তাগিদ: জলবায়ুর ভয়াবহ পরিবর্তন রোধের দাবিতে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ সমাবেশ; মিলান, ইটালি, অক্টোবর ২০২১। রয়টার্স।
অন্ধকার সময়েও কি গান হবে?
হ্যাঁ, হবে, অন্ধকার সময়ের গান।
— বের্টোল্ট ব্রেশ্ট
সাল ১৬৪২। যমুনার তীরে তাজমহল তৈরির কাজ চলছে। শাহজাহান আগের বছর মেজো ছেলেকে বাংলার সুবাদার করে পাঠিয়েছেন। পরের বছর ফ্রান্সে শুরু হবে চতুর্দশ লুইয়ের দীর্ঘ রাজত্ব। চ্যানেলের অন্য পারে প্রথম চার্লসের সঙ্গে পার্লামেন্টের ধুন্ধুমার লড়াই শুরু হয়েছে, যার পরিণামে সাত বছর পরে রাজার গর্দান যাবে। ইউরোপের দেশে দেশে ‘ডাইনি’ নিধনের মহাযজ্ঞ চরমে উঠেছে। এবং, মহাদেশের পলাতক ও ভাগ্যান্বেষীরা অতলান্তিক পার হয়ে নয়া দুনিয়ায় পৌঁছে ঘাঁটি গাড়ছেন, উত্তর আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে পত্তন হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ বসতির, জবরদখলের লীলায় দ্রুত বেড়ে উঠছে ‘নিউ ইংল্যান্ড’।
সেই ১৬৪২ সালে পূর্ব আমেরিকার এক জনজাতির নেতা, নাম তাঁর মিয়ান্তোনোমি, আশপাশের বিভিন্ন জনজাতির প্রধানদের উদ্দেশে এক বার্তা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তিনি, “আমাদের সকলের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। আপনারা তো জানেন, আমাদের পূর্বপিতাদের অনেক হরিণ ছিল, অঢেল চামড়ার জোগান ছিল, আমাদের সমভূমি জুড়ে ছিল হরিণের পাল, বনজঙ্গলে বিস্তর টার্কি, জলাভূমিতে অফুরন্ত মাছ। কিন্তু ইংরেজরা আমাদের জমি দখল করেছে, তাদের কাস্তে দিয়ে তৃণভূমি সাফ করেছে, তাদের কুঠারে গাছেরা নির্মূল হয়েছে; ওদের গরু আর ঘোড়ার পাল সব ঘাস খেয়ে ফেলছে, ওদের শুয়োররা আমাদের উপকূলে যেখানে ক্ল্যাম (অন্যতম সি-ফুড) পাওয়া যায় সেই জায়গাগুলোকে নষ্ট করছে, আমরা কেউ আর খেতে পাব না।”
আদি-বাসিন্দাদের একজোট করে উপনিবেশ বিস্তারের অভিযানকে ঠেকাতে চেয়েছিলেন এই গোষ্ঠীপতি। পারেননি। তাঁর কাঙ্ক্ষিত জোট বাঁধা বাস্তবে সম্ভব ছিল না, ‘প্রাচীন’ জনজাতিদের পক্ষে ‘আধুনিক’ ইউরোপের সর্বগ্রাসী হিংস্রতাকে রুখে দেওয়া আরওই অসম্ভব ছিল। অতএব মিয়ান্তোনোমির কথা সত্য হল, দ্রুত তাঁদের মেয়াদ ফুরোল। মহান আমেরিকায় তাঁদের মতো জনজাতিগুলি এখন বিলুপ্ত অথবা সর্বার্থেই প্রান্তিক।
সাল ১৯৮৩। ব্রাজিলের এক শহরে জড়ো হলেন আমাজ়নের বিভিন্ন জনজাতির মানুষরা। সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে সে দেশের নামী লেখক ও আদিবাসী আন্দোলনের শরিক আইলতন ক্রেনাক বললেন, “যারা আমাদের জমি দখল করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে। তা না হলে আমরা হারিয়ে যাব, যে ভাবে হারিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বসূরিরা।... তাঁদের চিরকালের বাসভূমি থেকে আমাদের উৎখাত করতে চাইছে দখলদার কৃষকরা, ওরা বলছে এই জমি এখন ওদের! আমাদের চার পাশে এখন কাঁটাতারের বেড়া আর ওদের প্রতিপালিত গরু-মোষের পাল।”
