স্বপ্ন দেখছি... তিন তিনটে রুপোলি গোলক ঝলমল করছে ঢালু আকাশে/ যার নিঃশ্বাস যতদূর পৌঁছয় ততদূর টলে পড়ছে মানুষ।” স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। আজ দুঃস্বপ্ন দেখছেন ভারতীয় চিকিৎসককুল। তিনটে গোলকের নিঃশ্বাসে ক্রমাগত টলে পড়ছে ভারতের স্বাস্থ্য, আয়ুষ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বৈদ্যসেতু। হীরকরাজার আজ্ঞাবাহী সংস্থা এ বার চিকিৎসকের মৌলিক শপথকে পর্যন্ত নতুন করে লিখতে চাইছে গেরুয়া কালিতে। এত কাল প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে পরিচিত হিপোক্রেটিসের নামে প্রবর্তিত, পরে জেনিভায় সংক্ষিপ্ত, ‘হিপোক্রেটিসের শপথ’ পাঠ করে পেশায় প্রবেশ করতে হত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ শেষ করা ডাক্তারদের। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, বাক্যগুলো ‘অমৃত কালের’ ভারতের উপযোগী নয়। প্রস্তাব এসেছে, ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বাতিল হোক, তার বদলে আসুক ‘চরক শপথ’।
‘নব্য ইতিহাস’ লিখতে আগ্রহী হীরকরাজের উজিররা সম্ভবত ‘চরক সংহিতা’ পড়েননি, ‘সুশ্রুত সংহিতা’-ও নয়। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা খ্যাতনামা গবেষকদের গবেষণাপত্র বা বইপত্র দূরের কথা! সবচেয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয়েছে যে খ্যাতনামা দার্শনিক তথা ইতিহাসবিদের নেতৃত্বে, তিনি বঙ্গসন্তান দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত ইংরেজি বই, অথবা সংক্ষিপ্ত বাংলা বই ওল্টালে বোঝা যায়, ‘মহর্ষি চরক’ বলে কোনও শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রাচীন ঋষির কল্পনা হাস্যকর। “চরক বলতে ভ্রাম্যমাণ, যাঁরা চারণ করে বেড়ান।” হিপোক্রেটিস এক ব্যক্তির নাম, কিন্তু ‘চরক’ বলে নির্দিষ্ট কেউ ছিলেন না, প্রাচীন ভারতে ভ্রাম্যমাণ ভিষকের দল গোষ্ঠীগত ভাবে চরক নামে পরিচিত ছিলেন। তেমনই, ‘সুশ্রুত’ বলতে বোঝায় শল্যচিকিৎসায় দক্ষ ভিষকের দল, গুরুর কাছে শোনা (শ্রুত) বিদ্যা স্মৃতিতে রেখে যাঁরা অস্ত্রোপচার করতেন। ‘চরক সংহিতা’-ও ব্যক্তিবিশেষের লেখা নয়, বহুকাল ধরে নানা চরকের অবদানে পরিবর্ধিত ও সমৃদ্ধ— এমনই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন দেবীপ্রসাদ ও তাঁর নেতৃত্বে কাজ করা গবেষকরা। কিছু ব্রিটিশ ও ওলন্দাজ ইতিহাসবিদের মূল্যবান কাজেও এই তথ্যের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। অতএব, যদি ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারের বাসনা থেকে চরকের শপথবাক্য পাঠ করানোর উদ্যোগ করা হয়, তা হলে তার গোড়ায় মস্ত গলদ।
ইতিহাস যাঁদের একটি গোষ্ঠী মনে করে, সেই চরক অর্থাৎ ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকদের জায়গায় একটি কাল্পনিক ব্যক্তির মূর্তি খাড়া করার উদ্দেশ্য কী? সম্ভবত জাতীয়তাবাদের বোধ উস্কে দেওয়া, যা থেকে জন্ম নেয় ‘ব্যাদে সব আছে’ গোছের অসার ধারণা। মানুষকে প্রাচীন ভারতের ‘উন্নততর’ বিজ্ঞানের কল্পকাহিনির গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায়। পুষ্পকরথ প্রাচীন ভারতের এরোপ্লেন, গোমাতার শরীরে স্বর্ণগ্রন্থি, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি করা হাতির শুঁড়— এমন অপবিজ্ঞান নির্বিচারে বিশ্বাস করানো সহজ হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ বদলে দিয়েছে স্কুল-কলেজের ইতিহাসের পাঠ্য, এ বার হাত পড়েছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের রীতিনীতিতেও।
হিপোক্রেটিসের শপথকে পাশ্চাত্য আমদানি বলে দেখলে ভুল হবে। খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগের এই শপথবাক্যে নানা দেশের চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞরা নানা সংশোধন করেছেন, যাতে তা আধুনিক মূল্যবোধের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই শপথবাক্য বস্তুত সারা বিশ্বের চিকিৎসকদের মধ্যে যোগসূত্র। চিকিৎসাবিজ্ঞান কোনও ভৌগোলিক সীমানা মানে না। ভারতীয় চিকিৎসকরা কেন বিচ্ছিন্ন হবেন? আজ চিকিৎসকদের শপথ নিতে হয়, “আমি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে অসুস্থ বা আহত মানুষকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করব।” কোনও প্রাচীন বয়ানে (ঐতিহাসিক বা কল্পিত) এই মনোভাব মিলবে কি? আঞ্চলিক ভাষায় শপথ নেওয়ার প্রস্তাবের পিছনে রয়েছে উদার মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুচতুর কৌশল ।
হিপোক্রেটিসের শপথের নৈতিকতা বা প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ এপিজে আবদুল কালাম সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে ডাক্তারদের ‘হিপোক্রেটিসের শপথ’ পাঠ করিয়েছিলেন। আজ যে সেই শপথকে খারিজ করার ইচ্ছে জাগছে, তার শিকড় হয়তো অন্যত্র। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে বিকল্প চিকিৎসা রীতি, অর্থাৎ ‘আয়ুষ’-কে মেলানোর চেষ্টা মোদীর ভারতে বার বার দেখা গিয়েছে। আয়ুর্বেদ বা হোমিয়োপ্যাথির স্নাতকদের সামান্য সময়ের ‘ব্রিজ কোর্স’ পড়িয়ে এমবিবিএস ছাত্রদের সমান দক্ষতাসম্পন্ন বলে দাবি করার চেষ্টা আপাতত থমকে। সব ধরনের চিকিৎসকদের একই ছাতার তলায় আনার আরও একটি পদ্ধতি হিসাবে ‘চরক শপথ’-এর উদ্ভাবন কি না, প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর রাজ্য সম্পাদকের প্রশ্ন, এ কি ডাক্তারকুলে ধর্মীয় বিভাজন উস্কে দেওয়ার চেষ্টা? কাফিল খানের মতো মানবপ্রেমী ডাক্তারকে ‘দেশদ্রোহী’ বানিয়েছে যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা থেকেই ‘চরক শপথ’-এর উদ্ভব, দেশ জুড়ে ডাক্তারদের মধ্যে এখন গভীর আশঙ্কা।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