সংবিধানের বিধি অনুসারে গঠিত হল ষোড়শ অর্থ কমিশন। কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে কোন রাজ্য কত টাকা পাবে, তা প্রধানত অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুসারেই স্থির হয় (এর বাইরে থাকে বিভিন্ন ‘সেন্ট্রালি স্পনসর্ড’ প্রকল্প বাবদ অর্থ হস্তান্তর)। কর আদায়ের ক্ষমতা এবং ব্যয়ের বাধ্যবাধকতার নিরিখে ভারতে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে অসাম্য রয়েছে। কর এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে অনেক বেশি। অন্য দিকে, রাজ্যগুলির সার্বিক ভাবে নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতার চেয়ে ব্যয়ের দায়িত্ব বেশি। এই কারণেই ভারতে কেন্দ্র থেকে রাজ্যে অর্থ হস্তান্তর করা হয়ে থাকে।
কেন্দ্রীয় কররাজস্বের বিভাজনযোগ্য অংশের কতখানি রাজ্যগুলিতে দেওয়া হবে, তা স্থির হয় ভার্টিক্যাল ডিভলিউশনের অনুুপাত অনুসারে। যেমন, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ ছিল, বিভাজনযোগ্য কর রাজস্বের ৪২% রাজ্যগুলিকে হস্তান্তর করা হোক। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন ৪১% হস্তান্তরের সুপারিশ করে। এই অনুপাত বাড়লে রাজ্যগুলির হাতে অর্থের পরিমাণ বাড়বে; কিন্তু কেন্দ্রের হাতে টাকা কমবে। রাজ্য সরকারগুলির যেমন খরচের দায়িত্ব আছে, তেমনই কেন্দ্রেরও আছে। কাজেই, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর যে অর্থ কমিশন গঠিত হয়, তার অন্যতম দায়িত্ব হল কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে অর্থ বণ্টনের এমন একটি সূত্র নির্ধারণ করা, যাতে দু’দিকেই ব্যয় ও রাজস্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এটাও দেখতে হবে যে, রাজ্যগুলির জন্য অর্থ কমিশনের মোট গ্রান্ট যেন কমে না যায়।
ভার্টিক্যাল ডিভলিউশনের অনুপাত মেনে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিভাজনযোগ্য কররাজস্বের যে বণ্টনই হোক, রাজ্যগুলির সেই সামগ্রিক ভাগ থেকে কোন রাজ্য কত টাকা পাবে, তা স্থির হয় হরাইজ়ন্টাল ডিভলিউশনের সূত্র অনুসারে। কোন রাজ্যের ভাগে কত টাকা পড়বে, তা নির্ধারণের কিছু নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে— যেমন আয় দূরত্ব, রাজ্যের জনসংখ্যা, রাজ্যের আয়তন, বনাঞ্চলের পরিমাপ, রাজ্য স্তরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, রাজ্য স্তরে কর আদায়ের উদ্যোগ ইত্যাদি। বিভিন্ন অর্থ কমিশন এই মাপকাঠিগুলির এক-একটিকে এক-এক রকম গুরুত্ব দেয়; কোনও কমিশন চাইলে মাপকাঠি পাল্টেও দিতে পারে। যেমন, চতুর্দশ অর্থ কমিশন ‘অ্যাভারেজ ইনকাম ডিস্ট্যান্স’ মাপকাঠিকে ৫০% গুরুত্ব দিয়েছিল। এই মাপকাঠির মূল কথা হল— যে রাজ্যে মাথাপিছু গড় আয় যত কম, সে রাজ্য কেন্দ্রের থেকে তত বেশি রাজস্বের ভাগ পাবে; যে রাজ্য ধনী, তার রাজস্বের ভাগ তুলনায় কম হবে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন এই মাপকাঠির গুরুত্ব কমিয়ে করেছিল ৪৫%। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব বিপুল। মাথাপিছু গড় আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের সাধারণ শ্রেণিভুক্ত রাজ্যগুলির মধ্যে একেবারে পিছনের সারিতে— ২০২১-২২ সালে হরিয়ানায় মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২.৬৫ লক্ষ টাকা; পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১.২৫ লক্ষ টাকা। কাজেই, আর্থিক সমতার স্বার্থে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে হরিয়ানার চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশি টাকা পাওয়া প্রয়োজন। অতএব, অর্থ কমিশনের সূত্রে আয় দূরত্বের গুরুত্ব বাড়লে পশ্চিমবঙ্গের লাভ।
বিভিন্ন রাজ্যের আয়তন ও জনসংখ্যার মধ্যেও বিপুল ফারাক রয়েছে। চতুর্দশ অর্থ কমিশন রাজ্যের জনসংখ্যার উপরে ২৭.৫% গুরুত্ব আরোপ করেছিল (১৯৭১ সালের জনসংখ্যার গুরুত্ব ১৭.৫%, এবং ২০১১ সালের জনসংখ্যার গুরুত্ব ১০%)। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন ২০১১ সালের জনসংখ্যাকে ১৫% গুরুত্ব দেয়। ভারতের বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জনঘনত্ব অন্যতম বেশি। অর্থ কমিশন যদি জনসংখ্যাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, এবং রাজ্যের আয়তনকে কম, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে তুলনায় বেশি বরাদ্দ জুটবে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন জন্মহার হ্রাসের উপরে ১২.৫% গুরুত্ব দিয়েছিল। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস ২০১৯-২১) অনুসারে, ভারতের বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই জন্মহার সর্বনিম্ন। কাজেই, এই মাপকাঠিটির গুরুত্ব বাড়লে পশ্চিমবঙ্গের উপকার হবে। অন্য দিকে, কোনও রাজ্যের মোট আয়তনে বনাঞ্চলের অনুপাতের গুরুত্ব চতুর্দশ অর্থ কমিশনে ছিল ৭.৫%, পঞ্চদশ কমিশন তা বাড়িয়ে ১০% করেছিল। এই মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে।
রাজ্য স্তরে কর আদায়ের উদ্যোগ বা কর কুশলতা একাদশ ও দ্বাদশ অর্থ কমিশনে হরাইজ়ন্টাল ডিভলিউশনের মাপকাঠি হিসাবে গণ্য ছিল। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অর্থ কমিশন এই মাপকাঠিটিকে বাদ দেয়। আবার পঞ্চদশ অর্থ কমিশন তা ফিরিয়ে আনে— এই মাপকাঠির গুরুত্ব ধার্য হয় ২.৫%। কোনও রাজ্য তার নিজস্ব কর আদায়ে কতখানি উদ্যোগী হচ্ছে এবং কুশলতার সঙ্গে কাজটি করতে পারছে, এই গুরুত্ব তার পুরস্কার। রাজ্যগুলি যাতে কর আদায়ে মনোযোগী হয়, তা নিশ্চিত করার জন্যও এই ব্যবস্থা তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে যে, জিএসটি আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ খুবই কুশলী— রাজ্যের কর ভিত্তির নিরিখে আদায়ের হার যথেষ্ট ভাল। কাজেই, ষোড়শ অর্থ কমিশনে এই মাপকাঠির গুরুত্ব বাড়লে, এবং শুধুমাত্র জিএসটির মাধ্যমে আদায় করা কররাজস্বকেই বিবেচনা করলে, পশ্চিমবঙ্গ উপকৃত হবে।
অর্থ কমিশনের বিবেচনার জন্য সব রাজ্যেরই নিজ নিজ রাজ্যের দাবিসমেত স্মারকপত্র জমা দেওয়ার কথা। স্বভাবতই প্রতিটি রাজ্যই নিজের বরাদ্দ বাড়াতে চাইবে। যদি বিভাজনযোগ্য রাজস্ব তহবিলে রাজ্যের ভাগ বাড়ে, তবে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তা রাজ্যগুলির পক্ষে সুসংবাদ— কেন্দ্রের পক্ষে যদিও তা ততখানি সুসংবাদ না-ও হতে পারে। রাজ্যগুলি একজোট হয়ে ষোড়শ অর্থ কমিশনের কাছে দাবি করতে পারে ভার্টিক্যাল ডিভলিউশনের সূত্রটিকে স্বচ্ছ করার জন্য। তা ছাড়াও, কেন্দ্র যে বিভিন্ন সেস ও সারচার্জ আদায় করে, তা বিভাজনযোগ্য তহবিলের অংশ নয়— রাজ্যগুলি এই টাকাকেও বিভাজনযোগ্য তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাতে পারে। সংজ্ঞাগত ফারাক যা-ই হোক না কেন, করের সঙ্গে সেস বা সারচার্জের কোনও ব্যবহারিক ফারাক তো নেই— তা হলে, এই রাজস্বের উপরে শুধুমাত্র কেন্দ্রের অধিকার রেখে রাজ্যগুলির ভাগ কমানো হবে কেন?
বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে মাথাপিছু গড় আয়ের ক্রমবর্ধমান অসাম্যের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মতো দরিদ্র রাজ্যগুলির কর্তব্য এটা দাবি করা যে, কুশলতাভিত্তিক মাপকাঠির চেয়ে বণ্টনের সাম্যভিত্তিক মাপকাঠিগুলির উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হোক। ভারতের যে রাজ্যগুলির মাথাপিছু গড় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কম, সে রাজ্যগুলি একত্রে ষোড়শ অর্থ কমিশনের কাছে এই দাবি পেশ করতে পারে। দু’টি রাজ্যের মাথাপিছু গড় জিএসডিপি-র মধ্যে যদি এমন ফারাক থাকে যে, একটি রাজ্যের গড় জিএসডিপি অন্য রাজ্যের গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি (যেমন, হরিয়ানার গড় জিএসডিপি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণেরও বেশি), তা হলে বিভাজনের কোনও সূত্র মেনে গড় জিএসডিপি-র অনুপাতে কেন্দ্র থেকে রাজ্যে টাকা হস্তান্তরের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ যদি হরিয়ানার দ্বিগুণ অনুপাতেও টাকা পায়, তবু মাথাপিছু কেন্দ্রীয় ট্রান্সফার পশ্চিমবঙ্গে কম হবে। কাজেই, কররাজস্ব বণ্টন ও কেন্দ্রীয় সহায়তা মিলিয়ে কোন রাজ্যে মাথাপিছু কত টাকা আসছে, সেই হিসাবকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি তোলাই পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে— জিএসডিপি-র অনুপাতে কেন্দ্রীয় বণ্টনের দাবি তোলা নয়।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, এখন হরাইজ়ন্টাল ডিভলিউশনের যে মাপকাঠিগুলি রয়েছে, তার কয়েকটিতে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে, কয়েকটিতে পিছিয়ে। অন্য দিকে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় স্বশাসন যদি একটি মাপকাঠি হিসাবে সূত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের লাভ— ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের চেয়েই এ রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও পুরসভাগুলি এগিয়ে আছে। আবার, যে রাজ্যে দরিদ্র মানুষের অনুপাত যত বেশি, সে রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় বণ্টনের ভাগ তত বেশি করার দাবিও তোলা যায়— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলি যত টাকা খরচ করতে পারবে, মানবোন্নয়নের গতিও তত বাড়বে। রাজ্য স্তরে মাল্টি-ডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স বা বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচককে হরাইজ়ন্টাল ডিভলিউশনের সূত্রের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ষোড়শ অর্থ কমিশনের (২০২৬-২৭ থেকে ২০৩০-৩১) সূত্র যাতে দেশের আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও আন্তঃরাজ্য অসাম্য হ্রাসের কাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিকে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।