গ্রাফিক:- শৌভিক দেবনাথ।
অতিমারির কালে, তার পরবর্তী সময়ে এবং অতিমারি কাটিয়ে ওঠার সময়, অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়কালে এবং ২০২৩-এর দিকে যাত্রাপথে বৃহৎ অর্থনীতির কোন দেশটি সব থেকে দৃঢ় ভাবে নিজেকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে কেউ যদি আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) প্রদত্ত পরিসংখ্যানের দিকে তাকান, তিনি অবধারিত ভাবে বিস্মিত হবেন।
‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক’-এর গত ত্রৈমাসিকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে আইএমএফ দেখিয়েছে, অতিমারিকালে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দিক থেকে দেখলে যে দেশটির নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে, সেটি হল তুরস্ক। বিস্ময়ের কারণটি এখানেই যে, তার ডুবন্ত মুদ্রাব্যবস্থা এবং হাস্যকর অর্থনৈতিক নীতির কারণে তুরস্ক পরিচিত। কিন্তু ২০২০ থেকে ২০২১-এর মধ্যবর্তী সময়ে এবং ২০২২-২০২৩ বিষয়ে আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যদি বৃহৎ অর্থনৈতিক নীতির সাপেক্ষে দেখা যায়, তবে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তুরস্কের গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫.১ শতাংশ। গত চার বছরে কোনও দেশের আর্থিক বৃদ্ধিই এই পরিসংখ্যানে পৌঁছাতে পারেনি।
আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০টি অগ্রবর্তী দেশের মধ্যে তুরস্কের পরেই রয়েছে চিন। ২০২২-’২৩ সময়কালে তার আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.৫৫ শতাংশ। তালিকায় এর পরের নামটিও বিস্ময়সৃষ্টিকারী। সেই দেশটি হল মিশর। তার আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.৩ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত (৩.৯ শতাংশ)। পরের নামগুলির দিকে তাকালে সত্যিই শিহরিত হতে হয়। ভারতের পরের নামটি বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের (৩.৬ শতাংশ)। বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশের নামটিও বেশ উজ্জ্বল অবস্থানেই। আর্থিক প্রগতির কয়েকটি বিশেষ মানদণ্ডে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। ইসলামি বিশ্বের দেশগুলির তুলনায় যা একটি ব্যতিক্রম। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, সৌদি আরব ২০২২ সালের দ্রুততম আর্থিক বৃদ্ধির দেশ বলে তালিকাভুক্ত হয়ে উঠতে পারে (শুধুমাত্র খনিজ তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে)।
চিনের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় প্রশ্নটি এই যে, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং বয়সের নিরিখে কর্মক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেশটির অবস্থা বেশ শোচনীয় বলেই মনে হয়। আইএমএফ-এর হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর এবং আগামী বছরেও চিনের বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নীচে থাকবে। এই অবস্থা কয়েক দশক ধরেও চলতে পারে। রিয়েল এস্টেট এবং লগ্নিকরণ ক্ষেত্রগুলিতে সমস্যা জমতে জমতে তা বৃহত্তর অর্থনীতির ক্ষেত্রকেও আহত করতে পারে। কূটনৈতিক ভাবে বিদ্বিষ্ট পশ্চিম আবার আমদানিকেন্দ্রিক বৃদ্ধির বিষয়ে চিনের সামনে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে চিনা সংস্থাগুলি যে কোনও রকম বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।
ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, অতিমারির প্রথম বছরে (২০২০-২০২১ অর্থবছর) এ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পরিমাণ খুবই কম ছিল। গত বছরেও বৃদ্ধির হার লক্ষণীয় ভাবে ধীর গতিসম্পন্নই ছিল। আইএমএফের পরবর্তী দু’বছর সম্পর্কে বক্তব্যকে মেনে নিলে দেখা যায়, ভারত দ্রুততম আর্থিক বৃদ্ধির ৩০টি দেশের তালিকায় (আইএমএফের তৈরি) বিরাজ করছে। ভারত সম্পর্কে চলতি বছর এবং পরবর্তী বছর সম্পর্কে আইএমএফ-প্রদত্ত বৃদ্ধির পরিসংখ্যান হল ৬.৮ শতাংশ। আইএমএফের এই উজ্জ্বল আশার বাণীকে অর্থনীতি বিষয়ক বহুপাক্ষিক এবং ব্যক্তিগত স্তরের ভবিষ্যদ্বক্তারা মেনেও নিচ্ছেন। দেশের কোনও কোনও অর্থনীতির ব্যাখ্যাকর্তা আবার মধ্যলয়ের বৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ হতে পারে বলেও মতপ্রকাশ করছেন।
এই সব ভবিষদ্ব্যক্তার ফাঁদে না পড়ে অনুমানের প্রশ্নটিকে এক বার দেখা যাক। ইতিপূর্বে মাত্র দু’টি পঞ্চবার্ষিক ক্ষেত্রে ভারতে বৃদ্ধির দ্রুত গতিছন্দ দেখা গিয়েছিল। প্রথমটি ২০০৩-’০৪ অর্থবর্ষ থেকে ২০০৭-’০৮ অর্থবর্ষের মধ্যে। এবং দ্বিতীয়টি ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যবর্তী পর্বে, যে সময়ে খনিজ তেলের মূল্যহ্রাস আর্থিক বৃদ্ধির অনেকটাই সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দুই পর্বের অব্যবহিত পরবর্তী সময়কালে বৃদ্ধির গতিছন্দে পতনের তীব্রতা লক্ষণীয় ছিল। প্রথমটির অনুবর্তী হয়ে আসে এক ঘোর অর্থসঙ্কট এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মাথা তোলে অতিমারি। বিগত তিন অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গড় পরিসংখ্যান ১.৯ শতাংশ।
স্বাভাবিক ভাবেই এই নিম্ন অবস্থান থেকে বৃদ্ধির হার যে দ্রুত হবে, তা অনুমান করা যায়। এমন ক্ষেত্রে আবার এই ধরনের অনুমানও ক্রিয়াশীল থাকে যে, অতিমারির ফলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এবং পরিবহণ পরিকাঠামো ও ডিজিটাইজেশনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে লগ্নি উৎপাদন-জনিত বৃদ্ধিকে সম্ভব করে তুলবে। প্রথম অনুমানটি অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ, অন্তত ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মাপের ব্যবসা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিরিখে তো বটেই। এই পর্বে বহু মানুষ পূর্বতন জীবিকা থেকে কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে পরিবর্তনটি বিপরীত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল।
পাশাপাশি, পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়টির দিকে তাকালে বোঝা যায়, তা যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিকূল। উত্তর অতলান্তিক অঞ্চলের বহু দেশেই অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে। এক অমর ভাইরাস, সামরিক সঙ্ঘাত এবং বিঘ্নতায় দীর্ণ সরবরাহ এর পিছনে ক্রিয়াশীল। সমান্তরালে রয়েছে দেশগুলির অভ্যন্তরীণ তিনটি সমস্যা। যথা: মোট গৃহজ উৎপাদন বা জিডিপি-র তুলনায় প্রায় দুই অঙ্কের আর্থিক ঘাটতি (কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়তই), সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট’ (ভিন্ন দেশে পণ্য বিক্রয়লব্ধ আয় এবং অন্য দেশ থেকে পণ্য ও পরিষেবা ক্রয়ের মধ্যেকার ঘাটতি) ও সরকারি ঋণের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুদের হারের বৃদ্ধি। এই বিষয়গুলি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। এমন ক্ষেত্রে আশার ছলনে ভুলে উদ্বাহু হওয়ার চাইতে সাবধানে বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখাই বিধেয়।