বহ্নিশিখা: শিল্পীর তুলিকলায় বারণাবতের জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবদের নিষ্ক্রমণ
বগটুই, মালদহ, সুচপুর, কিভ, লখিমপুর খেরি, উন্নাও, আবু ঘ্রাইব, আউশউইৎজ়, হিরোশিমা, ট্রয়, কুরুক্ষেত্র। ফেসবুকের জনপরিসরে গত কয়েক দিন ধরে অপরাধীদের শাস্তি চাই, যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই গোছের বিপ্লব যত দেখছি, পারম্পর্যহীন এই নামগুলি মাথায় তত দলা পাকাচ্ছে। জানি, সব ক’টা এক রকম নয়। কোথাও হয়তো বালি-পাথরের বখরা নিয়ে গোলমালে রাতের অন্ধকারে গ্রামের ঘরবাড়িকে জতুগৃহ করে তোলা, কোথাও ধর্ষণ এবং রিরংসা। কোথাও রাজনৈতিক দলাদলি, কোথাও যুদ্ধ, জাতিবৈর বা জ্ঞাতিদের নিজস্ব হানাহানি। কিন্তু এ ভাবে কার্যকারণের অনুপুঙ্খ খতিয়ে কি হিংসার বিরোধিতা করা যায়? ভাবতে বসে ছোট হিংসা, বড় হিংসার ভাগাভাগি কোথাও খুঁজে পেলাম না। অরিন্দম চক্রবর্তী সম্প্রতি মহাভারত বিষয়ক এক নিবন্ধে সাফ জানিয়েছেন, নিরামিষাশী ধর্মধ্বজী মানুষ যদি মাংসাশীদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে, সে-ও নৃশংস পদবাচ্য।
বাড়াবাড়ি? পৃথিবীর মহাকাব্যগুলিতে হিংসারই ছড়াছড়ি। কখনও দুঃশাসন রজস্বলা ভ্রাতৃবধূ দ্রৌপদীর চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবেন রাজসভায়, কখনও বা আকিলিস মৃত ট্রোজান বীর হেক্টরকে রথের চাকায় বেঁধে ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে আসবেন গ্রিক শিবিরে। এই হিংসার গল্পগুলি চেনা সহজ। কিন্তু যেখানে এই রকম শ্বাসরোধী ঘটনা নেই? সেখানেও অন্তঃসলিলা হিংসা। ক্রুদ্ধ দুর্বাসা মুনি যদি পতিপ্রেমে বিভোর বালিকা শকুন্তলাকে অভিশাপ দেন, তাঁকেও হিংসার আঁতুড়ঘর থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। মহাভারত বলছে, বাচিক হিংসা সবচেয়ে মারাত্মক। “তিরে বিদ্ধ শরীর সেরে উঠতে পারে, কুঠার দিয়ে কেটে ফেলা জঙ্গল আবার গজাতে পারে, কিন্তু কথার খোঁটা বা বাক্ক্ষত কখনওই শুকায় না।” আজকের রাজনীতিতে এই বাচিক হিংসাই সর্বগ্রাসী। শুধু মারপিট আর ঘর জ্বালানোই তো সব নয়। বীরভূমে যিনি পুলিশকে বোমা মারার নিদান দেন, আর দিল্লিতে যিনি দিবালোকে ‘গোলি মারো’ হাঁকেন, দু’জনেই সমান হিংস্র।
মহাভারত অবশ্য শুধু রাজসভার বাচিক হিংসায় থেমে থাকে না। পরিবারেও কি নেই এই হিংসা? গান্ধারীর শতপুত্র জন্মের কারণই তো কুন্তীর ছেলে হয়েছে জেনে হিংসা। ব্যাসদেব গান্ধারীকে শতপুত্রের জননী হওয়ার আশীর্বাদ করেন। কিন্তু গর্ভলক্ষণের পর দু’বছর পেরিয়ে গেলেও গান্ধারীর সন্তান হয় না। স্বামীকে না জানিয়ে গান্ধারী গর্ভপাত করতে গেলেন। লোহার গোলক বেরিয়ে এল। পরে ব্যাসদেবের অনুজ্ঞায় সেটি একশো খণ্ডে ভাগ করে ঘি-ভর্তি কলসিতে রাখা হল। দুর্যোধন, দুঃশাসনরা জন্মালেন। ব্যাসদেবের আশীর্বাদ বৃথা গেল না।
আরও পরে, কুরুক্ষেত্রে জয়দ্রথ বধ। কৃষ্ণের মায়ায় মধ্য দুপুরেই রাতের অন্ধকার নামে। অর্জুনের তিরে জয়দ্রথের শিরশ্ছেদ। আগেই কৃষ্ণ জয়দ্রথের বাবা বৃদ্ধক্ষত্রের কথা জানিয়ে সতর্ক করেন অর্জুনকে। জয়দ্রথের জন্মকালে ভবিষ্যদ্বাণী হয়েছিল, রণক্ষেত্রে এক বীরের হাতে এর মৃত্যু হবে। বৃদ্ধক্ষত্র পাল্টা অভিশাপ দেন, জয়দ্রথের মাথা যে মাটিতে ফেলবে, তারই মাথা শতধা বিদীর্ণ হবে। অর্জুন তাই একের পর এক তির মেরে জয়দ্রথের মাথা উড়িয়ে দিতে থাকলেন। বৃদ্ধক্ষত্র তখন রণাঙ্গন থেকে বহু দূরে স্যমন্তপঞ্চক তীর্থে তপস্যা করছিলেন। কাটা মুন্ডু গিয়ে পড়ল তাঁর কোলে। বৃদ্ধক্ষত্র চমকে উঠে সেটি ফেলে দিলেন। এ বার তাঁরই মাথা ফুটিফাটা।
মহাভারত-এ হিংসা কোথায় নেই? আদিপর্বে নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা, সপ্তরথী মিলে অভিমন্যু বধ, যুদ্ধ শেষে রাতের অন্ধকারে অশ্বত্থামার পাণ্ডবশিবিরে এসে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে হত্যা। মহাকাব্যের শুরু রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ থেকে। রাজা পরীক্ষিতের পুত্র তিনি। তক্ষক নাগের দংশনে পরীক্ষিতের মৃত্যু, প্রতিশোধ নিতে জনমেজয় আস্তিক মুনির পৌরোহিত্যে সর্পযজ্ঞের আয়োজন করেন। একটি সাপকেও তিনি বাঁচতে দেবেন না। এই সর্পযজ্ঞ থেকে ফিরেই নৈমিষারণ্যে সৌতি সমবেত ঋষিদের কুরু-পাণ্ডবের গল্প শোনান। মহাকাব্য শুরুই হয় সর্পধ্বংসের যজ্ঞ দিয়ে। তার পর সভাপর্বে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন। তার পর কুরুক্ষেত্র, অশ্বমেধ, স্ত্রী পর্বে নারীদের হাহাকার, কত কী!
অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সদ্যপ্রকাশিত মহাভারতে হিংসা নামের প্রবন্ধ সঙ্কলনটি পড়তে গিয়ে মনে হল, এই মহাকাব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য অন্যত্র। সে বর্তমানের মতো হিংসার বিপরীতে কখনও অহিংসা শব্দটিকে ভাবেনি। অরিন্দম থেকে আলফ হিল্টবাইটেল, সদ্যপ্রয়াত মুকুন্দ লাঠ, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, কণাদ সিংহ প্রমুখ মহাভারতবেত্তাদের লেখায় বার বার ফিরে এসেছে একটি শব্দ— আনৃশংস্য। মানে, নৃশংস না হয়ে রইবার মানসিক অবস্থা।
বনবাস পর্বে মার্কণ্ডেয় ঋষি এসে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মব্যাধের গল্প শুনিয়েছিলেন। কৌশিক নামে এক তপস্বী তপস্যা করছিলেন। এক বক তাঁর মাথায় পুরীষ ত্যাগ করলে কৌশিক রেগে তাকান। পাখিটি ভস্ম হয়ে যায়। কৌশিক অনুতপ্ত হন। তার পর এক গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা চান। বাড়ির গৃহিণী তাঁকে ভিক্ষা দেবেন, বলেন। কিন্তু ক্লান্ত গৃহকর্তা তখন বাড়ি ফেরেন। গৃহিণী কৌশিককে দরজায় দাঁড় করিয়ে স্বামীকে জল ও খাবার দিতে যান। ভিক্ষা নিয়ে এসে দেখেন, কৌশিক প্রবল ক্রুদ্ধ, আমাকে এত ক্ষণ দাঁড় করিয়ে স্বামীকে তোয়াজ করা! ভদ্রমহিলা সটান বলেন, দেখুন, আমি বক নই যে ভস্ম হয়ে যাব। স্বামীসেবা পতিব্রতা রমণীর ধর্ম। কৌশিক বুঝলেন, ভদ্রমহিলা তাঁর চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর। অলৌকিক ক্ষমতা পেতে মহিলার শিষ্যত্ব চান। ভদ্রমহিলা বলেন, আমি আপনার গুরু হওয়ার উপযুক্ত নই। আপনি বরং মিথিলা নগরে ধর্মব্যাধের কাছে যান। কৌশিক গিয়ে দেখেন ব্যাধ বাজারে মাংস বিক্রিতে ব্যস্ত। কোথায় বেদপাঠী ব্রাহ্মণের তপস্যা আর কোথায় মাংসবিক্রেতা ব্যাধ! কিন্তু ধর্মব্যাধ তাঁকে চমৎকার সব কথা বলেন, কে পুরোপুরি অহিংস? লাঙল দিয়ে জমি চষতে গেলেও অনেক প্রাণী হত হয়। জলে অনেক মাছই ছোট মাছ খায়। শেষে বলেন, আপনি গৃহত্যাগের পর আপনার শোকে আপনার মা-বাবা কেঁদে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। আপনি এখন বাড়ি গিয়ে তাঁদের সেবা করুন। সেই প্রসঙ্গেই আনৃশংস্য। ধর্মব্যাধ পেট চালাতে বাজারে মাংস বিক্রি করলেও অনর্থক পশুহত্যা করেন না। এই আনৃশংস্যতাই তাঁর কাছে ধর্ম। রসতাত্ত্বিক মুকুন্দ লাঠের বয়ানে, “মহাভারত যা প্রচার করে তা অহিংসা নয়, আনৃশংস্য। এটি এই মহাকাব্যের অসাধারণ নৈতিক ধারণাগুলির একটি।” যে মহাভারত-এ নিষাদপুত্র একলব্য বুড়ো আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দেয়, নিষাদী-সহ তাঁর পাঁচ পুত্রকে পুড়িয়ে মারেন ধর্মরাজ, সেখানেই বনবাসী তপস্বী ধর্মশিক্ষা নেন এক ব্যাধের কাছে। বস্তুত, বনপর্বের শেষে বকরূপী যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন, আনৃশংস্য পরো ধর্ম। শেষে যুধিষ্ঠির যে সঙ্গী কুকুরটিকে ছেড়ে সশরীরে স্বর্গে যেতে নারাজ, সেটাও আনৃশংস্য। ধর্ম তাই কুকুরের রূপ ছেড়ে স্বরূপে অবতীর্ণ হন।
তা হলে আমি যদি আনৃশংস্য হয়ে কাউকে পেটাই? এখানেই মহাভারত চমৎকার আর একটি শব্দ ব্যবহার করে। অনুক্রোশ! কোনও মানুষ বা প্রাণী চোখের সামনে কষ্ট পাচ্ছে দেখলে যে স্বাভাবিক সমবেদনা, আহা, ওর জায়গায় আমি থাকলে কেমন লাগত সেই সমবেদনাই অনুক্রোশ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা হয় না। কে নৃশংস জানাতে গিয়ে মহাভারত বলছে, যে সারা ক্ষণ অন্যের নিন্দা করে। যখন চার পাশে লোকে খেতে না পেলেও কেউ সুস্বাদু খাবার পায় ও ভোজন করে, সে নৃশংস।
অহিংসা প্রতর্কটি যে আনৃশংস্যের কাছে কত দুর্বল, তার উল্লেখ আছে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায়। গৃহত্যাগী শ্রমণধর্ম আর বেদবিহিত গার্হস্থ ধর্মের যুগসঞ্চিত পরম্পরার টানাপড়েন যে এই মহাকাব্যে পাশাপাশি রাখা সবাই জানেন। সেই টানাপড়েনেই অহিংসার জায়গায় আনৃশংস্য শ্রেয় হয়ে ওঠে। শিবাজীবাবু জানান, টানাপড়েন যে কত সাঙ্ঘাতিক, তার উল্লেখ আছে পতঞ্জলির মহাভাষ্য-এও। সেখানে ব্রাহ্মণ-শ্রমণ বিরোধকে শাশ্বত বলছেন মহাভাষ্যকার। আনৃশংস্য এই বিরোধ মেটানোর মহাভারতীয় প্রতর্ক। যে প্রতর্ক বলে, হিংসার অতিরেক যেমন ঘৃণ্য, অহিংসাও সে রকম অসম্ভব আদর্শ। আনৃশংস্য ও অনুক্রোশ শব্দ দু’টি এখানেই বাংলা ভাষার নতুন পাথেয় হতে পারে। হিন্দির অনুকরণে এই ভাষায় যখন অনেক নতুন শব্দ ‘লাগু’ হল, সংস্কৃত শব্দ দু’টি গ্রহণে আর আপত্তি কী?
অন্তত, বাঙালি ঐতিহ্য তাই বলে। বিশ্বভারতীতেই সুখতঙ্কর শুরু করেন মহাভারত-এর ক্রিটিক্যাল এডিশনের চিন্তা। মধ্যযুগের কাশীরাম দাসের পাশাপাশি আছেন আধুনিক কালের কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজশেখর বসু। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের লেখায় ফিরে আসে মহাভারতের সন্ধান। এই শহরেই একক প্রয়াসে নীলকণ্ঠের টীকা-সহ মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ। মহাভারত-এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ উনিশ শতকে এই শহরেই। কিশোরীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। বাঙালি অস্মিতা মানে শুধু নীল-সাদা নয়, মহাভারতীয় চেতনাও!