ভারতে আজ পাশাপাশি দু’টি সমস্যা লক্ষ করা যাচ্ছে। এক দিকে তরুণদের মধ্যে কর্মহীনতা, অতিমারির আগেই দেশে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় সাত শতাংশ, কোভিডের প্রভাবে তা এখন প্রায় ২০ শতাংশ ছুঁতে চলেছে। দেশে তেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের নারী-পুরুষ প্রায় বাহান্ন কোটি, তাই বেকারত্বের সমস্যার আকার বেশ বড়। অন্য দিকে, বেশ কিছু কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর অভাবের ফলে পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে, যার অন্যতম হল স্বাস্থ্য পরিষেবা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে যত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, তার অর্ধেকই নেই। দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন। সরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়েদের তো বটেই, স্কুলছুট ছেলেমেয়েদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ এবং রোগীর পরিচর্যার কাজে নিয়োগ করা যায়। তাতে জনস্বাস্থ্য যেমন সুরক্ষিত হবে, তেমনই গ্রাম-মফস্সলে কয়েক লক্ষ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানও হবে।
আমাদের হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার ও নার্সের অভাব আছে, এ কথাটা যথেষ্ট আলোচিত। তুলনায় কম বলা হয় যেটা, অভাব আছে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীরও। অথচ, হাসপাতালের চিকিৎসার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ পার্শ্ব স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন কম নয়। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্যও তাঁদের প্রয়োজন। কোভিড অতিমারি গোটা বিশ্বকে শিক্ষা দিয়েছে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা। বড় হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই, কিন্তু শুধু তা দিয়ে স্বাস্থ্য-বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়, স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নও সম্ভব নয়। কেরলে কোভিড সর্বপ্রথম আসে, এবং দ্রুত ছড়ায়। তবু সে রাজ্যে মৃত্যুহার কম রাখা গিয়েছিল, যার প্রধান কারণ তৃণমূল-স্তরের প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সফল ব্যবহার। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের সব রাজ্যে প্রয়োজন প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মী, যাঁরা মানুষের পাশে থেকে জনসমাজে সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করবেন এবং নিয়মিত তথ্য দেবেন সরকারকে, যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ায় সহায়তা করবেন, রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলি সম্পর্কে অবহিত করবেন।
এখন এই কাজগুলির দায়িত্ব অনেকটা পালন করেন আশা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। কিন্তু সেটা কোনও পরিকল্পিত ব্যবস্থা নয়, কাজ চালানোর একটা চেষ্টা মাত্র। প্রথমত, তাঁদের যা নিয়মিত কাজ, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড প্রতিরোধ করতে গিয়ে সে কাজে কত ক্ষতি হয়েছে, তা এখন চোখে পড়ছে। বিচিত্র বিপুল কাজের বোঝা তাঁদের ঘাড়ে চাপানো অন্যায়, তাতে কোনও কাজই ঠিক মতো হয় না। দ্বিতীয়ত, জনসমাজ (কমিউনিটি) স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করার প্রশিক্ষণও তাঁদের নেই। কারণ সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ-নির্ণয়, ডাক্তারের পরামর্শ এবং কিছু পরীক্ষা, সবই চৌকাঠে পৌঁছনো যাবে।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, উভয়ের পক্ষ থেকেই স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু নানা কারণে গ্রামের তরুণ-তরুণীদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে তার সুযোগ। এক তো অনেকে সে বিষয়ে জানতেই পারছেন না। তার পরেও এই পাঠ্যক্রমগুলি দুই বা তিন বছরের। দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য যা উপযুক্ত নয়, কারণ অর্থোপার্জনের জন্য বাড়ির দিক থেকে একটা চাপ থাকে। অনেক পড়ুয়া এত দীর্ঘ দিন মনোযোগও রাখতে পারেন না (মনে রাখতে হবে আমরা স্কুলছুটদের প্রশিক্ষণের কথাও বলছি)। অপেক্ষাকৃত স্বল্পমেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সও রয়েছে, কিন্তু রাজ্যগুলির হাসপাতাল-সংক্রান্ত আইন (‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট’) অনুযায়ী হাসপাতালে চাকরিতে তার মান্যতা নেই। প্রশ্ন করা চাই, সত্যিই কি সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীর দু’তিন বছরের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন? ওষুধের দোকানের পার্শ্বকর্মী বা রক্তসংগ্রহকারী কর্মীরও? উত্তরটা হল, একেবারেই নয়। সহকারী স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ স্বল্পমেয়াদের প্রশিক্ষণেও করা যায়। অতএব বিধিতে নমনীয়তা আনতে আইনে পরিবর্তন প্রয়োজন।
গলদ প্রশিক্ষণের পরিচালনাতেও। সরকারি খরচে কোর্স করা যায়, কিন্তু সরকার পড়ুয়াদের সংখ্যার ‘টার্গেট’ দেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। তার কর্তারাও হাজার বা দু’হাজার পড়ুয়া জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়। অভাবী গ্রহীতা কোর্সের খোঁজ পেল কি না, কোর্সের গুণমান বজায় রইল কি না, পড়ার পরে কর্মসংস্থান হল কি না, এ সব প্রশ্ন উপেক্ষিত হয়।
আরও কর্মসংস্থান, এবং জনস্বাস্থ্যের প্রসার, এই দু’টি সমস্যারই সমাধান হতে পারে স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ ও নিয়োগে। দরকার এখন মনোভাবে পরিবর্তন। স্বল্পমেয়াদি কোর্সে সার্টিফিকেট পেলেও যে কাজ করা যায়, তার জন্য ডিগ্রি-ডিপ্লোমা দাবি করা। কিংবা, স্বাস্থ্যকর্মী যে কাজ করতে পারেন, তার জন্য ডাক্তারকে ব্যস্ত না রাখা। উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার প্রসারও চাই, যার নিয়মিত মূল্যায়ন হবে।