দূষণে নাভিশ্বাস উঠলেও মানুষের সচেতনতা বাড়েনি। ছবি: সংগৃহীত।
ছোট ছোট বিপদ আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ছোট মাথায় বড় বিপদের ছবিটা শুধু বোধহয় গল্প হয়েই থেকে যায়। এটার সব থেকে বড় উদাহরণ উষ্ণায়ন। তথ্য আমাদের নাড়ায় না। কিন্তু তথ্য যে ভয়ের কথা বলে সেই ভয় যখন সত্যি হয়, তখন আমরা কেঁপে যাই। যেমন আমপান। কিন্তু তার পিছনের কারণকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রয়াসে আমাদের এত আলস্য কেন? কারণ কি সত্যি আমাদের বড় বিপদ বুঝে ওঠার অক্ষমতা?
উদাহরণ? এই লেখা যখন লিখছি কলকাতায় গরম তখন ৩৮ ডিগ্রি ছাড়ানোর পথে। গরমের বোধ ৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। বঙ্গোপসাগরের জঠরে জন্ম নেওয়া ঝড়ের শক্তি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর তার পিছনে কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত বেড়ে চলা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাকেই দায়ী করছেন। তথ্য বলছে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রিতে পৌঁছলেই ঝড়ের জন্মের সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে। আর বিধ্বংসী ঝড়গুলোর পিছনে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাপমাত্রা। যা এখন গড়ে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে!
নিজেদের মৃত্যুবাণ আমরা কিন্তু নিজেরাই তৈরি করেছি। নির্বিচারে গাছ কেটে। যত্রতত্র নদীতে বাঁধ দিয়ে। আর তার ফল? এর কারণে তৈরি উষ্ণায়ন আমাদের সরাসরি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্টের তথ্য বলছে, ভারতে উষ্ণায়নের কারণে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। কতটা? দুটো ৫ বছরের তুলনা করা হয়েছে এই সমীক্ষায়। ২০০০ থেকে ২০০৪ এই ৫ বছরের সঙ্গে ২০১৭ থেকে ২০২১। এই সমীক্ষা বলছে, এই দুই সময়কালে অত্যধিক গরমের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৫৫ শতাংশ!
আমরা তো আত্মহননকারী। না হলে যশোর রোডকে প্রশস্ত করতে শয়ে শয়ে গাছকে বলি দিলাম কেন? এটার মানে এই নয় যে রাস্তা হবে না। কিন্তু পুরনো গাছের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উন্নয়ন যজ্ঞে হাত দেওয়া যে আত্মাহুতির সমান তা কিন্তু আমরা বুঝছি না। একটা নিয়ম আছে নাকি যে গাছ কাটলে নতুন গাছ অন্য কোথাও বসাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নতুন গাছ বড় হয়ে পুরনো গাছের সমান দূষণ ছাঁকতে যে সময় নেবে সেই সময়কালে বায়ুদূষণের ছাঁকনিটা কী হবে?
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। যত সময় যাচ্ছে আমাদের সভ্যতাকে বাঁচানোর খরচ বাড়ছে। ইতিমধ্যেই কিন্তু আমরা প্রায় সেই জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি যেখান থেকে বাঁচার জায়গায় ফেরা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগে হলেও হয়ত গাছ কেটে গাছ বসিয়ে আমরা অবস্থা সামাল দিতে পারতাম। কিন্তু সেই সময়ে ভবিষ্যতের কথা না ভাবায় আজ যে জায়গায় পৌঁছেছি সেখানে কিন্তু গাছ না কেটে তার প্রতিস্থাপন বা পুনর্বাসনের কথা ভাবতে হচ্ছে আমাদের। আর এর খরচ যা তা কি আমাদের সরকারের কোষাগার টানতে পারবে? পারবে না বলেই সোজা পথ হল গাছ কেটে ফেলা। আর তার অভিঘাত? অত্যধিক গরমের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া।
অনেকেই বলেন, ধিকি ধিকি মরার থেকে একেবারে মৃত্যু নাকি অনেক বেশি কাম্য। কিন্তু উষ্ণায়ন যাঁরা বেঁচে আছি তাঁদের অন্য ভাবেও মারছে। অভুতপূর্ব ঝড়, বৃষ্টি, খরা আর বন্যা এখন আমাদের জীবনের অঙ্ক। পানীয় জলের ঘাটতি বাড়ছে। আমাদের দেশের কৃষির উপর ৭০ শতাংশের জীবিকা নির্ভরশীল। আর সেই জীবিকা এখন বলির পাঁঠা হয়ে উঠেছে। এর ফলে সমীক্ষা বলছে ২০৪০ সালের মধ্যে শুধু উষ্ণায়নের কারণেই দেশের দরিদ্রের সংখ্যায় আরও ৫ কোটি মানুষ যুক্ত হবে ২০৪০ সালের মধ্যেই। মাথাপিছু পানীয় জলের সঞ্চয় ১৯৫০ সালের তুলনায় কমেছে ৭০ শতাংশ। আর প্রতি বছর জলাভূমির সংখ্যা কমছে ৩ শতাংশের একটু বেশি হারে।
উষ্ণায়ন কিন্তু কাউকে রেওয়াত করে না। ভুটানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেরিং টগবে উষ্ণায়ন নিয়ে তাঁদের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে সরাসরি যা বলেছিলেন তা কিন্তু আমরা মাথায় রাখি না। তিনি বলেছিলেন, ভুটান দূষণহীন। কারণ তাঁরা দূষণের মূল্য কী হতে পারে তা বোঝেন। সমস্যা হচ্ছে হিমবাহ গলে তাঁদের দেশে যে বন্যা হচ্ছে তাঁর মূলে রয়েছে প্রতিবেশি দেশগুলির দূষণের অভিঘাত ভুলে নির্বিচারে উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংসে মেতে থাকা। প্রকৃতির কাছে রাজনৈতিক সীমা অর্থহীন এটা আমরা মাথায় রাখি না। এই যুদ্ধ যে আসলে মানব সভ্যতা বাঁচানোর যুদ্ধ তা-ও আমাদের ছোট মাথায় রাখতে চাই না আমরা।
সব মিলিয়ে সমস্যাটা কিন্তু দাঁড়িয়েছে এই রকম। দূষণ রুখতে যদি আমরা সবাই হাত না লাগাই তা হলে লাগাম ছাড়া উষ্ণায়নে প্রথমেই যেটা হবে সেটা হল বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কৃষির উৎপাদন কমবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে যেখানে চালের উৎপাদন বৃষ্টিনির্ভর সেখানে উষ্ণায়নের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে উৎপাদন কমবে ২.৫ শতাংশের মতো। সেচনির্ভর অঞ্চলে চালের উৎপাদন ২০৫০ সালে কমবে ৭ শতাংশ আর ২০৮০ সালে তা আরও কমবে ১০ শতাংশের মতো।
অর্থাৎ, একই প্রয়াসে চাষীরা যে ফলন ঘরে তুলবেন তা আজকের তুলনায় অনেক কম। এটা যে হঠাৎ হবে তা নয়। উষ্ণায়নের কারণে কিন্তু কৃষির উৎপাদনশীলতা কমতেই থাকবে। তার কারণ একাধিক। জলের অভাব, জলবায়ুর পরিবর্তন, বন্যা এবং খরা। আর এই পথেই আরও অনেক বেশি মানুষ দরিদ্র হবেন। কারখানার উৎপাদনও কমবে কারণ অত্যধিক গরমের কারণ কর্মীদের কাজ করার ক্ষমতাও কমবে।
আর এই সব মিলিয়েই ২০৫০ সাল ভারতের পক্ষে উষ্ণায়নের প্রেক্ষিতে একটি মাইলফলক হতে চলেছে। কারণ সমীক্ষা বলছে উষ্ণায়নের কারণে ওই বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ৫০টি দেশ সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের মধ্যে ক্ষতির অঙ্কে ভারত থাকব তৃতীয় স্থানে। এই ক্ষতি কতটা আর এড়ানো যাবে বলা মুশকিল। কিন্তু হাল না ছেড়ে গাছ কাটা আর জলাভূমি বোজানো রুখে বাঁচার যুদ্ধটা এখনই শুরু করতে হবে। দেরি তো হয়েইছে। কিন্তু আরও দেরি করলে যে সর্বনাশ হবে তা কিন্তু সব সমীক্ষাতেই পরিষ্কার।