Recruitment Scam Case

অগ্রিম দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করে রাখতেন, কিন্তু কিনতেন না পার্থ! ফাঁস টাকা ‘সাদা’ করার আরও এক কৌশল

নিয়োগ মামলার পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিট সম্প্রতি আদালতে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সেখানেই পার্থের একাধিক সংস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্ল্যাট না-কিনে অগ্রিম দিয়ে বুক করে রাখতেন তিনি।

Advertisement

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০৩
Share:

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিটে একাধিক আর্থিক তছরুপের অভিযোগ তুলেছে ইডি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

লাখ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করে রাখতেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কোনও ফ্ল্যাটই পুরোপুরি কিনে ফেলতেন না। নিয়োগ মামলার চার্জশিটে এমনটাই দাবি করেছে ইডি। তাদের বক্তব্য, অগ্রিম দিয়ে ফ্ল্যাট বুকিং করে সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। দুর্নীতির টাকাও তার মাধ্যমে ‘সাদা’ করে ফেলতেন।

Advertisement

নিয়োগ মামলার পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিট সম্প্রতি আদালতে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সেখানেই বলা হয়েছে, একাধিক সংস্থার মাধ্যমে পার্থ ‘আর্থিক তছরুপ’ করেছেন। কী ভাবে, কোন কৌশলে টাকা বিনিয়োগ করতেন তিনি, তার বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ইডির চার্জশিটে। ফ্ল্যাট বুকিংয়ের মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগ পার্থের অন্যতম কৌশল ছিল, দাবি কেন্দ্রীয় সংস্থার। একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।

ইডি জানিয়েছে, বহু নির্মাণ সংস্থাকে অগ্রিম দিয়ে রেখেছিলেন পার্থ। কলকাতা এবং শহরতলিতে একাধিক ফ্ল্যাট বুক করে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও ফ্ল্যাটের জন্যই পুরো টাকা দেননি। অর্থাৎ, একটি ফ্ল্যাটও কিনে ফেলেননি। ফ্ল্যাট সংক্রান্ত লেনদেনের জন্য পার্থ দু’টি সংস্থার মালিকানা গ্রহণ করেছিলেন বলে জানিয়েছে ইডি। ইমপ্রোলাইন কনস্ট্রাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড এবং এইচআরআই ওয়েল্‌থ ক্রিয়েশন রিয়েলটর্‌স প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমেই যাবতীয় ফ্ল্যাট বুকিং করতেন তিনি। কোথাও পাঁচ লক্ষ টাকা, কোথাও ১৪ লক্ষ টাকা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই নির্মাতারা জানিয়েছেন, ফ্ল্যাটের বাকি অর্থ তাঁরা আর হাতে পাননি।

Advertisement

কোনও ফ্ল্যাট বুকিংয়ের ক্ষেত্রেই নিজের নাম ব্যবহার করতেন না পার্থ। রাজীব দে নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে তিনি ফ্ল্যাট সংক্রান্ত কাজ করাতেন। রাজীবকে সামনে রেখেই ফ্ল্যাটগুলি কেনা হত। রাজীব জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। চার্জশিটে সুরঞ্জিতা জানা নামের এক মহিলার নামও উল্লেখ করেছে ইডি। পার্থের ফ্ল্যাট সংক্রান্ত সংস্থাগুলির ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ফ্ল্যাট বুকিংয়ের কাগজপত্রেও পার্থের নির্দেশে স্বাক্ষর করতেন এই সুরঞ্জিতা।

ইডির জেরার মুখে রাজীব জানিয়েছেন, তিনি এবং সুরঞ্জিতা এইচআরআই ওয়েল্‌থ ক্রিয়েশন রিয়েলটর্‌স প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর হয়েছিলেন। ইমপ্রোলাইন কনস্ট্রাকশনস্‌ প্রাইভেট লিমিটেডের মালিকানা গ্রহণের পর এই সংস্থার ডিরেক্টর করা হয়েছিল সুরঞ্জিতা এবং পার্থের স্ত্রী বাবলি চট্টোপাধ্যায়কে। পরে বাবলির মৃত্যুর পর এই সংস্থারও অন্যতম ডিরেক্টর হন রাজীব। পরে পার্থের জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য এবং আত্মীয় কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারীকে এই সংস্থাগুলির ডিরেক্টর করা হয়েছিল। পার্থের নির্দেশেই তাঁরা কাজ করতেন। ইডি জানিয়েছে, এই দুই সংস্থা একাধিক ফ্ল্যাটের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু একটি ফ্ল্যাটও কেনেনি। এখনও তাদের খাতায় লক্ষ লক্ষ টাকা বাকি পড়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে ইমপ্রোলাইনের জমি এবং টাকা বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইডি।

