়ার ক্ষমতাই তাঁকে অন্য শিবিরে সমাদর দেবে। ঠিক যে ভাবে এক দলের বাহুবলী অন্য দলেও সমীহ আদায় করে নেবেন।
রবি ঠাকুর যখন লিখেছিলেন: যে তোর মার ছেড়ে তোর হাতটি দেখে, আসল জানা সেই জানিছে— এ রকম পরিস্থিতির কথা নিশ্চয় তাঁর মাথায় ছিল না। কিন্তু কালেদিনে ভারতীয় রাজনীতির চেহারাটা এ রকমই দাঁড়িয়েছে। সেখানে রাজনীতি-বিযুক্ত ভাবেও রাজনীতির স্কিলের একটা গুরুত্ব ও বাজারদর তৈরি হয়েছে। পেশাদার চাণক্যের পাশাপাশি নেতানেত্রীরাও দল নির্বাচনে সমান ‘পেশাদারিত্ব’-এর পরিচয় দিচ্ছেন। ক’দিন বাদে একেই হয়তো রাজনীতিতে কর্পোরেট সংস্কৃতি বলে গালভরা তকমা দেওয়া হবে। বেশি মাইনে, উঁচু পদের হাতছানি যে ভাবে চাকরি বদলের ডাক দেয়, রাজনীতিতে দল বদলও হয়তো সেই ন্যায্যতার দাবিদার হয়ে উঠবে। একই দলে পড়ে থাকাটা হয়তো হয়ে উঠবে বাজারে চাহিদা না থাকার চিহ্ন!
রাজনীতির মধ্যে পারফরম্যান্সের একটা খুব বড় ভূমিকা বরাবর থেকেছে। ভাল সংগঠক, ভাল কৌশলী, ভাল বক্তা, ভাল তাত্ত্বিক, ভাল বাহুবলী— এ সবই দলের সম্পদ। কে বলতে পারে হয়তো সেই দিনও বেশি দূরে নেই, যখন ফ্রিলান্স ভিত্তিতে এ সবই ভাড়া দেওয়ার জন্য এজেন্সি তৈরি হবে! পেশাদার আইটি সেল, জনমাধ্যমের প্রভাববিস্তারক, ভোট ম্যানেজমেন্ট, প্রচারবিদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তার সূচনা ইতিমধ্যেই হয়ে যায়নি কি? নেতানেত্রীরাও যে ভবিষ্যতে তার অঙ্গীভূত হবেন না, তার ঠিক কী? ক্রিকেটারদের মতো রাজনীতিকদেরও নিলাম হবে হয়তো বা! সংবাদমাধ্যমে হয়তো লেখা হবে, প্রখ্যাত টুইটকারী অমুক এ বছর তমুক দলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন! উনি গডসের বদলে এ বার গাঁধীর উপাসক হবেন! অপ্রতিদ্বন্দ্বী টিভি-তার্কিক পুরনো দলেই থাকছেন! উনি এ মরসুমেও নেহরুকে গালি দেবেন! জনপ্রতিনিধির ভূমিকায় যথেষ্ট ভাল পারফর্ম করেননি বলে হয়তো এক বার দলই জুটল না কারও! তিনি তখন ভাববেন নিদেনপক্ষে ফেসবুক লাইভ করে কী ভাবে মুন্ডু ভাসিয়ে রাখা যায়! কাগেয়াপট্টির গেছোবাজারে ‘নেতানেত্রী সরবরাহ করিয়া থাকি’-র অফিসে পতপত উড়বে সর্বদলীয় পতাকা, সঙ্গে ট্যাগলাইন— দলে দলে যোগ দিন!