ছোটবেলায় এক বন্ধুর লেখা কবিতা খুব নাড়া দিয়েছিল। বার বার ঘুরে ফিরে আসা দুটো লাইন, ‘দেশ কোথায়, বাড়ি কোথায়, দেশের বাড়ি?’ একটা সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা মানুষেরা, তার উপরে নগরমুখী সভ্যতার প্রবাহে ভেসে আসা গ্রাম মফস্সলের মানুষেরা যে নিজেদের ছিন্নমূল মনে করত, আজ তাদের কাছে ছিন্নমূল শব্দটার মানেই গিয়েছে পালিয়ে, যেমন ‘দেশ’ শব্দটাও যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা কাটিয়ে এখন অনেক বিস্তৃত। দেশ এখন আর পূর্বপুরুষের জন্মভিটে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদ নয়, সার্বিক অর্থে জন্মভূমি। কিন্তু কবিতার ওই শব্দগুলো এই সময়েও যখন বিদ্ধ করে, তখন নিজেদের ছিন্নমূল মনে হওয়ার চেয়ে দেশটাই যেন ছিন্নমূল হয়ে গিয়েছে, এমনটাই মনে হতে থাকে।
যে কোনও দেশেই সংস্কৃতি থেকে ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, সেই গড়ে ওঠা ঐতিহ্যই এক সময় হয়ে ওঠে সংস্কৃতির বাহক। এমন একটা প্রবাহের মধ্যে থাকতে থাকতে এক দিন যখন আবিষ্কার করি যে দেশে রয়েছি, তার ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি কোনও কিছুই অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারছি না, তখন দেশ আর দেশ থাকে না, পর্যবসিত হয় শুধুই রাজনৈতিক অস্তিত্বে।
পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশগুলোতে যতই বিবাদ বা মতাদর্শগত পার্থক্য থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে যাবতীয় মতপার্থক্য ঘুচিয়ে সবাই একজোট হয়, যখন সামগ্রিক ভাবে দেশের বা দেশের মানুষের স্বার্থের প্রশ্ন উঠে আসে। সব অন্তঃকলহ সরিয়ে দলমত নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচনে জয়ী দলকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশ চালানোর অধিকার দেওয়া হয়। এই ভূমিকা অনেকটা যৌথ সংসারের অভিভাবকের মতো, যিনি সংসারের সবাইকে সুরক্ষা দেবেন, তাদের ভালমন্দের প্রতি নজর রাখবেন, আবার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রগতিতে হবেন মূল কান্ডারি— সকলকে সঙ্গে নিয়ে, অন্তত আপাত-পক্ষপাতহীন ভাবে। এক সঙ্গে সকলকে নিয়ে চলতে পারাটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রধান স্তম্ভ, যেমন প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে কোনও অবস্থাতেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা বা সৌজন্য না হারানো। নির্বাচনে হারজিত হবেই, এক বার তা নির্ধারিত হয়ে গেলে মেনে নেওয়াই রীতি। যত নীতিগত, আদর্শগত পার্থক্য বা বিরোধিতা থাক, কেউই এমন পদক্ষেপ করতে চান না, যাতে দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়।
এই নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, যার হাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশের শাসনভার থাকে। কিন্তু সরকার যদি নিজেকেই দেশ ভাবতে শুরু করে, তখন শুভাশুভ বোধের ভারসাম্যের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়। মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে পরিবেশ, অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা-সঞ্জাত প্রজ্ঞার সমন্বয়ে। এই সমন্বয়ের ভিত্তি বিশ্বাস। সেটাই যখন নড়ে যায়, মূল্যবোধের আপস ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। মূল্যবোধের আপস আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাল্টে দেয়, মিথ্যেকেও তখন সত্যি বলে মনে হতে থাকে। আর সেটাই এখন আমরা চার পাশে ঘটতে দেখছি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিহিংসার কোনও জায়গা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা অনেকটা অগ্রজের, সব রাজ্যের প্রতি তার সমান পক্ষপাতিত্ব না থাকলেও, ঔদার্য বা সহমর্মিতার অভাব কেন হবে? সেটাই যখন হতে দেখি, যখন দেখি শ্রদ্ধা নেই, সৌজন্য নেই, অক্লেশে মিথ্যে বলার ক্লান্তি নেই, তখন এই অনেক নেই-এর মধ্যে চিরচেনা দেশটাও নেই হয়ে যায়।
কিন্তু কেন এমন হল? বৃহত্তর সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়েও কখন জরুরি হয়ে উঠল ব্যক্তিস্বার্থ? রাষ্ট্রের আগে দল, আবার দলের আগে ব্যক্তি? এমন নয় যে আগে নেতৃস্থানীয় কেউ নিজের স্বার্থ দেখেননি, কিন্তু অন্তত একটা আবরণের আড়াল ছিল। কারণ মানুষের এই ধারণা বা বিশ্বাস ছিল, রাজনৈতিক নেতাদের কিছু সামাজিক দায়িত্ববোধও আছে, যা অন্যথায় বিঘ্নিত হবে আবরণ সরে গেলে। এই আবরণটাই মানুষের সম্ভ্রম। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে সেই সম্ভ্রম, শিষ্টাচার, সংযম উধাও, শুধুই ক্ষমতার প্রয়োগ তথা অপপ্রয়োগ। ক্রমান্বয়ে অপপ্রয়োগ শৌর্যকে শ্রীহীন, রুচিকে নিম্নগামী করে। নেতৃত্বস্থানীয়ের মাধ্যমে ঘটে বলে তার প্রভাব সমাজকে গ্রাস করে। আমরা জানতাম ঘুষ নেওয়া শুধু অপরাধই নয়, জানাজানি হলে লজ্জারও। অবাক হয়েছিলাম কয়েক বছর আগে এক নামজাদা কর্পোরেটে একটি ছেলেকে দুঃখ করতে দেখে, তার পুলিশ অফিসার বাবা ভাল পোস্টিং পাচ্ছেন না, কারণ তাঁর থানায় উপরি রোজগারের তেমন সুযোগ নেই। মনে হয়েছিল, আমাদের অজানতেই এই বদল ঘটে চলেছে। যাঁরা সমাজে নেতৃস্থানীয়, তাঁদের বিশ্বাসের প্রভাব যাপনের প্রতিটা পদক্ষেপে, আর রাজনৈতিক নেতারা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ফলে, আমাদের যাপন থেকে সরে গিয়েছে সম্ভ্রম, সমষ্টিবোধ। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ‘রাইটার্স ইন রেসিডেন্সি’ প্রোগ্রামে রাইসিনা হিলসে ক’দিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। তিনি বার বার বলতেন, প্রত্যেক রাজনীতিকের রোজ সময় বার করে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করা উচিত, তাতে হৃদয় ও কল্পনার প্রসারতা বাড়ে, সমাজের দর্পণে নিজেদের দেখতে শেখা যায়। এখনকার রাজনীতিকরা তা করেন না, ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্কীর্ণতায় হারিয়ে যায় রাজনীতি, দেশ। চেনা কবিতার পঙ্ক্তি অমোঘ হয়ে ওঠে।