  • রিভারব্যাঙ্ক ডেভেলপার্স প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর সুমিত ডাবরিওয়ালা ইডিকে জানিয়েছেন, পার্থের সংস্থা ইমপ্রোলাইন তাদের একটি ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছিল। ২০১৫ সালে ওই সংস্থার নামে ফ্ল্যাট বুকিং করা হয়। সেই বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। ফ্ল্যাটটির দাম ছিল ১ কোটি ৫১ হাজার ৪৭২ টাকা। কিন্তু পাঁচ লক্ষের বেশি এক টাকাও দেয়নি ইমপ্রোলাইন। দীর্ঘ দিন অপেক্ষার পর ২০২২ সালে ফ্ল্যাটের বুকিং বাতিল করে দেয় সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ইমপ্রোলাইনের সঙ্গে তাদের চুক্তির নথিও নষ্ট করে ফেলা হয়। ওই ফ্ল্যাট এখন অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ইমপ্রোলাইনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পাঁচ লক্ষ টাকাও।
  • ইডেন রিয়্যাল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডের অমিতাভ পাত্র ইডিকে জানিয়েছেন, মহেশতলায় তাদের একটি ফ্ল্যাট বুক করেছিল ইমপ্রোলাইন। ফ্ল্যাটটির মোট দাম ছিল ৫০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার জন্যও পাঁচ লক্ষের বেশি কোনও টাকা দেওয়া হয়নি। ৪৫ লক্ষ টাকা ওই সংস্থার কাছে এখনও বাকি পড়ে আছে। অভিযোগ, টাকা চাইতে গেলে ইমপ্রোলাইনের লোকজন পার্থের নাম করতেন। দ্রুত টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে আশ্বাস দিয়েছিলেন পার্থ নিজেও। অমিতাভ জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারে পার্থের অবস্থানের কথা ভেবে, তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবের কথা ভেবে তাঁরা টাকা না-পেয়েও ফ্ল্যাটের বুকিং বাতিল করতে পারেননি। বার বার চাওয়ার পরেও ফ্ল্যাটের বাকি টাকা দেওয়া হয়নি।
  • অম্বুজা নেওটিয়া হোটেল ভেঞ্চার্স লিমিটেডের ডিরেক্টর দীপক কুমার হারলালকাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের একটি প্রকল্পে পার্থ আগ্রহী ছিলেন। ইমপ্রোলাইনের নামে জমিও বুক করে রাখা হয়েছিল। জমি কিনে ১৮৫০ স্কোয়্যারফুটের বাংলো তৈরির জন্য মোট ৮২ লক্ষ টাকা খরচ করার কথা ছিল সেখানে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পার্থের সংস্থার কাছ থেকে মাত্র ১৪ লক্ষ টাকাই পাওয়া গিয়েছে। পার্থের রাজনৈতিক অবস্থানের কথা ভেবে টাকা না-পেলেও বুকিং বাতিল করতে পারেনি সংস্থাটি। অম্বুজা নেওটিয়ার ডিরেক্টর হর্ষবর্ধন নেওটিয়াকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি। তিনি দীপকের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
  • আইডিয়াল রিয়্যাল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর নকুল হিমাতসিংকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি জানতে পেরেছে, ইমপ্রোলাইন ২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকার একটি ৪বিএইচকে ফ্ল্যাট বুক করেছিল। তার জন্য ২০১৬ সালে অগ্রিম দিয়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। পরে আরও ১২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল ওই ফ্ল্যাট বাবদ। কিন্তু এর পর আর কোনও টাকা দেওয়া হয়নি।
  • এসকেডিজে গ্রুপের ডিরেক্টর সুশীল কুমার আগরওয়ালও ইডিকে জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে ইমপ্রোলাইন তাদের একটি ৭০ লক্ষ টাকা দামের ফ্ল্যাট বুকিং করেছিল ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে। তার পর আর কোনও টাকা না-দেওয়ায় বুকিংটি বাতিল করে দেওয়া হয়। অন্যত্র ওই ফ্ল্যাট বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অগ্রিম হিসাবে ইমপ্রোলাইনের দেওয়া ১২ লক্ষ টাকার কোনও দাবিদার তাদের কাছে আসেননি। তাদের নথি বলছে, ফ্ল্যাটটি কিনতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন পার্থের স্ত্রী স্বয়ং।

কেন ফ্ল্যাট কেনা হত না?

‘কালো’ টাকা ‘সাদা’ করার জন্য কেন ফ্ল্যাট কিনতেন না পার্থ? কিনে রাখলে কী সমস্যা ছিল? ইডি সূত্রে দাবি, একটি ফ্ল্যাট কিনে তার জন্য কোটি টাকা খরচ না-করে অল্প অল্প টাকা দিয়ে একাধিক ফ্ল্যাট বুকিং করে রাখার সুবিধা বেশি। এতে ওই টাকার ‘সদ্ব্যবহার’ও হয়, আবার নিজের সম্পত্তির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। সেই কারণেই পার্থ এই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement