এই চিনকে চেনা জরুরি
Peoples Republic of China

শি-র নেতৃত্বে শক্ত হল অতি-জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদের গাঁটছড়া

শি-র মতে, আজকের অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চিন সমৃদ্ধি ও আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে, যদি অভ্যন্তরীণ সমস্ত দ্বন্দ্বের দ্রুত অবসান ঘটে। তার জন্য চাই দৃঢ় সঙ্কল্প আর আত্মত্যাগ।

Advertisement

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২২ ০৭:৩৩
Share:

চিনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ২০তম জাতীয় কংগ্রেস কিছু দিন আগে শেষ হয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের অপসারিত করে প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং চিনের অবিসংবাদিত ও সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি চিনকে বিশ্বের প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মাটিতে মার্ক্সবাদের সত্যকে সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করাই চিনের অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য।

Advertisement

এর জন্য চাই কেন্দ্রীভূত নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। শি-র ক্ষমতা যত একচেটিয়া হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সে দেশের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা তত বাড়বে। চিনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা যখন সে দেশের ভাবনা ও রণনীতিকে আরও আগ্রাসী করতে বদ্ধপরিকর, তখন বিশ্বের পক্ষে নিঃসন্দেহে তা অশনিসঙ্কেত বহন করে।

অধিবেশনে গৃহীত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হল, মতাদর্শের বিশুদ্ধতা ও আত্ম-নির্ভরতা। শি-র মতে, আজকের অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চিন সমৃদ্ধি ও আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে, যদি অভ্যন্তরীণ সমস্ত দ্বন্দ্বের দ্রুত অবসান ঘটে। তার জন্য চাই দৃঢ় সঙ্কল্প আর আত্মত্যাগ। শি চিনের রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে মার্ক্সবাদের অপরিসীম গুরুত্বকে স্মরণ করেছেন। এই দিক থেকে বিচার করলে, অধিবেশনে শি-র ভাষণ ও পরবর্তী কালে প্রকাশিত প্রতিবেদন সে দেশের মার্ক্সবাদের এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিল বলে অনেকে দাবি করেছেন। কিন্তু, শি তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই চিনের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে এই মার্ক্সবাদের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন। অর্থাৎ, শ্রেণি ও জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক স্বার্থের মধ্যে বিরোধের কোনও সম্ভাবনা এখানে পাওয়া যাবে না।

Advertisement

দেং, যাঁকে চিনের অর্থনৈতিক উত্থানের জনক হিসাবে গণ্য করা হয়, ১৯৮১ সালে সিসিপি সম্মেলনে মার্ক্সবাদী মতাদর্শের গুরুত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর মত ছিল, যান্ত্রিক তত্ত্ব পরিহার করে বাস্তবের দাবিকে মেনে নতুন চিনের নির্মাণে মনোযোগ দেওয়া। তাঁর উত্তরসূরি জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাও তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ, চিনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বাজারের ভূমিকা দ্রুত প্রসারিত করেন এবং এমন একটি বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন, যা আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চিনের পূর্ণ অংশগ্রহণের পথ খুলে দেয়। উদারনৈতিক বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে চিন বিস্ময়কর দ্রুততায় অভূতপূর্ব সাফল্যের মুখ দেখেছিল। শি বাস্তববাদী। অ-মতাদর্শী শাসনের বদলে মার্ক্সবাদী জাতীয়তাবাদের একটি নতুন রূপ গড়ে তুলেছেন, যা এখন চিনের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বৈদেশিক নীতির ধারক ও বাহক। এই ভাবে, শি রাজনীতিকে মাওয়ের পথে, অর্থনীতিকে পশ্চিমি বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংঘর্ষে এবং বিদেশনীতিকে অতি-জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

চিনের ২০তম জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনটি সাফল্য এবং সম্ভাব্য বিপদের এক মিশ্র আখ্যান। আশানুরূপ ভাবেই, চিনের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় পশ্চিমি প্রতিপক্ষের সঙ্গে বেড়ে চলা ব্যবধান বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। শি গত পাঁচ বছরে পার্টির সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যার মধ্যে ‘মধ্যম সমৃদ্ধ সমাজ’ গড়ে তোলা, শূন্য-কোভিড নীতির মাধ্যমে সমস্ত জনগণকে রক্ষা করা, হংকং-এ রাজনৈতিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, তাইওয়ানের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং ‘চিনের মর্যাদা এবং মূল স্বার্থ’ রক্ষার জন্য ‘লড়াইয়ের মনোভাব’ গ্রহণ করা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

পার্টিকে ‘লড়াইয়ের মনোভাব’ গ্রহণ করার জন্য শি-র আবেদন ইঙ্গিত দেয় যে, চিনের ‘জাতীয় পুনর্জাগরণ’-এর পথ মসৃণ নয় এবং এর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ, বেজিংকে ‘কৌশলগত সুযোগ, ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ’ নিতে হবে, আর, স্বাভাবিক ভাবেই, প্রস্তুত থাকতে হবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। স্বাভাবিক ভাবে, বেজিং আরও আক্রমণাত্মক রণনীতি নেবে, যার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতা ও সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়বে।

আজকের চিন যে ভিন্ন পথের পথিক, তা স্পষ্ট। প্রথমত, দেং শিয়াওপিং, জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাও কমিউনিস্ট পার্টিকে নতুন প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াতে চেয়েছিলেন। তাঁরা দেশের আর্থিক উন্নতির স্বার্থে ব্যবসায়ী এবং পেশাদারদের উত্থানকে সমর্থন করেছিলেন। বিপরীতে, পার্টির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে মানানসই বাস্তবতাকে পরিবর্তনের পক্ষে আপসহীন সওয়াল করেছেন শি।

দ্বিতীয়ত, শি-র পূর্বসূরিরা আর্থিক বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু শি মতাদর্শ ও আনুগত্যকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

তৃতীয়ত, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতীত অন্য যে কোনও সামাজিক গোষ্ঠী প্রগতিশীল শক্তি হতে পারে, এই ধারণাকে শি সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাগ করেছেন। ১৯৯০-এর দশকে, দলীয় কর্মকর্তা এবং শিক্ষাবিদরা ‘ছোট সরকার, বড় সমাজ’ ধারণাটি নিয়ে বেশ খোলাখুলি আলোচনা করতেন। এটি পশ্চিমি সুশীল সমাজের ধারণা না হলেও, কিছু মিল ছিল। শি-র নেতৃত্বে এটা আর সম্ভব নয়। পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এমন কোনও সামাজিক শক্তি চিনের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ও সম্পূর্ণ বর্জনীয়।

ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে, চিনের প্রধান উদ্দেশ্য হল আমেরিকার কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা কার্যকর ভাবে হ্রাস করা। এটি বিশেষত চিনের প্রতিবেশী, মূলত, ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতীতে চিন বিভিন্ন দিকে দ্রুত অগ্রগতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু, আজকের চিন আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অত্যাবশ্যক উন্নত প্রযুক্তি আমদানির ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার এবং ক্ষমতা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে পশ্চিমি ষড়যন্ত্রের কারণে। আমেরিকার নাম না করে, শি ঘোষণা করেছেন যে, চিন ‘কখনও জোরপূর্বক শক্তির কাছে নতিস্বীকার করবে না’। চিনের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে, পার্টি কংগ্রেস জানিয়েছে যে, বেজিং-এর লক্ষ্য হল: ২০৩৫ সালের মধ্যে চিনকে একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত করা, মাথাপিছু আয়কে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত করা এবং সশস্ত্র বাহিনীকে অত্যাধুনিক করা। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের শততম বার্ষিকীতে, মোট জাতীয় শক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা।

কিন্তু, সামরিক, ভূরাজনৈতিক জটিলতা ও অভ্যন্তরীণ আদর্শগত বিবাদের দাবি অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। শি-র ভাষণ ও প্রতিবেদনে এর ইঙ্গিত স্পষ্ট। প্রতিবেদনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার মান এবং স্তর উন্নত করা যে চিনের প্রধান উদ্দেশ্য, তা ধরা পড়েছে। কিন্তু, উন্মুক্ত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি এই আপাত সমর্থন চিনের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের উপায়মাত্র। উল্লেখযোগ্য ভাবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে— যেখানে চিন বিপুল পরিমােণ অর্থ ও জনশক্তি বিনিয়োগ করছে। প্রথম দু’টি অতি মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে হাই-টেক সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোপ্রসেসর ইত্যাদি বিক্রির উপর আমেরিকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে। চিনের অভূতপূর্ব উত্থান অর্থনৈতিক বাস্তববাদী চিন্তায় নির্মিত। কিন্তু আজকের চিন সেখান থেকে সরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকতার চাপ অনস্বীকার্য হলেও চিনের আদর্শগত কঠোরতা ও উগ্র জাত্যভিমান এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দ্বন্দ্ব আজ প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। অতিমারি-বিধ্বস্ত ও বিশ্বব্যাপী মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে চিনের সামনে বিকল্প পথ সীমিত। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে চিনের বিনিয়োগ। দেশের বহু চর্চিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নানা সমস্যাদীর্ণ। এই সময়ে, শি প্রবর্তিত আগ্রাসী মনোভাব চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি রুদ্ধ করতে পারে বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের দাবি।

ভারত অবশ্য আগামী কয়েক বছরে চিনের রোষের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতার পাশাপাশি ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হবে। এর পাশাপাশি, পশ্চিমি প্রযুক্তির প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করেও দু’-দেশের তিক্ততা বাড়বে। তা ছাড়া, বিশ্ব ভূরাজনীতির প্রবণতা ভারত ও চিনের মধ্যে চাপা উত্তেজনার সর্বপ্রধান কারণ। রাশিয়া ও পশ্চিমি দেশ সমূহকে কেন্দ্র করে যে ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ দিন ভারতের পক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দুরূহ হবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিচারে, সে ক্ষেত্রে ভারতের সামনে নিজেকে যে কোনও সামরিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement