ফাইল চিত্র।
পুজোর সময় বাড়িতে আসত গ্রামোফোন কোম্পানির শারদ অর্ঘ্য। সেই বইয়ে গানের কথা থাকত, সুরকার-গীতিকার-শিল্পীর নাম থাকত। থাকত শিল্পীদের ছবিও। সেই ছবিই ছোটবেলায় এক বিচিত্র প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল— সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কি সব সময় হাসেন? গান গাওয়ার সময়ও? পরে যত বার অনুষ্ঠানে তাঁর গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, ছোটবেলার সেই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যয়ে দৃঢ় হয়েছে— হ্যাঁ, তাঁর হাসিমুখ তাঁকে ছেড়ে যায় না গান গাওয়ার সময়ও।
তিনি কত বড় মাপের শিল্পী, সঙ্গীতের কত শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ, সে সব জানা-বোঝার ঢের আগেই পাড়ার পুজোমণ্ডপের চোঙা-মাইক বুঝিয়ে দিয়েছিল, সন্ধ্যা এক আনন্দময় বিষাদের নাম। সেই ছোট বয়সেই মোক্ষম এক বিরহের দিকে মন গড়িয়েছিল— “চন্দনপালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে/ জীবনে তোমায় যদি পেলাম না!” কী সেই গানের শব্দার্থ, তা বোঝার দায় সেই বয়সের ছিল না। কিন্তু মনখারাপ করিয়ে দিত অচেনা ভদ্রমহিলার শ্রীকণ্ঠের আকুলতা। সেই কণ্ঠ ছায়ার মতো জড়িয়ে যেত সর্বাঙ্গে। এই ছায়ার মতো, মায়ার মতো জড়িয়ে যাওয়ার জাদুতেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমবাঙালির মূর্ত সরস্বতী। যাঁকে ছাড়া উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখা বৃথা। যাঁর কণ্ঠের আলপনাপথে কোজাগর-লক্ষ্মীর আবাহনমন্ত্র রচিত হয়, ‘শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে’ আনা সার্থক হয়। যাঁর ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’ মহালয়া-ভোরে জেগে ওঠে মনের চণ্ডীমণ্ডপ।
এ জাদু আচমকা ঘটে না। সলতে পাকানোর ইতিহাসপর্বও থাকে। প্রশিক্ষণ থাকে, থাকে ভাঁড়ার-উপচানো শ্রবণ-অভিজ্ঞতাও। যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখা শুরু করা সন্ধ্যা পরে নাড়া বেঁধেছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে। পরে তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছেও পাতিয়ালা ঘরানার রসসমুদ্রে অবগাহন চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই ভিত্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আজীবন সঙ্গ দিয়েছে। তথাকথিত ‘কঠিন’ গান তাই অনায়াসে সন্ধ্যার জন্য বরাদ্দ করে গিয়েছেন রসিক সুরকারেরা। নানা ধরনের গান গেয়েছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়েছেন। বাংলা বেসিক রেকর্ডে ঝড় তুলেছেন। ছায়াছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়েছেন। গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান। গেয়েছেন ‘প্রভুজি তুমি দাও দরশন’-এর মতো তুলনাহীন বাংলা ভজন।
এই সব ধরনের গানে তাঁর পারঙ্গমতার প্রধান কারণ যদি শাস্ত্রীয় তালিম হয়, তবে দ্বিতীয় কারণ গানের নাটকীয়তার দক্ষ পেশকারি। যেমন, ‘তুহুঁ মম মনপ্রাণ হে’। অনিল বাগচীর সুরে এন্টনী ফিরিঙ্গী ছবির গান। যে-কণ্ঠ সুচিত্রার সমনাম্নী হয়ে উঠেছিল, তার বিন্দুমাত্র সমস্যাও হয়নি তনুজার হয়ে উঠতেও। সন্ধ্যা যখন গাইছেন ‘তটিনীসম ভেসে যাই’, তখন ভেসেই যাচ্ছে তাঁর কণ্ঠসাম্পান সুরদরিয়ায়। ‘আমি যে জলসাঘরে’ গানেও সন্ধ্যা-মান্না জুটি অবিস্মরণীয় নাটকীয়তার কারণে।
নানা রঙের গানে সন্ধ্যার পৃথিবী বিপুল। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কনসার্ট করেছেন। রাগপ্রধান গান গেয়েছেন বহু ছবিতেও। অসিত সেনের উত্তর ফাল্গুনী-তে তাঁর খাম্বাজ-নিবদ্ধ ‘তোরে নয়না লাগে’ এবং একই ছবির আরও কিছু গানে তার নিদর্শন। কীর্তনের রস চুইয়ে পড়েছে কমললতা ছবির গানে-গানে। ভৈরবী-মায়ায় ‘সে বিনে আর জানে না’ বাউলাঙ্গ কীর্তনে পাগল করে দেন শ্যামল মিত্রের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আবার ‘নয়নমোহন শ্যাম’ একেবারে ভাঙাতাল-তালফেরতা আখরকীর্তন। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পূর্ণস্বাক্ষর জয়জয়ন্তী ছবি। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে সেখানে তিনি রাগাশ্রয়ী ‘কেন ডাকো বারে বারে’ গাইছেন, তেমনই গাইছেন ‘বাহ্, ছড়াটা তো বেশ’ জাতীয় মজার গানও। এ গান এবং ‘কে প্রথম চাঁদে গেছে’ গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতকাঠামোয় কণ্ঠকে অনায়াস-লীন করছেন। আবার একই ছবিতে জৌনপুরী-আশ্রিত দ্রুত তিনতালের ‘ঝন ঝনন সুরঝঙ্কারে’ বন্দিশে মুনাবর আলি খানের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দি অবিস্মরণীয়।
প্রাচ্যের মার্গদানা ব্যবহারই হোক বা পাশ্চাত্যের ‘ক্রুনিং’, সন্ধ্যা অনতিক্রম্যই। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটি আর-পাঁচটা গানের মতো নয়। অগ্নিপরীক্ষা-র এই গানে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আর অনুপম ঘটকের সুরে ‘কাকলি কুহু’র বিস্ময় অনুরণন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব। একই গানে ‘মৌমাছিদের গীতালি পাখায় বাজায় মিতালি’র রাগাশ্রয়ী আঙ্গিক ‘মিড়-দোলানো’ অংশে সপ্তকসুধার স্বর্গরচনা করে। প্রতিটি গানকে তার সুরের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে গিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’র ভাব আর ‘কে তুমি আমারে ডাকো’র আবেশ সুরকাঠামোর নির্দেশ মেনে গায়নশিল্পে আলাদা হয়ে যায়।
শচীন দেব বর্মণের ডাকে সন্ধ্যা যখন মুম্বই যান, সেই দুনিয়া যেন তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিল। একের পর এক ইতিহাস। শচীনকর্তার সুরেই সাজা ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ‘গুপচুপ গুপচুপ পেয়ার করে’ সে কালের নব্যপ্রজন্মের মুখকলি হয়ে উঠেছিল। মুম্বইয়েই সন্ধ্যা-লতার সখ্য শুরু। মুম্বইয়ে সন্ধ্যার প্রথম প্লে-ব্যাক তারানা-য়। সেই ছবিতে অনিল বিশ্বাসের সুরে লতার সঙ্গে তাঁর গান ‘বোল পাপিহে বোল’ শুনলেই বোঝা যায়, কেন গোটা দেশ সেই গানে কান পেতেছিল। অনিল বিশ্বাসেরই সুরে ফরেব ছবিতে ‘উদাসিয়োঁ মে নজ়র খো গয়ি’র মতো নির্জনতাও বেজেছিল তাঁর কণ্ঠে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের মুম্বইবাসে ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন সন্ধ্যা। বাহান্নয় ফেরেন কলকাতায়। তাঁরই সূত্রে আবারও মুখর হয়ে ওঠে প্রণব রায়, শ্যামল গুপ্তের মতো কবিদের কলম।
তাঁর কণ্ঠ-ঐশ্বর্যের কথা জলবৎ জানতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর সুরে এবং তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যার জুটি উত্তম-সুচিত্রা জুটির সমার্থক। পূর্ণাঙ্গ গান ছাড়াও হেমন্ত সপ্তপদী ছবিতে সন্ধ্যাকে দিয়ে অন্য ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানে হেমন্তের সঙ্গে গাওয়ার কথা ছিল অন্য এক শিল্পীর। কিন্তু সেই শিল্পীর গাওয়া পছন্দ হচ্ছিল না হেমন্তের। ডেকে পাঠান সন্ধ্যাকে। ঢাকুরিয়ার বাড়ির সামনের পুকুরপাড়ে সন্ধ্যা তখন বন্ধুদের সঙ্গে দুপুরের আড্ডায় মগ্ন। ডাক পেয়ে দ্রুত পৌঁছলেন স্টুডিয়োয়। কী করতে হবে, না-জেনেই। বারকয়েক মহড়ার পর রেকর্ডিংয়ে গেলেন হেমন্ত। জন্ম নিল ‘লাল-লা-লা-লা/ লাল-লা-লা-লা’র গৌরচন্দ্রিকা-জাদু। মধ্যেমাঝে সন্ধ্যাকণ্ঠে ‘তুমি বলো’ বা ‘বলব না’ এবং শেষে ‘তুমি বলো-তুমিই বলো’র মিঠে-শরীরী খুনসুটি। আজ কল্পনাও করা যায় না যে, শুধু ওই সামান্য অংশে কণ্ঠ দেওয়া বা পরে সাকুল্যে একটি স্তবকে সুরবিস্তারে রাজি হলেন খ্যাতির শীর্ষে থাকা সন্ধ্যা, এবং সে-গানই বাঙালি প্রেমের পদাবলি হয়ে রইল। উত্তম-সুচিত্রা অবশ্যঋণী সন্ধ্যার কাছে।
সাদামাঠা-প্রচারবিমুখ-বিনয়ী জীবন, শিল্পের সব শাখার প্রতি শ্রদ্ধা আর অনুসন্ধিৎসু মন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে অমরত্ব দিয়েছে। যুগ বদলেছে, যুগচাহিদাও। তার সঙ্গে নিজেকে আপাদমস্তক বদলে ফেলার পথে হাঁটেননি তিনি। এই দৃঢ়তা বড় মাপের শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব, যিনি জানেন, যা রেখে যাওয়া গেল, তা অক্ষয়ধর্মেই চিরস্থায়ী হবে। তিনি অখণ্ড বাংলার উত্তরাধিকার। ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’ গানটি স্মরণীয়, যা সন্ধ্যা গেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের পাক-কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার স্মরণে। আবিদুর রহমানের লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তের সুরে সে-গানের ‘কী ভাল তোমাকে বাসি আমরা’ পঙ্ক্তিতে ধরা রয়েছে দু’বাংলার মানুষের অভিন্ন জাতিসত্তার শপথ।
তাঁর গানে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর কণ্ঠে শোনা যায় ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’র ডানা ঝাপটানোর শব্দ। তাঁর গায়কিতে ‘রাই আমাদের করছে সিনান’ স্মিত-লজ্জায় রাঙিয়ে ওঠে। পপ থেকে প্রার্থনা— তাঁর তুলনা তিনিই। বাংলা গানেতিহাসের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে তিনি এক প্রণম্য মাইলফলক। সন্ধ্যা স্থায়ী এবং সঞ্চারী।