আমাজ়ন অরণ্যের সংহারলীলায় তখন নতুন পর্ব চলছে। যে দখলদার কৃষকদের কথা ক্রেনাক বলছেন, তাঁদের অনেককেই সেখানে বসিয়েছে অতিকায় কিছু বহুজাতিক কোম্পানি, যারা দুনিয়া জুড়ে কৃষিজাত পণ্য এবং দুধ-দই-পনির-ক্রিম আর মাংসের বাজার বিস্তার করছে দুর্বার গতিতে, আর সেই বাণিজ্যের কাঁচামাল জোগাড় করতে মহারণ্য উজাড় করে চাষবাস এবং পশুপালনের সাম্রাজ্য পত্তন করছে। পরে, এই শতকের গোড়ায় ব্রাজিলে বামপন্থী রাজনীতির উত্থানের ফলে এই মহালুণ্ঠন কিছুকাল প্রশমিত হয়েছিল, এখন আবার তা জারি হয়েছে দ্বিগুণ বিক্রমে, জাইর বোলসোনারো-র তত্ত্বাবধানে অবিশ্বাস্য গতিতে সাফ হয়ে যাচ্ছে আমাজ়নের বনভূমি। ক্রেনাক যেমনটি বলেছিলেন।
১৬৪২ আর ১৯৮৩— দুই আদিবাসী মানুষের কথাগুলো পর পর শুনলে মনে হয়, যেন সাড়ে তিনশো বছরের ও-পার থেকে প্রতিধ্বনি ফিরে এল। ‘চমকপ্রদ সাদৃশ্য’টি আমাদের দেখানোর জন্যই অমিতাভ ঘোষ কাহিনি দু’টির অবতারণা করেছেন তাঁর নতুন বই দ্য নাটমেগ’স কার্স–এ (পেঙ্গুইন)। অসামান্য বইটি নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই, কেবল এই উক্তি দু’টির সূত্র ধরেই এ-গ্রন্থের মূল বক্তব্যের আংশিক আভাস দেওয়া যায়। সেটা এই যে, প্রকৃতির সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে, আজকের ভাষায় যাকে ইকোলজি বা বাস্তুতন্ত্র বলা হয় তার সঙ্গে যে সাযুজ্য রেখে মানুষ এই গ্রহে নিজের জীবনধারাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, কয়েকশো বছরের উন্নততর সভ্যতার কবলে পড়ে তা বিপন্ন। এই যে ‘প্ল্যানেটারি ক্রাইসিস’ এখন একেবারে ঘাড়ের উপরে এসে পড়ল, তার পিছনে আছে আমাদের বিশ্ব-দর্শন, যা এই গ্রহকে এক অতিকায় কাঁচামাল হিসাবে দেখে, যাকে রসদ হিসাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ক্রমাগত আরও আরও মুনাফা তুলে আনা যায়। কয়েক শতাব্দী আগে উপনিবেশের স্রষ্টারা এই দর্শনকেই প্রচণ্ড বিক্রমে তাঁদের দিগ্বিজয়ের অভিযানে প্রয়োগ করেছিলেন। পুরনো উপনিবেশ আজ নেই, আজ আর তার প্রয়োজনও নেই, গোটা গ্রহটাকেই উপনিবেশ করে তোলার অবিরাম তৎপরতা চলছে। এই লেখা লিখতে লিখতেই চোখে পড়ল সমাজমাধ্যমে ভেসে আসা এক ঝলক ভিডিয়ো-চিত্র— জঙ্গলের ভিতরে লোহার শিক আর কংক্রিটের কাঠামো, ইমারত নির্মাণের কাজ চলছে, নির্ঘাত আরণ্যক রিসর্ট তৈরি হবে। আমাজ়ন নয়, সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেরই জঙ্গল। উন্নয়ন কেন বাধ্যতে।
অখিল ক্ষুধায় নিজেকে খেয়ে চলার এই ঔপনিবেশিক আধুনিকতা যে আমাদের খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, চোখ-কান সম্পূর্ণ বন্ধ না রাখলে আজ আর সেই সত্য না-জানার কোনও উপায় নেই। চতুর্দিক থেকে প্রতিনিয়ত সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলার অগণিত সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ উঠে আসছে, রকমারি বিপর্যয়ের নিয়ত অভিজ্ঞতা তাতে সঙ্গত করছে। শতাব্দীর সেরা অতিমারিও তার বাইরে নয়। আরও অনেক বেশি ভয়ানক কোনও ভাইরাসের কবলে পড়তে আমরা আরও এক শতাব্দী সময় পাব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আক্ষরিক অর্থে বাসযোগ্য পৃথিবী বলে আর কিছু আদৌ থাকবে কি না, সে বিষয়ে গভীর সংশয় আছে।
আর তাই, এটা কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয় যে, গত কয়েক বছরে এই গ্রহকে পূর্ণগ্রাস থেকে বাঁচানোর কথা যাদের মুখে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে তীব্র ভাবে শোনা গেছে তারা বয়সে তরুণ, কিশোর, এমনকি শিশু। তারা জানে, এই গ্রহের ভবিষ্যতের সঙ্গে এখন অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে গেছে তাদের টিকে থাকার প্রশ্ন। সুইডেনের অষ্টাদশী গ্রেটা থুনবার্গ কেবল ব্যক্তি নয়, এই মরিয়া তারুণ্যের এক প্রবল প্রতীক। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে গ্রেটা বলেছেন, সম্মেলন করে কিছু হবে না, যদি না লোকে উপলব্ধি করতে পারে যে আমরা একটা অস্তিত্বের সঙ্কটের মধ্যে আছি। এবং, এক নিশ্বাসে জানিয়ে দিয়েছেন, এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের বড় রকমের পরিবর্তন ঘটাতে হবে, যে ব্যবস্থা চলছে তাকে উপড়ে ফেলতে হবে— উই নিড টু আপরুট দ্য সিস্টেম।
সিস্টেম মানে কী? কোদালকে যদি কোদাল বলতে হয়, তবে সিস্টেমের নাম ধনতন্ত্র। দেড়শো বছরেরও বেশি হয়ে গেল, কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন, মানুষ আর প্রকৃতি/পরিবেশ-এর যে নিরন্তর আদানপ্রদান, সেটাই আমাদের অস্তিত্বের শর্ত, ‘যদি আমরা মরতে না চাই, তবে ‘নেচার’-এর সঙ্গে অবিরত কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে’, সেটাই মানবসমাজের বিপাক-প্রক্রিয়া— সোশ্যাল মেটাবলিজ়ম; এবং ধনতন্ত্র এই গ্রহের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে, প্রতিটি পরিসরকে তার মুনাফা বাড়ানোর উপকরণ হিসাবে কাজে লাগানোর অনন্ত তৎপরতার মধ্যে দিয়ে সেই সম্পর্কটাকেই ধ্বংস করে চলেছে, সামাজিক এবং মানবিক প্রক্রিয়ার ভিতরে উত্তরোত্তর ফাটল ধরিয়ে চলেছে। যে ‘মেটাবলিক রিফ্ট’-এর কথা তিনি বলেছিলেন সেই ফাটল কোন চরমে পৌঁছতে পারে, তা আজ আমরা চাক্ষুষ করছি।
কিন্তু চোখে দেখা আর চেতনায় উপলব্ধি করা তো এক নয়। অতএব, চরম সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমরা আছি সুখে হাস্যমুখে। কেবল কয়েক শতাব্দী পার হয়ে মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে হানা দেন সেই আদিবাসী মানুষটি। ঘুমের ঘোরেই বলি: মেয়াদ বুঝি ফুরিয়ে এল।