পুজোর কলকাতা মায়াবী আলোয় ভাসছে। নতুন জামা-জুতো পরে কাতারে কাতারে বেরিয়ে পড়েছে উৎসবমুখী মানুষ। জেলাগুলিতেওএকই চিত্র। অর্থাৎ, সবই হচ্ছে,যেমনটি হয়ে থাকে। কোথাও তার কিছু কম পড়েছে বলে বোধ হয় না। যে যা-ই বলুন, বাস্তব এটাই।
যদিও প্রতিবাদ বনাম উৎসব, আন্দোলন বনাম আড়ম্বর, শোক বনাম আনন্দ—এই ভাবে সমান্তরালে একটি ‘বিকল্প’ আবহ তৈরি হয়েছে। আছে মতভেদও। যদিও উৎসব আপাতত এগিয়ে। তবু মনে রাখতে হবে, যাঁরা উৎসবে শরিক হতে চান না, তাঁদের মতকে অবজ্ঞা বা অসম্মান করার, কিংবা কোনও রকম জোর খাটানোর অধিকার সমাজ কাউকে দেয়নি। উচিত-অনুচিত নিয়ে স্বাস্থ্যকর বিতর্ক হলে সেটা স্বাগত।
ঘটনা হল, কিছু দিন আগেও পুজোর বাজারের ভিড় অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম মনে হচ্ছিল। তখন প্রায় রোজই আর জি কর নিয়ে নাগরিক-প্রতিবাদ পথে নামছিল। নিয়মিত মোমবাতি মিছিল, রাত দখলের মতো কর্মসূচিতে বহু মানুষ শামিল হচ্ছিলেন। চিকিৎসকদের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে সামাজিক ক্ষোভের স্বর ছিল খুব চড়া। পুজোর বাজারে তার ছাপ পড়েছিল। তবে শেষ বেলায় কেনাকাটা থেকে পুজোর বাণিজ্যিক বিপণন সবই পুরনো ছন্দে ফিরে আসে। যা উৎসবের অনুসারী।
তবে এর মানে কি আর জি কর কাণ্ডের জঘন্য নির্মমতা এবং আনুষঙ্গিক ঘোটালা ভুলে যাওয়া? স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পরতে পরতে জমে থাকা দুর্নীতি, অদক্ষতা, অনাচার, অপকর্মের সব ময়লা কার্পেটের তলায় চালান করে দেওয়া? হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং পঠনপাঠনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা তিলমাত্র লঘু করে দেখা?
কখনও নয়। বরং পাপ এবং পাপী যে যেখানে, যে ভাবেই মুখ লুকোনোর চেষ্টা করুক, সকল শিকড় উচ্ছেদ না-হওয়া পর্যন্ত সমাজের তীক্ষ্ণ নজরদারি থাকবে। প্রতিবাদও বন্ধ হবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। আর সর্বদা দেখতে হবে চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল কেউ যেন ‘জাল’ কেটে গভীর জলে পালিয়ে থাকতে না পারে।
কিন্তু তার জন্য হিসাব কষে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিনগুলিকে অস্থির করতে চাওয়া কি একান্ত অনিবার্য ছিল? যাঁরা এই প্রকল্পের নেপথ্য-প্রযোজক বা যাঁদের সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সকলকেই এটা ভাবতে হবে। কারণ অধিকাংশ সাধারণ লোক এখন উৎসবকেই বেছে নিয়েছেন। সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ করা এখন তাই বিবেচনার পরিচায়ক।
আপনার-আমার সন্তানতুল্যরা অনশনে বসে থাকলে সেটা কখনও স্বস্তিজনক হতে পারে না। তাঁদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও খুব স্বাভাবিক। এই সময়ে এঁদের এক জনও যদি দুর্ভাগ্য ক্রমে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার ধাক্কা সকলের বুকে লাগবে। এ ক্ষেত্রে অনুজ যাঁরা অনশনে বসেছেন, বড়রা তাঁদের নিরস্ত করে আন্দোলনের অন্য পথ চেনাবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। হচ্ছে বিপরীত। বিশেষ করে উৎসবের মরসুমে জুনিয়রদের অনশনে বসিয়ে রেখে চাপ সৃষ্টি করার এ-হেন কৌশলকে তাই নিছক ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলন ভাবলে সেটা সম্ভবত অতি সরলীকরণ হবে।
অন্যায়ের অবসান তো সবাই চাইছেন। যাঁরা উৎসবে আছেন, এবং যাঁরা নেই— সবাই। কিন্তু সময়ের নিরিখে এখন এ ভাবে জনস্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা কি কিছুটা ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন? ভবিষ্যৎ বলবে। তবে তাঁদের মধ্যেও এই প্রশ্নে কিছুটা টানাপড়েন শুরু হয়েছে। যার কিছু ইঙ্গিতও মিলছে।
চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা আজ ঠিক দু’মাস পার করল। একটি কথা বার বার বলা হয়েছে, আর জি করে ওই নারকীয়তা দ্রুত সমাজের সর্বস্তরে যে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছিল, তা অভূতপূর্ব। বাংলায়, এমনকি দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও যার ব্যাপ্তি ঘটে। এর কোনও নজির মেলা সত্যিই দুষ্কর।
আবার এটাও লক্ষ করা গিয়েছে যে, এই সামাজিক আন্দোলনের শুরুতে কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা খবরদারি ছিল না। সেই জন্য প্রতিবাদও বেশি জোরালো এবং বিস্তৃত হতে পারে। অনেকের মতে, এই নাগরিক প্রতিবাদের পিছনে শাসকের বিবিধ কার্যকলাপ সম্পর্কে সামগ্রিক ক্ষোভও কাজ করেছে। আর জি করের ঘটনা কিছুটা ‘অনুঘটক’ হয়ে অনেক ‘পথ’ খুলে দেয়! কিন্তু এখন পরিস্থিতি যে ভাবে মোড় নিচ্ছে, তাতে আন্দোলনের কিছু ফাঁকফোকরও সামনে চলে আসছে।
প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারেরা সরকারকে, আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, স্নায়ুযুদ্ধে টেনে আনতে পেরেছিলেন। টানা কয়েকদিন সেই চাপ ধরে রেখে আন্দোলনকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে যে ভাবে ধাপে ধাপে নিজেদের কতকগুলি উল্লেখযোগ্য দাবি আদায় করে নেন, তার নেপথ্যে কুশলী রাজনীতির ছায়া অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বার সেই ছায়া যথেষ্ট ‘অবয়ব’ পেতে শুরু করেছে। পুজোর মধ্যে অনশন-আন্দোলনের কর্মসূচি বস্তুত সেই রাজনীতির ফলিত রূপ।
জানি না, এখনই উৎসবের দিনগুলিতে ওই ‘অনশন-ব্রত’ পালনের ‘পুণ্য’ কার খাতায় কী ভাবে জমা পড়ল! অথবা, কার কী ‘গুণ’ এতে বিকশিত হল! তবে বলা যায়, কর্মসূচিটি নিয়ে আন্দোলনের অভ্যন্তরে বিভাজন ক্রমশ আকার নিচ্ছে।
ভেবে অবাক লাগে যে আর জি কর এমন আলোড়নকারী আন্দোলনের উৎসস্থল, যেখানকার জুনিয়র ডাক্তার ‘নেতারা’ প্রথম প্রতিবাদের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন, অনশনে তাঁদের কে বা ক’জন অংশগ্রহণ করবেন, তা স্থির করতে এখন তিন ঘণ্টা ধরে চিকিৎসকদের যৌথ ফ্রন্টকে মিটিং করতে হয়! তার পরে ফ্রন্টই ‘ঠিক’ করে দেয়, কাকে আর জি কর থেকে অনশনের মঞ্চে রাখা হবে! জানা গিয়েছে, অনশনকে এখনই একমাত্র বিকল্প বলে মেনে নিতে আর জি করের একাংশ নাকি নারাজ। সহজ যুক্তিতে মনে হচ্ছে, সমস্যার বীজ এখানেই।
অনশনে বসার ‘বাছাই’ তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয় আর জি করের মাত্র এক জনকে! মেডিক্যাল কলেজের তিন জন, এনআরএস এবং এসএসকেএমের এক জন করে। আর যাদবপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের এক জন। গুঞ্জনে রয়েছে আন্দোলনের উপর বাম ও অতি-বাম রাজনীতির প্রভাব।
যত দূর জেনেছি, রবিবার রাতে ধর্মতলার অনশন স্থলে আর জি করের এক জুনিয়র ডাক্তার নেতার সঙ্গে অপর একটি কলেজের আর এক নেতার খানিক মতভেদ হয়। তাঁরা দু’জনেই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে লোকসমাজে অতি পরিচিত। আর জি করের নেতা সেখানে বলেন, ‘ঐক্যের স্বার্থে’ তিনি মঞ্চের কাছে এলেও উঠবেন না বা বেশিক্ষণ থাকবেন না। আন্দোলনের উপর এর কতটা কী প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে, বলতে পারব না। তবে এটা পরিষ্কার, আন্দোলনের ভিতে এই ভাবে ঘা পড়ছে। আন্দোলন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লে কার লাভ!
অনশনকারীরা যে সব দাবি জানিয়েছেন, নীতিগত ভাবে সেগুলি অসঙ্গত নয়। যদিও সরকারি নিয়মকানুন মেনে রাতারাতি সবটা পূরণ করা কত দূর সম্ভব, সেটাও বোধ হয় ভেবে দেখার। এখানেও আবার সেই বিবেচনাবোধের প্রশ্ন। আসলে যতক্ষণ আমরা একটি ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি, ততক্ষণ কোথাও তার উপর একটু আস্থা না রেখে তো উপায়ও নেই। সে ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া ন্যূনতম সময়ভিত্তিক আশ্বাসে নির্ভর করে ক’টা দিন দেখলে ক্ষতি কী? পরবর্তী পদক্ষেপ তো হাতেই থাকছে।
অন্যথায় ‘এক্ষুনি চাই’ বলে অহেতুক শরীরপাত! সেই সঙ্গেই হয়তো ‘ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হানো’ বলে গা-গরম করানো। যেটাই হোক, আখেরে ফল ‘ভোগ’ করতে হবে এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিমান তরুণ-তরুণীকে। ‘কেরিয়ার’ গড়ার জন্য যাঁদের সামনে এখনও অনেকটা পথ।