কোয়ান্টাম মহাযজ্ঞে যোগ দেওয়ার আগে যা ভাবা প্রয়োজন
Quantum Computers

যতটুকু সাধ্যের মধ্যে

আমার-আপনার পক্ষে যা কঠিন, আমাদের ব্যবহারের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষেও সেটা কঠিন— অর্থাৎ, যে কম্পিউটার ক্লাসিক্যাল ফিজ়িক্স বা ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। বাড়ির বা অফিসের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বা স্মার্টফোন, সবই ক্লাসিক্যাল।

Advertisement

শুভময় মৈত্র

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:২০
Share:

মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটরে নয়, খাতা-কলমে তিনটে অঙ্ক কষবেন? প্রথমে গুণ, ২৫১ কে ৪৩৩ দিয়ে। তার পর ভাগ, ১১৭৭৩৯ কে ২৮১ দিয়ে। শেষ অঙ্কটি হল ৬৮৩৫৯-কে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা, অর্থাৎ কোন কোন সংখ্যা গুণ করলে এই সংখ্যাটি পাওয়া যায়, তা নির্ণয় করা। অঙ্ক তিনটে কষলে দেখবেন, প্রথম দু’টির তুলনায় তৃতীয়টিতে সময় লাগছে অনেক বেশি। অর্থাৎ, দু’টি মৌলিক সংখ্যা দেওয়া থাকলে তাদের গুণফল বার করা যত সহজ, শুধু গুণফল দেওয়া থাকলে সংখ্যাগুলিকে খুঁজে বার করা তুলনায় কঠিন।

Advertisement

আমার-আপনার পক্ষে যা কঠিন, আমাদের ব্যবহারের ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষেও সেটা কঠিন— অর্থাৎ, যে কম্পিউটার ক্লাসিক্যাল ফিজ়িক্স বা ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। বাড়ির বা অফিসের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বা স্মার্টফোন, সবই ক্লাসিক্যাল। আজকের ডিজিটাল লেনদেনের যুগে কম্পিউটারের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। সেই সুরক্ষার একটা বড় অংশ ক্রিপ্টোলজি বা সঙ্কেতবিদ্যার এই তত্ত্ব থেকে আসে যে, গুণ সহজ, কিন্তু উৎপাদক বিশ্লেষণ শক্ত। ধরুন, কম্পিউটারের নিরাপত্তা ভেদ করতে দু’হাজার অঙ্কের একটি সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে হবে, যা দু’টি এক হাজার অঙ্কের মৌলিক সংখ্যার গুণফল। এটা চটজলদি করতে দুনিয়ার তাবড় ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার ফেল করবে। এবং, সেই কারণেই আমাদের কম্পিউটারগুলি সুরক্ষিত। সহজে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করবে, এমন কোনও কম্পিউটার তৈরি হলে কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা চৌপাট।

পদার্থবিদ্যার আধুনিকতর অংশ কোয়ান্টাম ফিজ়িক্স-এর সূত্র ব্যবহার করে তৈরি করা সম্ভব এমন কম্পিউটার, যা খুব সহজেই উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে পারবে যে কোনও সংখ্যাকে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে, উনিশশো নব্বইয়ের দশকেই গণিতবিদ পিটার শোর কথাটি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, যে তিন দশকে গোটা দুনিয়ায় কম্পিউটার ও মোবাইল-নির্ভরতা চূড়ান্ত হয়েছে, সেই গোটা পর্ব ধরেই বিজ্ঞানীরা জানতেন যে, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের নিরাপত্তা ব্যূহ বিধ্বস্ত হতে পারে যে কোনও সময়। তবু কেউ সাবধান হননি, কারণ বিশ্ব জুড়ে ধারণা ছিল যে, সস্তার কোয়ান্টাম কম্পিউটার খুব সহজে বানানো যাবে না।

Advertisement

সস্তায় না পেলে নাহয় আমি-আপনি কিনতে পারব না কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কিন্তু, সাইবার সন্ত্রাসীরা? অথবা, শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা? তাঁদের হাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এলে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান কি চুপ করে বসে থাকবেন? কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা ভারতে শুরু হয়েছে গত সহস্রাব্দেই, খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজও হচ্ছে— কিন্তু, ফলিত বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ২০২০ সালের বাজেটে প্রথম বার কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর গবেষণার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হল— পাঁচ বছরের জন্য ৮,০০০ কোটি টাকা। তার পর কোভিড এল। পরবর্তী তিন বছর আর এ প্রসঙ্গে উচ্চবাচ্য শোনা গেল না। ২০২৩-এর এপ্রিলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নতুন করে ধার্য করল ৬,০০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। দেশ জুড়ে শুরু হল ন্যাশনাল কোয়ান্টাম মিশন, বা সংক্ষেপে এনকিউএম। আপাতত দেশের বেশ কয়েকটি অগ্রগণ্য প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হতে চলেছে সেই কাজ। পরিকল্পনা আগামী আট বছরে দেশকে এই বিষয়ে প্রস্তুত করে তোলা।

গোমূত্রে সোনার খোঁজ অথবা বৈদিক বিজ্ঞান চর্চার চেয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর গবেষণায় অর্থবরাদ্দ করা ভাল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার বানানোর ক্ষেত্রে ভারতের যে সীমাবদ্ধতা আছে, এ প্রসঙ্গে সে কথা আসবে। অন্য দেশে বানানো যন্ত্রাংশ জুড়ে আমরা কম্পিউটার তৈরি করতে পারি, কিন্তু যে সেমিকন্ডাকটর চিপ দিয়ে কম্পিউটার বানানো হয়, এখনও ভারতে তা তৈরি হয় না। কেন, তার অনেকগুলো কারণ আছে। মোট কথা হল, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের চিপ বানানোর প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও এক লাফে খোলাবাজারে বিক্রি করার মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ বানিয়ে ফেলার খোয়াবটি নিতান্তই অবাস্তব। তার পিছনে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করার পর হাতে পেনসিল পড়ে থাকলে নেতাদের ধৈর্যচ্যুতি হবে না তো?

তার চেয়ে, গবেষণার যে ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পক্ষে সহজে বিশ্ববাজারের দখল নেওয়া সম্ভব, সে দিকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেমন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যদি সত্যিই জনপ্রিয় হয়, সে ক্ষেত্রে তার উপরে প্রোগ্রাম লিখতেই হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরেই সেই সব যন্ত্রে প্রাথমিক প্রোগ্রাম লেখার সুযোগ আছে যথেষ্ট। এই জায়গায় অবশ্যই ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের দুর্দান্ত কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা এবং সুযোগ আছে।

সুরক্ষাবিষয়ক যে সমস্ত হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার, তার ভিতরে সত্যিকারের কী হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারা আমাদের দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জরুরি। বিদেশ থেকে কেনা যন্ত্র যে আমাদের দেশের গোপন তথ্য পাচার করে দেবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনে তথ্য হাতানোর সম্ভাবনা ক্লাসিক্যাল কমিউনিকেশনের চেয়ে বেশি— কারণ এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট বলে একটি বিষয়, যা বহু দূরের দু’টি কণার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ ঘটাতে পারে। অন্য একটা সুবিধা অবশ্য আছে। ক্লাসিক্যালে যখন তখন যে কোনও তথ্য টুকে ফেলা যায় (সে তথ্য বোঝা গেল কি না সে পরের কথা), কোয়ান্টামে সেই বিষয়টি অজানা কণার ক্ষেত্রে অসম্ভব। ফলে তারের মধ্যে দিয়ে ক্লাসিক্যাল বিট-এর বদলে কোয়ান্টামের কিউবিট গেলে সুবিধা বেশি। সমস্যা হল, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের বিভিন্ন চিপের মতোই কোয়ান্টামের দুনিয়াতেও বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হবে ভারতকে। সেই যন্ত্রাংশের ভিতরে কী হচ্ছে, তা বুঝতে হবে। এই জায়গায় জাতীয় কোয়ান্টাম মিশনে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।

সর্বোচ্চ গুণমানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার উৎপাদনের ক্ষমতা ভারতের এই মুহূর্তে নেই। আগামী এক দশকে তৈরি হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কাজেই, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী গবেষণার পিছনে টাকা খরচ করার সময় মনে রাখতে হবে যে, বিদেশে কী হচ্ছে তা জানা, এবং দেশের গবেষণাগারে সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করা। তার জন্য প্রভূত অর্থবরাদ্দ করা এবং, সহযোগী দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক শোনা যায় খুবই ভাল— সেই সুবাদে জাতীয় কোয়ান্টাম মিশনের জন্য আমেরিকান সহযোগিতা পাওয়ার কথা ভারত ভাবতেই পারে।

সব শেষে কাজের কথাটা বলি। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে যে সুরক্ষাসংক্রান্ত হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার চলে, তার কিছু মূলগত পরিবর্তন করলেই কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আক্রমণ রুখে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, খুব তাড়াতাড়ি উৎপাদকে বিশ্লেষণ করে যেমন বর্তমানের সুরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দিতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, আবার তেমনই বিশ্ব জুড়ে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারেই অন্য ধরনের গাণিতিক গবেষণার মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখার উপায় প্রস্তুত। আধুনিক এই প্রযুক্তিকে বলে পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি। অর্থাৎ, কারও হাতে যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটার এসেও যায়, তখন শুধুমাত্র ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে এবং বর্তমানে হাতের কাছে থাকা পরিকাঠামো ব্যবহার করে ডিজিটাল দুনিয়া কী ভাবে সুরক্ষিত থাকবে, সেই পথ আজকের দিনে নির্ধারিত, এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। অগস্ট মাসে তার নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডও ঠিক হয়ে গেছে।

এর রূপায়ণে খরচ আদৌ বেশি নয়। এ বিষয়ে ভারতেও অল্প কিছু গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদ কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তার পরীক্ষামূলক রূপায়ণের জন্যে খরচ হতে পারে বড় জোর পাঁচশো কোটি টাকা। তার পর গোটা দেশ নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারে সেই প্রযুক্তি। এর জন্য দু’এক বছরের বেশি সময়ও লাগার কথা নয়। ৮,০০০ কোটি টাকা খরচ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ মহাযজ্ঞ চলতেই পারে। কিন্তু ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এর পরিকাঠামোতেই আন্তর্জাতিক স্তরের সুরক্ষা যখন হাতের কাছেই প্রস্তুত, সেটাকে অবজ্ঞা করাও ঠিক হবে না।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।

মতামত ব্যক্তিগত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement