মহাভারতের নায়ক কে, সে প্রশ্ন তুললে কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের নামই সামনে আসে বেশি, কখনও বা ভীষ্ম, কর্ণ, কিংবা স্বয়ং ব্যাসের নাম। সম্প্রতি সুদীপ্ত কবিরাজ একটি প্রবন্ধে (‘মহাভারত: দ্রৌপদীর কাহিনী’, শারদীয় অনুষ্টুপ, ২০২৪) লিখেছেন, মহাভারতের নায়ক নেই, কেবল এক নায়িকা আছে— দ্রৌপদী। কারণ, “সাধারণ নারীর অসাধারণ শক্তি” ছাড়া আর কোনও আয়ুধ নেই দ্রৌপদীর। দৈবশক্তির সহায়ে অতিমানবিক শক্তি ছিল পুরুষ চরিত্রদের (কর্ণের কবচকুণ্ডল, অর্জুনের দৈব অস্ত্র, ভীমের শক্তি), আর দ্রৌপদীর ছিল কেবল বুদ্ধি, সাহস আর স্বতন্ত্রতা। “যোদ্ধাদের পরীক্ষা কেবল বীরত্বের, অন্য যোদ্ধার সঙ্গে শক্তির সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে; প্রধান এবং জটিল পরীক্ষাগুলো নারীদের জন্যে বিশেষ করে রাখা— সীতার অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদীর অগ্নিপরীক্ষা, সাবিত্রীর মৃত্যুর অপেক্ষা, কুন্তীর কানীন পুত্রের জন্ম, গান্ধারীর স্বামীর অন্ধত্বের সহচারিণী হওয়া— সবই তার থেকে অনেক বেশি কঠিন, তার জন্যে অনেক বেশি সাহসের, বুদ্ধির ও সহনের শক্তির প্রয়োজন।” এ কথা যে কত সত্যি, কে না জানে। অদৃষ্টের মার, প্রবলের অত্যাচার, নিকটজনের পীড়ন, সব কিছুর মোকাবিলা করে নিজে বাঁচা, অপরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও চাই পৌরুষ। তার প্রকাশ কি মেয়েদের মধ্যেই অধিক নয়? দ্রৌপদী সব অতিমানবিক মানুষীদের যথার্থ প্রতিনিধি।
সীতাকে কেন্দ্রে রেখে রামায়ণ, দ্রৌপদীকে কেন্দ্রে রেখে মহাভারত, এ সব বিকল্প পাঠ ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের নতুন নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করে। তবে সুদীপ্ত কবিরাজ যে দ্রৌপদীকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তা কেবল দ্রৌপদী কী করেছেন, সে জন্য নয়। মহাভারতের কাহিনিতে দ্রৌপদীর অবস্থানটি অনন্য। মহাভারতের নানা ঘটনায় (দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, দুঃশাসনের রক্তপান) এমন ‘অতিশয়ী পাপ’ রয়েছে, যা কেবল ঘটনাটির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, নীতিবোধের সীমা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। ‘ধর্ম কী’, এ প্রশ্ন ছাড়িয়ে ভাবতে হয়, ধর্ম বলে কিছু কি আছে? ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, যুধিষ্ঠির, কর্ণ, কৃষ্ণ, অর্জুন, সকলেই এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু মহাভারতের কাহিনির “কেন্দ্রের অগ্নিবিন্দুর মতো” রয়েছেন দ্রৌপদী। সভাস্থলে তাঁর বস্ত্রহরণের চেষ্টা এবং অন্যদের দর্শনলালসায় মূক হয়ে থাকা, এটা এমন এক পাপের আখ্যান তৈরি করেছে যাতে সব পুরুষই লিপ্ত, সব পুরুষের বিরুদ্ধে এক “সাধারণীকৃত অভিযোগ।”
কথাটা ভুল নয়, তবে খুব কি বড় কথা? ধর্ষকাম মনোবৃত্তি সব পুরুষের আছে, হয়তো সব মানুষেরই, সেটা মেনে নেওয়া কী এমন কঠিন, যে তার উদ্ঘাটনের জন্য দ্রৌপদীর ভয়ানক অপমানের দরকার হল? তাঁর প্রতি অতিশয়ী হিংসা যে অতিকায় পাপের দিকে আঙুল তোলে, তা ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের। হস্তিনাপুরে তাঁর লাঞ্ছনা হয়েছিল রাজসভাতেই, আর মৎস্যরাজ্যে এক রাজপুরুষ দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন রাজসভায়। কীচক সর্বসমক্ষে সৈরন্ধ্রীর চুল ধরে টেনে তাঁকে পদাঘাত করেছিল। কৌরবসভায় ধর্মের সূক্ষ্ম প্রশ্ন তুলেছিলেন দ্রৌপদী (তিনি বিজিতা না অজিতা), বিরাটসভায় কিন্তু সরাসরি বললেন, “রাজা আপনি কীচকের প্রতি রাজবৎ আচরণ করছেন না, আপনার ধর্ম দস্যুর ধর্ম।” বিরাট বললেন, “আমার অজ্ঞাতসারে তোমাদের মধ্যে কী বিবাদ হয়েছে, তা আমি জানি না। তথ্য না জেনে আমি বিচার করব কী করে?” এই শীতল বিচক্ষণতার পর দিনই দেখি, কীচককে নিহত দেখে খেপে উঠে কীচকের দলবল দ্রৌপদীকেও পুড়িয়ে মারতে চাইল। অমনি সায় দিলেন বিরাটরাজ। আসলে কীচক আর তার দলবলকে ডরাতেন রাজা। পড়ে প্রভাবশালীর ফাঁদে, রাজধর্ম কাঁদে।
আরও এক বার আক্রান্ত হয়েছিলেন দ্রৌপদী, জয়দ্রথের হাতে। দ্রৌপদীকে সে জোর করে রথে তুলছে দেখে পুরোহিত ধৌম্য বলছিলেন, “জয়দ্রথ, তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করো, মহাবল পাণ্ডবদের পরাজিত না করে তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পারো না।” মেয়েদের আপত্তির মূল্য তখন ধর্মের অনুশাসনে ছিল না। আধুনিক রাষ্ট্রের ধর্মপুস্তক তার সংবিধান। যার কেন্দ্রে রয়েছে মানবাধিকার, নারী-পুরুষ সাম্য। তবু আমরা দেখছি, মেয়েদের উপর দিন-দুপুরে হামলা, যা এক জন পথচারীও থামাতে ছুটে আসেন, তার বিচার করতে গিয়ে রাষ্ট্র অদ্ভুত সব অস্বচ্ছতা, জটিলতা তৈরি করছে। যারা অভিযুক্ত, তাদেরকেই ‘আক্রান্ত,’ ‘ষড়যন্ত্রের শিকার’ বলে দেখাতে চায়, উত্তরপ্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, সর্বত্র।
কেন এমন হচ্ছে? রাষ্ট্র পুরুষতান্ত্রিক, বললেই হল না। একটা মেয়ে কোনও এক পুরুষের বিরুদ্ধে চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের নালিশ করলে তো কই মেয়েটির কথায় রাষ্ট্র সন্দেহ করে না। অথচ, ধর্ষণের সত্যতাই স্বীকার করতে চায় না সরকার, হত্যাকে বার বার ‘আত্মহত্যা’ বলে চালাতে চায়। কেন? এর অন্তত একটা কারণ, কার কথা মান্যতা পাবে, কে সত্য নিরূপণ করতে পারে, কোন কাজের কী অর্থ (সহমতে সঙ্গম না কি ধর্ষণ) তা নির্দিষ্ট করতে পারা খুব বড় ক্ষমতা। পুরুষ সে ক্ষমতা নারীকে, উচ্চবর্ণ দলিতকে, ধনী গরিবকে, শাসক শাসিতকে কিছুতেই দিতে পারে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জুনিয়র ডাক্তারদের বলেন, “কারও নামে অভিযোগ থাকলেই তাকে অভিযুক্ত বলা যায় না,” তখন শব্দের অর্থ-নিরূপণের ক্ষমতা নাগরিকের হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে নেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী স্ত্রীলিঙ্গ হয়েও পুং, আর বিচারপ্রার্থী লিঙ্গ-নির্বিশেষে স্ত্রী। নাগরিকের বাক্য থেকে অর্থ-অপহরণ কার্যত মানুষকে ভাষাহীন পশু, বা বস্তু করে তুলতে চায়। এই হল সেই অতিশয়ী পাপ, যার সামনে দাঁড়িয়ে ‘রাজধর্ম কী?’ এ প্রশ্ন ছাড়িয়ে ভাবতে হয়, ‘শাসকের কি ধর্ম বলে কিছু হয়?’
