ক্ষমতাবান: সমরখন্দে এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। পিটিআই
গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের আবির্ভাব ঘটছে। এমনই প্রবল ভাবে যে, প্রশ্ন উঠছে, গণতন্ত্র কি তবে বিপন্ন? গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি বহুমাত্রিক, যার অন্যতম মাত্রা হল, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের যে কোনও নাগরিকের কিছু বিশেষ অধিকারের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা। নির্বাচিত সরকার সংবিধানের সম্মান বজায় রাখছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব দেশের বিচারবিভাগ আর সংবাদমাধ্যমের। তাই কোনও দেশে এই দু’টি স্তম্ভ স্বাধীন আর শক্তিশালী না হলে সেই দেশকে গণতন্ত্র বলা যায় না।
পৃথিবীর সব দেশেই এই দু’টি বিভাগ চালান অনির্বাচিত কিন্তু বিশেষ ধরনের নেতৃত্বগুণসম্পন্ন কিছু মানুষ, ইংরেজিতে যাঁদের ‘এলিট’ বলা হয়। বৃহত্তর অর্থে এলিট শ্রেণি হিসাবে রাজনীতির বাইরে থাকা ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীকে দেখা যেতে পারে। গণতন্ত্রকে বলা যেতে পারে এই এলিটদের সঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। স্বভাবতই সব দেশে এই প্রক্রিয়া এক রকম নয়। কোন দেশ জনপ্রতিনিধিদের, আর কোন দেশ অনির্বাচিত এলিটদের বেশি ক্ষমতা দেবে, সেটা দেশের ইতিহাস আর পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। এই সব কারণে কোনও দেশে ঠিক কতখানি গণতন্ত্র আছে, সেটা বলতে গেলে অনেক কিছুই হিসাবের মধ্যে আনতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে উন্নত দেশগুলিতে সাধারণ মানুষ সরকারের থেকে নানান সুযোগ সুবিধা পেতেন। অধিকাংশ উন্নত দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে বেকারভাতা দেওয়া হত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর পরিবহণে ভর্তুকি ছিল প্রচুর। কিন্তু, সব মিলিয়ে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সহানুভূতিশীল সরকারের মেলবন্ধন উন্নত দেশগুলিতে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্ত করেছিল সেই সময়ে।
আশির দশক থেকে বিশ্বায়ন পাল্টে দিল এই বনিয়াদ। যে-হেতু অনুন্নত দেশগুলিতে শ্রমের মূল্য অনেক কম, তাই উন্নত দেশের শিল্পপতিরা তাঁদের কলকারখানা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলেন আরও বেশি লাভের আশায়, যার অবধারিত ফল নিজেদের দেশের শ্রমিকদের কাজ হারানো। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর থেকে উন্নত দেশগুলির শিল্পপতিদের আর দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে খুশি রাখার প্রয়োজন ছিল না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলেও শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি, বরং কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কমেছে অন্যান্য সুযোগসুবিধা। উল্টো দিকে আবার কর্মসংস্থানের নাম করে পৃথিবীর সব দেশে শুরু হয়েছে শিল্পপতিদের তুষ্ট রাখতে কর কমানোর এবং নানান সুযোগসুবিধা দেওয়ার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উন্নত দেশগুলিতেও আস্তে আস্তে হ্রাস পেয়েছে জনসাধারণের জন্য সুযোগসুবিধার পরিমাণ।
গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। কিন্তু নির্বাচনে জয়ের জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই প্রয়োজন অর্থানুকূল্যের। সেই সিন্দুকের চাবি শিল্পপতিদের হাতে। উন্নত দেশগুলিতেও সরকার তাই শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে গিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর খুব একটা চেষ্টা করেনি, যার বিষময় ফল বহু সাধারণ লোকের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির উপরেই আস্থা হারিয়ে ফেলা। উন্নত দেশগুলিতে কর্তৃত্ববাদের আবির্ভাবের জন্য তাই এলিটদের সর্বগ্রাসী লোভই দায়ী।
দরিদ্র দেশগুলিতে বিশ্বায়নের সর্বাধিক সুফল এখনও অবধি ভোগ করেছেন এলিটরা। তাঁদের একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী। বিশ্বায়নের ফলে তাঁদের বাজার ও উপার্জন বেড়েছে বিপুল হারে। এ সব দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির এলিটরা হলেন উন্নত মানের চাকরিজীবী। বিশ্বায়নের ফলে এই শ্রেণির প্রচুর লোক বহুজাতিক সংস্থায় কাজ পেয়েছেন, পেয়েছেন বিদেশি মুদ্রায় উপার্জনের সুযোগ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তাই এই দুই দল এলিটকেই রাজনৈতিক ভাবে অনেক বেশি প্রভাবশালী করে তুলেছে।
