তালিবানিস্তান’ গঠনের প্রক্রিয়া কার্যত সম্পূর্ণ। আফগানিস্তানে নতুন সরকারে ঠাঁই পেয়েছেন এমন কয়েক জন, যাঁদের নাম রাষ্ট্রপুঞ্জের সন্ত্রাসবাদী তালিকায় আছে। ভারত সমেত বহু দেশ শঙ্কিত সেখানে সরকার গঠনের চেহারা দেখে। ভারতের চিন্তার দিকটা অবশ্যই পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট সন্ত্রাসবাদ এবং কাশ্মীরকে ফের অশান্ত করে তোলার আশঙ্কা।
কাশ্মীর প্রশ্নে নাক না গলানোর তালিবানি আশ্বাসে কান দেওয়ার অর্থ আছে বলে মনে করছেন না কেউই। অন্তত, আমেরিকার সেনা আফগানিস্তান থেকে পুরোদস্তুর প্রত্যাহারের আগেই ‘নরমপন্থী’ তালিবানদের যে দৌরাত্ম্যের সাক্ষী থেকেছে গোটা বিশ্ব, যে নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে ওই ‘আশ্বাস’-এ আদৌ কান দেওয়া যায় কি না প্রশ্ন সেটাও।
আফগানিস্তানে তালিবান সরকার গঠনের পরেই জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সবিস্তার পর্যালোচনা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তালিবান সরকার গঠনের পরে নিরাপত্তার দিক থেকে কাশ্মীর কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে প্রত্যাশিত ভাবে তা নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তানের মদতে কাশ্মীরে তালিবানি আগ্রাসন হোক বা না হোক, উপত্যকার মানুষ কিন্তু দশকের পর দশক ধরেই সামরিকীকরণের শিকার। তা সীমান্তপারের সন্ত্রাসের প্রশ্নে হোক বা প্রতিবেশী দুই দেশের রণহুঙ্কারের প্রশ্নে।
এরই মধ্যে ২০১৯-এর ৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে, কাশ্মীর রাজ্যকে রাতারাতি ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে দেওয়া হয়েছে। গত দু’বছরে নানা প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে কাশ্মীরে কী ধরনের ‘শান্তি’ তৈরি হয়েছে, অল্পবিস্তর জেনেছে বাইরের দুনিয়াও। এই ‘আপাত শান্তিকল্যাণ’-এর আড়ালে বাস্তব কী বলছে? ‘বড় মাপ’-এর কারও কথা নয়, নেহাতই মামুলি এক ‘আম আদমি’র আখ্যান শোনানো যাক।
মুস্তাক আহমেদ ভাটকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছিল তল্লাশি অভিযানে। কাশ্মীরে এটা নতুন কিছু নয়। ‘সন্দেহভাজন’ যে কাউকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যেতে পারে, যায়ও। মুস্তাককে তোলা হয়েছিল শ্রীনগরের পুরনো মহল্লা থেকে। তিরাশি দিন পরে মুস্তাকের দেহ তুলে দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের হাতে। এটা ১৯৯৩-এর ঘটনা। মুস্তাকের মেয়ে জিনাত ও তার দিদি তখন নেহাত শিশু।
কিন্তু ২০২১-এ কাশ্মীরের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এত পুরনো এক কাহিনি শোনানো কেন? ২০০৯ সালে জিনাতের দিদি এই ঘটনায় জম্মু-কাশ্মীর মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হন। যে হেতু মুস্তাক ভাট নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন, তাই সরকারি চাকরির দাবি জানিয়ে তিনি কমিশনকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার আর্জি জানান। মুস্তাক ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। কিন্তু অজস্র ঘটনার মতো এই ঘটনারও তদন্ত ধীর লয়ে চলতে থাকে। অবশেষে ক্ষতিপূরণ হিসাবে জিনাতের বড় দিদি চাকরি পাচ্ছেন বলে ২০১৯-এ এসে জানা যায়। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন অপেক্ষা করছিল পুলিশ রিপোর্টের।
কিন্তু ২০১৯-এর ৫ অগস্ট বিলোপ হয়ে গেল জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অস্তিত্বই। সরকারি নির্দেশে একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের দরজাও। শুধুই কি মানবাধিকার কমিশন? জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন ২০১৯-এর বলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আরও ছ’টি কমিশন— নারী ও শিশু সুরক্ষা কমিশন, প্রতিবন্ধীদের জন্য কমিশন, তথ্য কমিশন, দায়বদ্ধতা কমিশন, ক্রেতা সুরক্ষা কমিশন এবং বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক কমিশন।
ফলে, মানবাধিকার কমিশনের এই সুপারিশের ভবিষ্যৎ কী, তা কারও জানা নেই। দীর্ঘ ২৬ বছর পরে বেঁচে থাকার যেটুকু আলো দেখেছিলেন জিনাতরা, তা-ও এখন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত, কাশ্মীরের ভবিষ্যতের মতোই। ব্যক্তিমানুষের কথাই সমষ্টির কথা বোঝায়।
যে সংসদকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে যাঁরা কাশ্মীরের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা শোনান, কী ঘটতে চলেছে উপত্যকায়, সে সম্পর্কে যাঁরা সেখানকার মানুষকে ঘুণাক্ষরেও আঁচ পেতে দেন না, আজ সেই তাঁদের কথায় কাশ্মীরবাসী ভরসা করবেন তো?
২০১৯-এর ৫ অগস্টের ঠিক আগেই ফারুক আবদুল্লা ও তাঁর পুত্র ওমর দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গেও। সরাসরি জানতে চান, এত সামরিক তৎপরতা কেন? কী ঘটতে চলেছে সেখানে? মোদী কিন্তু সে দিনও তাঁদের কিচ্ছু বুঝতে দেননি। বলেছিলেন, সব ঠিক আছে। মনে রাখতে হবে, এই দু’জনেই কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী! ৪ অগস্ট অমরনাথ যাত্রা বাতিল করা হয়। বলা হয়েছিল, জঙ্গিরা আক্রমণ চালাতে পারে। কাশ্মীরের রাজ্যপালও কোনও ইঙ্গিত দেননি। এত বিপুল পরিমাণ সেনাবাহিনী কেন উড়িয়ে আনা হচ্ছে কাশ্মীরে? উত্তর এসেছিল, সব ঠিক হ্যায়!
কয়েক দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সবটাই ঝুট হ্যায়! কাশ্মীরের অবস্থা এই দু’বছরে আগের থেকেও খারাপ হয়েছে! নাগরিক সমাজের উপর যে কোনও অত্যাচার, বাড়াবাড়ি, নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে রেখে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, হাজার হাজার যুবক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিক, সমাজকর্মীকে জেলে পুরে দেওয়া, যে কোনও বিরুদ্ধ স্বর স্তব্ধ করে দেওয়া, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করা— এ সবই কাশ্মীরে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যারা এ সব কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের কি আইনের জিম্মায় আনা যায়?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যায় না। রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘সিস্টেম’ নিরাপত্তা বাহিনীকে সুরক্ষাকবচ পরিয়ে রাখে। সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) থেকে শুরু করে হরেক পন্থা আছে তাদের বাঁচানোর। এক জন অতি সাধারণ ভূমিপুত্রের সাধ্য কী, এতগুলি সুরক্ষা বর্ম ভেদ করে আইনের আঙিনায় অভিযুক্তকে টেনে নিয়ে যাওয়ার? আশিস নন্দীর মতো সমাজবিজ্ঞানী এই অবস্থাকেই বলেছেন, ‘কালচারাল ইমপিউনিটি’, অর্থাৎ ‘অব্যাহতির সংস্কৃতি’।
২০০০ সালের ৫ অগস্ট সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সতর্ক করে বলেছিলেন, এটা সব সময় সত্য যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়। উপত্যকার সমস্যা সমাধানে বাজপেয়ীর মন্ত্র ছিল, ‘ইনসানিয়ত জামহুরিয়ত কাশ্মীরিয়ত’। তখন কি জানা ছিল, ১৯ বছর পরে ওই একই দিনে বাজপেয়ীর ‘ভাবশিষ্য’ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী তাঁর রাজনৈতিক গুরুর উল্টো পথে হাঁটবেন?
গত ২৪ জুন উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। দু’বছরে এই প্রথম। অমিত শাহও সেখানে ছিলেন। সেখানে মোদী শোনান কাশ্মীরের সঙ্গে ‘দিল্লি কি দূরী ঔর দিল কি দূরী’র মন্ত্র! কিন্তু, কাশ্মীরে যা যা চলছে তা ‘দিল কি দূরী’ আরও বাড়াচ্ছে না? প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই জানিয়েছেন, আগে আসন পুনর্বিন্যাস ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। পরে ধাপে ধাপে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো হবে। এই ‘ধাপে ধাপে’ ঠিক কবে তা অবশ্য কেউ জানেন না।
কোনটা যে ঠিক আর কোনটা দ্বিচারিতা, সেটাও অবশ্য বলা মুশকিল! পেগাসাস সংক্রান্ত মামলা সংসদে আলোচনার আগে থেকেই সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। ২০১৫ থেকে সুপ্রিম কোর্টেই ৩৫এ সংক্রান্ত মামলা ঝুলে রয়েছে। অথচ, পেগাসাস নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের পরে কেন্দ্র জানিয়েছিল, এই মামলা বিচারাধীন। এখন এ নিয়ে কিছু বলা বা করা যাবে না। তা-ই যদি হয়, তা হলে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া যায় কী করে?
এখন অবশ্য কাশ্মীরের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর দাবি তোলাটাই দিল্লীশ্বরদের কাছে দেশদ্রোহিতার শামিল। সাম্প্রতিক আফগানিস্তান পরিস্থিতি এবং দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও চিনের সাম্প্রতিক ভূমিকার কথাই ভারতীয় শাসকরা বলতে থাকবেন। কাশ্মীরের সামরিকীকরণ নিয়ে তাই জাতীয়তাবাদের এই মরসুমে প্রশ্ন তোলাটাই তাঁদের বিষনজরে পড়ার পক্ষে যথেষ্ট।
তাই বলে কেউ প্রশ্ন করবে না? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় অতি সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন, রাষ্ট্র যেটা বলছে সেটাই সত্য বলে বিশ্বাস করবেন না। প্রশ্ন করুন। স্বেচ্ছাচারী সরকার যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ক্রমাগত মিথ্যের উপর ভরসা করে এটা প্রমাণিত সত্য।
কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও কি তা প্রযোজ্য নয়?