অতিশয়ী পাপ যেমন ব্যক্তির নীতিবোধের সীমা নিয়ে সংশয় তৈরি করে, তেমনই রাজনীতির সীমা নিয়েও। নারীর (এবং নিম্নবর্ণের, দরিদ্রের) বঞ্চনার ভিত্তিতে নির্মিত একটা ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে গেলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হিংসা অনিবার্য। ধর্ষিত মেয়ে বিচার চাইলে এত আলোড়ন ওঠে, কারণ শাসকের দুটো ভূমিকার মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ন্যায়-প্রদানকারী ভূমিকা ছাড়লে শাসনের নৈতিক ভিত্তি টলে যায়, আবার মেয়েদের কথাকে পুরুষের কথার সমান মর্যাদা দিলে অর্থনৈতিক (অর্থবণ্টনের কায়েমি নীতি) ভিত্তি টলে যায়। এই সঙ্কট অতি তীব্র হয় যখন সমাজে অতি-সম্মানিত মেয়েরা— সম্রাজ্ঞী কিংবা চিকিৎসক— রাষ্ট্রের কাছে বিচার চায়। রাজশক্তি বেসামাল হয়ে পড়ে। তাই রব তোলে, ধর্ষণের বিচার যারা চাইছে, তারা আসলে অরাজকতা চাইছে।
অন্য দিকে, বিবস্ত্র মেয়ের সামনে শাসকের ‘বিশ্বধাতা’ ভাবমূর্তি যে ঢিলে পেন্টুলের মতো খসে যায়, মেয়েদের কাছে তা জীবনসঙ্কট। কারণ, শাসকের কাছে বিচার তো সে পায়ই না, উল্টে শাসককে লজ্জা দেওয়ার শাস্তি পেতে হয় মেয়েটাকেই।
যেমন পেয়েছিলেন দ্রৌপদী। যিনি তাঁকে লাথি খেতে দেখে নীরব ছিলেন, যিনি তাঁকে পুড়িয়ে মারতে বাধা দেননি, সেই বিরাটকে বৈবাহিক বলে গ্রহণ করতে দ্রৌপদীর কেমন লেগেছিল, ব্যাস সে বিষয়ে নীরব। বিচার পেতে গিয়ে তাঁকে হারাতে হয়েছিল নিজের পিতা, ভাই, এমনকি পঞ্চপুত্রকে। শোকাকুলা দ্রৌপদী কখনও কি ভেবেছিলেন, এর চাইতে মুখ বুজে থাকলেই ভাল হত? বহু যুগের ওপার হতে ব্যাস যেন আজও মেয়েদের সতর্ক করছেন, ধর্ষণের বিচার চেয়ো না। অম্বার মতো আত্মহত্যা করে, ক্লীব হয়ে জন্মে সামনাসামনি যুদ্ধ করো, কিন্তু নারী হয়ে নারীর অপমানের প্রতিকারের চেষ্টা কোরো না। দেখো, রক্তাক্ত একবস্ত্রে রাজ্য ছেড়ে বনগমন দিয়ে এক সম্রাজ্ঞী যে যাত্রা শুরু করেছিল, তার শেষ হয়েছিল পুত্রদের দেহের সামনে বায়ুকম্পিত কলাগাছের মতো ভূলুণ্ঠিত হয়ে। দ্রৌপদী যেমন মেয়েদের অসাধারণ শক্তির প্রতিমূর্তি, তেমনই অসামান্য বিপন্নতারও।