ইরানের বিভিন্ন শহরের রাস্তার ছবি।
সমাজমাধ্যমে, আর সংবাদমাধ্যমে ইরানের বিভিন্ন শহরের রাস্তার ছবি দেখছি, আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একের পর এক ছবি।
২০১৫। নভেম্বর। ইসফাহান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ, বর্ধিষ্ণু গ্রাম ভ্যারজ়ানে-র এক সোনা-ঝরা সকাল। এক দল ছেলে, ১০-১২ বছরের হবে, হুল্লোড় করে চলেছে স্কুলে। ঠিক তার পাশেই আশিরনখ হিজাবে ঢাকা ছোট মেয়েদের একটা লাইন, পিঠে স্কুলব্যাগ। চলেছে গুটিগুটি।
গমগমে শহর রাজধানী তেহরানের এক ঝলমলে সন্ধ্যা। বন্ধু সৈয়দ জেদ ধরেছে, সে যে ইস্কুলে ইংরেজি শেখে, আমাকেও যেতে হবে তার ক্লাসে। হিন্দ থেকে মুসাফির এসে বাড়িতে উঠেছে শুনে সহপাঠীরা নাছোড়— একটি বার নিয়ে এসো, আলাপ করি। হাজির হই। তাদের হাজারো প্রশ্ন। আর তারা প্রায় সমানে-সমানে যুবক ও যুবতী। প্রত্যেক যুবতীর মাথা ঢাকা।
উত্তর ইরানের ত্যাবরিজ় শহরের শিমাকে রোজ দেখতাম, দরজা দিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকেই জুতো খোলারও আগে মাথার যে রুস্যারি— যে স্কার্ফ দিয়ে চুল ঢেকে তবেই ইরানে রাস্তায় বেরোতে পারেন মহিলারা— সেটা ছুড়ে ফেলে দিতে সোফার উপরে।
ইয়জ়্দ শহরের প্রাচীন পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে বন্ধু শাহরামকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মেয়েদের এই চুল ঢেকে রাখার হুকুমটা তোমার কেমন লাগে? পলকে উত্তর এসেছিল— হাস্যকর!
ছবির টুকরোগুলো সাজিয়ে কোনও একটা সরল সার্বিক চিত্র তৈরি করা কঠিন। কারণ ছবিগুলি বহুমাত্রিক ইঙ্গিতবাহী। এক কথায় বলতে পারি, লিঙ্গবৈষম্য মারাত্মক, তবু মেয়েদের উপর মোল্লাতন্ত্রের ভয়ঙ্কর ‘অত্যাচার’ ইরানে আমার চোখে পড়েনি। বরং চোখে পড়েছে কয়েকটা আশ্চর্য পরিসংখ্যান। যেমন, ২০১৬-র হিসাব অনুযায়ী ইরানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের মেয়েদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮৫.৫ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স্ক মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই হার ৯৭.৯ শতাংশ। মোট সরকারি ব্যয়ের ২৩.১ শতাংশ ইরান সরকার খরচ করে শিক্ষা খাতে (২০২০)। তুলনামূলক ভাবে ভারতের ক্ষেত্রে এই হারগুলি হল— ৭৪.৪ শতাংশ, ৯০.২ শতাংশ এবং ১৬.৫ শতাংশ (২০২০)। এ সব তথ্যই ইউনেস্কোর।
আরও আছে— ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস জানাচ্ছে: ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে মেয়েদের শিক্ষার হার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। বিপ্লবের ঠিক আগে ১৯৭৮-এ উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের হার ছিল ৩ শতাংশ, ২০১৮-তে হয়েছে ৫৯ শতাংশ।
তা হলে? আমার মনে হয়েছে, আসল গোলমালটা সেখানেই— সেই যে হীরকরাজের মোক্ষম বাণী— এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে!
শিক্ষিত বেকার মনের মতো বারুদ আর হয় না।
সেই বারুদে আগুন লেগে যদি কোনও অত্যাচারী সরকার ছারখার হয়, তা আনন্দের খবর। ইরানের মানুষ নিজেদের সরকার গড়ে নেবেন নিজেদের মতো করে, নিজেদের জীবনের মূল্যে। কিন্তু মুশকিল এইখানেই যে, ইরানে ইসলামি সরকার থাকা বা না-থাকার সঙ্গে ইরানের মানুষেরই শুধু নয়, বিপুল শক্তিশালী নানা পশ্চিমি দেশের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত।
পশ্চিম এশিয়ার তেল কার দখলে থাকবে সেই টানাপড়েন, আর তারই মাঝখানে আরব-ইজ়রায়েল সংঘাত সে অঞ্চল থেকে বিশেষ করে আমেরিকাকে হাত তুলে নিতে দেয়নি, দেবে না। সিআইএ এবং আমেরিকান সরকার ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ভয়াবহ হস্তক্ষেপ চালিয়ে এসেছে ক্রমাগত, তার কোনও ক্ষমা নেই। এর সবচেয়ে মর্মান্তিক উদাহরণ ১৯৫৩ সালের ‘মোসাদ্দেঘ কাণ্ড’। সিআইএ ‘অপারেশন এজ্যাক্স’ চালিয়ে ইরানের প্রথম প্রকৃত জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক নেতা মহম্মদ মোসাদ্দেঘকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় সে দিন মানুষ মোসাদ্দেঘ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালে আমেরিকান সরকারের প্রকাশিত নথি জানাচ্ছে যে, হাজার হাজার ডলার খরচ করে এই ‘ভাড়া করা’ প্রতিবাদীদের হাজির করেছিল সিআইএ।
সেই থেকে আমেরিকান সরকার ইরানকে জব্দ করার চেষ্টা করেই চলেছে। অভিযোগ, ইরানের ইসলামি সরকার পশ্চিম এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতে বিভিন্ন ‘সন্ত্রাসবাদী’ গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দিয়ে থাকে। অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়। পশ্চিমি দেশগুলি উদ্বিগ্ন যে, ইরান পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেললে না জানি কী কাণ্ডটা হবে। কাজেই আমেরিকার নেতৃত্বে সে দেশের উপরে চাপানো হয়েছে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চেষ্টায় ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানির যে চুক্তি হয়েছিল, এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক কূটনীতির যাবতীয় রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকান সরকার একতরফা ভাবে তা থেকে বেরিয়ে এসে ফের অবরোধ চালু করে দেয়। আমার ইরানি বন্ধু সোমাইয়ে শিরাজ় থেকে লেখে— “কিচ্ছু মিলছে না। দাম আগুন। হাসপাতালে ওষুধ নেই। এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধের খেসারত ইরানের একেবারে সাধারণ মানুষ দিয়েই চলেছেন। শাবাশ গণতন্ত্র!”
ইরানে পথে নেমে মানুষের প্রতিবাদ এই প্রথম নয়। এক দিন তা সফল হবেই। শুধু আশঙ্কা থেকেই যায় যে, ঘোলা জলে গণতন্ত্রের মাছ ধরতে সতত সক্রিয় সিআইএ ইরানকে আর একটা ভিয়েতনাম বা আফগানিস্তান বা ইরাক করে তুলবে না তো?