আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে সারা রাজ্য যখন উত্তাল, ঠিক তখনই আর একটি নৃশংস হত্যার সংবাদও স্তব্ধ করে দেয়। ঝাড়গ্রামে একটি গর্ভিণী হাতির পেটে জ্বলন্ত রড ঢুকিয়ে খুন। স্বাভাবিক ভাবেই দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথমটির তুলনায় অনেক কম প্রচার ও গুরুত্ব পেয়েছে। তবু যাঁরা দু’টিকে জুড়ে নিয়ে প্রতিবাদ করতে প্রাণিত হয়েছেন তাঁদের সমমর্মিতা ও অভিনন্দন জানাই। তাঁরা শুধু পশুপ্রেমী নন, তাঁরা মানুষের দর্শন ও রাজনীতিকে গভীরতর তাৎপর্য দিচ্ছেন। জেনে বা না-জেনে তাঁরা আমাদের উত্তর-মানবতাবাদী দর্শনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, যার চর্চা এ দেশে বিরল।
শুধু সমাজবিদ্যা-লগ্ন উত্তর-মানবতাবাদ নয়, বিবর্তনতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক কিছু চর্চাও আমাদের জানাবোঝা অনেক বদলে দিয়েছে। আজ আমরা জানি, মানুষের উপর মানুষের আর পশুর উপর মানুষের দমন-পীড়নের উৎস একই। বস্তুত মানব প্রজাতির দমন-পীড়নের কাঠামোয় পশু-মানুষের মধ্যে প্রাচীরটির কেন্দ্রীয় অবস্থান। তাই মানুষের মঙ্গলচিন্তা করতে গেলেও পশুদের কথা আসতেই হবে।
প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শনে পশুর আত্মার অনস্তিত্বের কথা বলা (ভারতে পশু-আত্মার স্বীকৃতি থাকলেও সে আত্মাকে মানুষের তুলনায় হীনই ভাবা) থেকে আধুনিক ইউরোপে জ্ঞানদীপ্তির আবহে রেনে দেকার্তের একমাত্র মানুষকেই মন-মননের অধিকারী আর পশুদের যন্ত্রবৎ বলে ঘোষণা— পশুদের সম্পর্কে মানুষের ভাবনা বরাবরই অযৌক্তিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ। সেই কারণে মানুষের নৈতিকতায় বরাবরই প্রজাতিগত পাঁচিল তোলা।
কিন্তু ডারউইন একই প্রাণের উৎস থেকে মানুষ ও নামানুষ প্রাণীদের বিবর্তনের কথা বলার পর থেকে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণা প্রমাণ করেছে, যে প্রাণীর মস্তিষ্ক ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র যত বিবর্তিত, তার ক্ষেত্রে বাঁচাটা তত বেশি সচেতন। নামানুষ প্রাণী, বিশেষত স্তন্যপায়ীদের (যাদের মধ্যে অবশ্যই হাতি আছে) যুক্তিবুদ্ধি যে যথেষ্ট উন্নত, সেটা পরিষ্কার। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এটাও দেখিয়েছেন, মানুষ যতই তার যুক্তিবুদ্ধি নিয়ে গর্ব করুক, এ সবকেও আসলে চালনা করে আবেগ। তবু কেন মানুষ নিজেকে খুব ব্যতিক্রমী মনে করে? শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবে ডগমগ করে? এটা তার প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতা আর প্রজাতিকেন্দ্রিক চিন্তার জন্য।
অথচ যে ভাবে মানুষ নামানুষদের অপরায়ণ করে, ঠিক সে ভাবেই অনেক মানুষকেও তো করে। এই বক্তব্যটা অবশ্য উত্তর-মানবতাবাদের আগেই রেখেছিল উত্তর-আধুনিকতাবাদ। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশক থেকে পাশ্চাত্য-উদ্ভূত ‘উদার মানবতাবাদ’কে প্রশ্ন করে আসছেন উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিকরা, তৎসহ উত্তর-ঔপনিবেশিক ও নারীবাদী তাত্ত্বিকরাও। কারণ এই দর্শন অনেক ব্যতিক্রমের জায়গা রেখে দিয়েছে।
তবে উত্তর-মানবতাবাদ মানবসমাজের এই দমন-পীড়নের প্রক্রিয়াটিকে শুধু আধুনিকতা নয়, মানব সভ্যতার সামগ্রিক ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখছে। বরাবরই তো ‘মানুষ’ নামে প্রকরটি ফাটলে ভর্তি। প্রাচীন যুগে ক্রীতদাসরা যথাযথ মানুষ বলে গণ্য হত নাকি? মেয়েরা? দলিতরা? আধুনিক যুগে উপনিবেশের মানুষ, কালো মানুষ? আর এটাও উত্তর-মানবতাবাদীরা দেখান যে, যাদের বাদ দেওয়া হল তাদের অপর, অবমানব, অনেকটা যেন পশু বলেই প্রতিপন্ন করা হল। পশু মানে যাদের অস্তিত্ব দেহসর্বস্ব, মন বলে কিছু নেই; অতএব যাদের কোনও অধিকার থাকতে পারে না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রাণের অধিকারও নয়। এখানেই পশুদের প্রতি মানুষের ব্যবহার আর মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহারের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। আবার পশুদের অধিকার নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, সেই পিটার সিঙ্গার, টম রেগান-রাও পশুদের আর মানুষের উপর মানুষের অত্যাচারের মধ্যে সমান্তরালতা খুঁজে পেয়েছেন।
দেকার্তীয় দেহ-মনের দ্বৈততাকে চ্যালেঞ্জ করে শরীরের গুরুত্ব আজ বিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যা উভয়ত স্বীকৃত। সেই শরীর, যা মানুষের মতো আর সব প্রাণীরই আছে। মনও পড়ে সেই শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই। শারীরিকতাকে সংস্কৃতির গর্বে মানুষ উপেক্ষা করে। কিন্তু সব প্রাণীই শরীরটাকে ভাল রাখতে চায়। শারীরিক আঘাত, অসুখ, মৃত্যু সবার পক্ষেই যন্ত্রণাদায়ক। জৈবিকতার স্তরে কী ভাবে মানুষ মানুষকে শাসন করে, সেটা সমাজবিদ্যায় ব্যাখ্যা করেছিল ফুকোর জৈবক্ষমতার (বায়োপাওয়ার) তত্ত্ব। এর পর এলেন জাক দেরিদা, কেরি উলফ প্রমুখ উত্তর-মানবতাবাদীরা। দেরিদা তাঁর জীবনসায়াহ্নে পশুবিদ্যা চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বলেছিলেন, “প্রশ্নটা এই নয় যে, ওরা কথা বলতে পারে কি না, বা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে কি না, প্রশ্নটা হল, ওদের কি কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়?” প্রশ্নটা মানব সভ্যতায় কোনও দিন এই ভাবে তোলা হয়নি বলেই মানুষের দর্শন, নীতি, রাজনীতি সবই দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষের জন্যে কিছু মানুষকে বলি দেওয়ার প্রথার উপর (পশুদের কথা ছেড়ে দিলেও)। কখনও ব্যক্তিহত্যা, কখনও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। অথবা জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা। এতে অন্যায় কিছু দেখে না মানবসভ্যতা, কোনও দিন দেখেনি।
অর্থাৎ, এইখানে দেরিদার বক্তব্য সমমর্মিতা (এমপ্যাথি) ও সহমর্মিতার (সিমপ্যাথি) আবেগ থেকে দর্শনের ক্ষেত্রে প্রবেশ করছে; এবং মানুষের জীবন ও জগতের মূলগত বোধ নিয়ে, তার চিন্তার ধাঁচা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে; যার বিরাট তাৎপর্য শুধু পশুদের জন্যই নয়, মানুষের জন্যও। একই পৃথিবীর ভূমিতে মানুষ পশু সবাই জন্মালেও, মানুষই কেন সার্বভৌমত্বের দাবি করে পশুদের পীড়ন করবে— এ প্রশ্নটাও দেরিদা তুলেছেন। অর্থাৎ, কেন আমরা হাতিদের নিজস্ব বাঁচার জায়গা কেড়ে নিয়ে তার পর নিরুপায় তারা আমাদের বসতির কাছে এলে তাদের খুন করব? দেরিদা আরও বলেন, পশুর সঙ্গে মানুষের সবচেয়ে বড় তফাত একটাই— পশুরা মানুষের মতো ‘পাশবিক’ হতে পারে না। সত্যি তো, আর জি করে ডাক্তার মেয়েটিকে যে ভাবে খুন করা হয়েছে বা ঝাড়গ্রামে মা-হাতিটিকে, সেটা কোনও পশুর পক্ষে অভাবনীয়।
যাদের ‘আমাদের লোক’ মনে করি, তাদের জন্যই শুধু আমাদের বিবেক সক্রিয়, ‘অপর’-এর জন্য নয়। আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে আছে ‘অ্যামিগডেলা’, যা অপরায়ণ আর আগ্রাসনের উৎস। পশুরা তো খুবই আলাদা চেহারার— আমাদের ‘সর্বাধিক অপর’। মানুষের ক্ষেত্রেও কিন্তু পুরুষ না নারী, সাদা না কালো, কিংবা কোনও সাংস্কৃতিক চিহ্নের সাহায্যে সে হিন্দু না মুসলমান— এ রকম আমরা চট করে বুঝে নিই। আর ‘অপর’কে শত্রু ভাবা, তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা, তাকে পীড়ন করা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কেউ অন্য রকম হলে যে তাকে শত্রুই ভাবতে হবে তার অবশ্য কোনও মানে নেই। তাকে অতিথি ভাবা যায়, বন্ধু ভাবা যায়। কিন্তু প্রায়শই আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ অপরায়ণকে হিংস্রতায় পরিণত করে, আমাদের ভিতরকার সমমর্মিতা, সহমর্মিতার সম্ভাবনাকে পঙ্গু করে দিয়ে। তাই যাদের পছন্দ নয়, তাদের পশুবৎ জ্ঞান করে দাবিয়ে রাখা, নিজের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করা, ইচ্ছেমতো তাদের হত্যা করা। এটাই হল মানব প্রজাতির রাজনীতি।
আজ প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্কট, মানুষের নিজেদের মধ্যে ভয়াবহ হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে এই নীতি ও রাজনীতিকে প্রশ্ন করা জরুরি হয়ে পড়ছে। অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা ও অবিভাজ্য একটি গোষ্ঠী হিসাবে না দেখে বরং মানব-অস্তিত্বকে প্রাণের অস্তিত্বের সঙ্গে মিলিয়ে, সমগ্র প্রাণী-জগতের অংশ হিসাবে দেখার আহ্বান আসছে। উত্তর-মানবতাবাদীদের আগেই ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের আডোর্নো ও হরখাইমার ধনতন্ত্রের ধ্রুপদী মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণকে প্রসারিত করে তার মধ্যে পশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
সমাজের ইমারতে একেবারে উপরে একচেটিয়া পুঁজির মালিক থেকে নামতে নামতে বেসমেন্টে তাঁরা দেখেছিলেন কসাইখানা, যা পশুদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা আর প্রজাতি-কেন্দ্রিকতার বাঁ দিক থেকেই কি আমাদের নতুন বামপন্থার সূচনা হতে পারে?