প্রথম দলটি চায় দেশের মাটিতে তাদের সংস্থার একচেটিয়া আধিপত্য। সে জন্য এদের চাই এমন নেতা যিনি দরকারে উন্নত দেশের বিদেশিদের চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে পারবেন। দ্বিতীয় দলটি উন্নত দেশের লোকদের সঙ্গে বহু দিন পাশাপাশি কাজ করার কারণে নিজেদের তাঁদের সমান মনে করে, অথচ ক্ষমতার চাবিকাঠি এখনও উন্নত দেশের লোকদের হাতে। এই দলের অনেকেই তাই চান ‘শক্তিশালী’ স্বদেশি নেতৃত্ব। মনে রাখতে হবে যে, এই দলটি অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হলেও, তাঁদের সারা দিন কেটে যায় কর্পোরেটের সোনার খাঁচায়। খাঁচা ব্যাপারটাতে তাই তাঁদের খুব আপত্তি নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সমর্থনের মূল ভিত্তি তাই এই দুই শ্রেণির এলিটরা। কোনও উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত না হলে কর্তৃত্ববাদী নেতা জনগণকে খুব একটা পাত্তা দেন না। কিন্তু, দেশে গণতন্ত্র থাকলে এবং সেই দেশে নিয়মিত নির্বাচন হলে কর্তৃত্ববাদী নেতা চেষ্টা করবেন জনসাধারণের কিছুটা হলেও উন্নতি করে তাদের নিজের সঙ্গে নেওয়ার। প্রযুক্তির উন্নতির জন্য অনেক সরকারি সুবিধা এখন সরাসরি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। জনগণকে এই ধরনের কিছু সুবিধা দিয়ে আর সমাজমাধ্যমের সাহায্যে ক্রমাগত ব্যক্তিপুজো করে তাঁরা চেষ্টা চালাবেন নেতাকে দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে নির্বাচনে জিতে ভিতর থেকে গণতন্ত্রের ভিত্তিটিকে দুর্বল করে দেওয়ার। উন্নত বা উন্নয়নশীল, সব দেশেই এই ভিত্তিকে দুর্বল করার প্রধান অস্ত্র ঘৃণা। কখনও এই ঘৃণার লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কখনও অনুন্নত দেশ থেকে আসা নাগরিকেরা, কখনও বা অন্য কোনও দেশ। কর্তৃত্ববাদী নেতারা তাই প্রবল জাতীয়তাবাদী।
আসলে এই নেতারা চান গণতন্ত্রের মানবিক অধিকারের দিকটিকে যতখানি সম্ভব দুর্বল করতে। এক বার ক্ষমতায় এসে এই কাজটি করতে সফল হলে যে কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উত্থানকে অনেকখানি রুখে দেওয়া সম্ভব। গণতন্ত্রের পরিসরের মধ্যে এই নেতাদের উত্থান তাই সেই সব দেশের গণতন্ত্রের এক প্রবল সঙ্কটের ইঙ্গিত।
তা সত্ত্বেও, কর্তৃত্ববাদ আর একনায়কতন্ত্র কিন্তু এক নয়। একনায়ক বলতে বোঝায় সম্পূর্ণ ভাবে নিজের ইচ্ছায় দেশ চালানো কোনও নেতা। তাঁরা ক্ষমতা বজায় রাখতে দেশের জনগণের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করেন, চোখ রাঙিয়ে ছাড়া কথা বলেন না, দেশের মানুষকে চূড়ান্ত শোষণ করেন ইত্যাদি। আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে এমন অনেক একনায়ক বহু দিন ধরে রাজত্ব করেছেন।
বর্তমান পৃথিবীর কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সবাইকে এখনই একনায়ক বলাটা ঠিক হবে না। এঁদের অনেকেই দেশের আর্থিক উন্নতি ঘটিয়েছেন। পুতিনের আমলে রাশিয়ায় দেশবাসীর আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। চিনেও অসংখ্য মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছেন একাধিক কর্তৃত্ববাদী নেতার রাজত্বে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশেও। সাধারণ ভাবে বিরোধীদের প্রতি নির্দয় হলেও, এঁদের আসল লক্ষ্য দেশবাসীকে শোষণ করা নয়, বরং সব ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের সমর্থকদের প্রতিষ্ঠিত করে উন্নত দেশের এলিটদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া। এই কাজটি কিন্তু দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে করা সম্ভব নয়। তাই তাঁদের অনেকেই চান অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলির সামান্য বিকেন্দ্রীকরণ করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে। কেন্দ্রীয় স্তরে মুক্ত সাধারণ নির্বাচন না চাইলেও, দেশের প্রাথমিক স্তরে সামান্য এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে তাঁদের আপত্তি নেই। মুক্ত সংবাদমাধ্যমের বদলে তাঁরা চান পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম, যা শাসকদের বিরোধিতা করবে না, কিন্তু নেতৃত্বকে দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক ধারণা দেবে। এই কাজে এই নেতাদের মূল সহায় সেই দেশের শিল্পপতি ও তাঁদের সহায়ক এলিটরা। আজ গণতন্ত্রের সঙ্কটের চাবিকাঠিটিও লুকিয়ে আছে দেশের সব নীতি নির্ধারণে জনসাধারণের বদলে এলিটদের বিপুল প্রভাবে।
বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি তাই উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির এলিটদের ক্রমাগত নিজেদের পাল্লা ভারী করে চলার রাজনীতি। বিশ্বায়নের ফলে এই দুই ধরনের এলিট পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছেন। এর অবধারিত ফল একের দ্বারা অন্যের মানসিকতা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ছাপ পড়ছে তাঁদের নিজেদের দেশের শাসনব্যবস্থাতেও। গণতন্ত্রে এলিটদের অবিসংবাদী প্রভাবে পড়ছে স্পষ্ট কর্তৃত্ববাদের ছাপ, আর কর্তৃত্ববাদ অল্প হলেও গণতন্ত্রের কিছু ভাল দিককে নিজের করে নিয়ে সেই গণতন্ত্রেরই আদর্শগত বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা-বিবর্জিত এক অর্থনৈতিক মোক্ষের লোভ দেখিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে গণতন্ত্র আর কর্তৃত্ববাদের সীমারেখাটি তাই ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার পথে। তাকে রক্ষা করার পথ সন্ধান এই সময়ের অনস্বীকার্য কর্তব্য।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, লখনউ