পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা ২০,০০০ পেরিয়েছে। ফাইল চিত্র।
এবারও উৎসবের মরসুম অনেকের ভাল কাটছে না। কোভিডের মতোই ডেঙ্গিরও কোনও ওষুধ নেই, শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভরসা। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এই রোগেও একগুচ্ছ জনস্বাস্থ্যবিধি: জল জমতে না দেওয়া, মশারি টাঙানো ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রেও জনস্বাস্থ্য নীতিকে আঁকড়ে ধরার প্রশ্নে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের দুর্বলতার ধরনগুলি একই রকম। ফলস্বরূপ, দুর্গাপুজোর আগেই পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা ২০,০০০ পেরিয়েছে। অথচ ডেঙ্গি নতুন আবিষ্কৃত রোগ নয়।
নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ডেঙ্গির বিশেষ তথ্য ছিল না, তখনও পর্যন্ত এ নিয়ে নজরদারি চলত না। ১৯৯৬-এ দিল্লিতে ডেঙ্গি ভয়াবহ আকার নিলে নজরদারির কথা ভাবা হয়। দিল্লিতে সে বছর ১০,২৫২ জন মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হন, ৪২৩ জনের মৃত্যু হয়; সারা দেশে সংখ্যা দু’টি যথাক্রমে ১৬,৫১৭ ও ৫৪৫। এর পর থেকেই ‘ন্যাশনাল ভেক্টর বর্ন ডিজ়িজ় কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’-এর অংশ হিসাবে ডেঙ্গির নজরদারি শুরু হয়। সে সময় থেকে এই শতকের প্রথম দু’দশকের সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতে ডেঙ্গির প্রকোপ মোটের উপর ক্রমবর্ধমান। ২০১৬-২০১৯, এই চার বছর পশ্চিমবঙ্গ ছিল ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যায় দেশে শীর্ষে। ২০১৯-এ এ রাজ্যে প্রায় ৪৮,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন, দেশে সংখ্যাটা ছিল দু’লক্ষের উপরে। এখানে উল্লেখ্য, বছর কয়েক আগে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতে প্রকৃত ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের ২৮২ গুণ!
২০০৭-এ ভারত সরকার ডেঙ্গি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার মূল কথা ডেঙ্গি আক্রান্ত মানুষকে দ্রুত চিহ্নিত করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক ‘এডিস ইজিপ্টাই’ মশার নিধন ও তার বংশবৃদ্ধি রোধ করা। পরিকল্পনায় শুধু ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাবের সময়ই নয়, সারা বছর মশার বংশবিস্তারে নজর রাখার কথা বলা হয়। দুঃখজনক, ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়লেই এই কাজে জোর দিতে দেখা যায়, তখনই মশার লার্ভার খোঁজ, মশা মারার রাসায়নিক স্প্রে করা ইত্যাদি দেখা যায়। পরিকল্পনায় মশার বংশবিস্তার আটকানোর জন্য নিকাশিব্যবস্থার উপরেও জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এই বিষয়টি ব্যর্থ হচ্ছে। জলাভূমি বুজিয়ে নগরায়ণের ফলে নিকাশিব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ছে, যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য নিকাশির কাজ কঠিন করে তুলছে। দিল্লিতে গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রজননের জন্য ডেঙ্গির মরসুমে মশার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা কঠিন বর্জ্য, যার বড় অংশই প্লাস্টিক। অথচ ডাবের খোলা বা টায়ারে জমা জল নিয়ে যত সতর্ক করা হয়, প্লাস্টিক গ্লাস-কাপ-প্যাকেটের বিষয়ে তত নয়।
এই কর্মসূচির যথার্থ পালনেই যে ডেঙ্গির সংক্রমণ সম্পূর্ণ এড়ানো যাবে, তা নয়। কিন্তু এগুলি কার্যকর না করার অর্থ ডেঙ্গি সংক্রমণের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলা। তাই ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকায় যখন দীর্ঘ দিন আবর্জনা পরিষ্কার না করার, বা রাসায়নিক স্প্রে করার বদলে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে, তখন সরকারের সদিচ্ছা ও সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন জাগে: তবে কি কর্মীর স্বল্পতা বা জনস্বাস্থ্য খাতে খরচই সমস্যা? ২০১৭ সালে ডেঙ্গি মোকাবিলায় মানুষের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটি পরিকল্পনা করে, কিন্তু রাষ্ট্রের দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকার অভাবে মানুষের উপর তার প্রভাব পড়েনি। ডেঙ্গি মোকাবিলায় সাধারণ মানুষেরও কিছু করণীয় আছে, অনেকেই বোঝেন না। দিল্লির এক সমীক্ষা দেখিয়েছে, ৫৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ খেয়ালই রাখেন না তাঁর বাড়ির আশেপাশে মশা জন্মানোর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে কি না। ভারতের স্বাস্থ্যনীতিতে জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার না থাকাতেই, জনস্বাস্থ্যের অবহেলাতেই কর্মসূচিগুলির দশা গয়ংগচ্ছ হয়। অথচ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এদের গুরুত্ব অপরিসীম।
রাষ্ট্রের উদাসীনতার আরও নজির রয়েছে। কোনও রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে ডেঙ্গি পরীক্ষার কত কিট পাবে, তা নির্ভর করে কোনও নির্দিষ্ট বছরের ঠিক আগের বছর ওই রাজ্যে কোন মাত্রায় ডেঙ্গি সংক্রমণ হয়েছিল তার উপর। পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এ ডেঙ্গি সংক্রমণ কম হওয়ায় এ বছর এ রাজ্যের জন্য প্রাথমিক ভাবে মাত্র ৮০টি কিট বরাদ্দ হয়েছে। রাজ্যের হাতে পূর্বসঞ্চিত কিট না থাকলে, কোনও বছর ডেঙ্গি সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে গেলে কিটের অভাবে চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন তাঁরা, যাঁদের বেসরকারি চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা নেই। অথচ একটি গবেষণাপত্র বলছে, যথাসময়ে চিকিৎসা হলে ডেঙ্গি রোগীদের এক শতাংশেরও কম মারা যান।
ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব এখন গ্রামীণ এলাকাতেও। জলবায়ু পরিবর্তন এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধিতে আলাদা মাত্রা দিতে শুরু করেছে। অন্য দিকে, ডেঙ্গিতে মৃত্যুর খবরও মানুষকে সে ভাবে বিচলিত করছে কই! ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন করার লোকও কম।
প্রতীচী ইনস্টিটিউট। মতামত ব্যক্তিগত