দম: তিনটি কেন্দ্রীয় কৃষি আইন রদ করার দাবিতে কৃষক সমাবেশ। পাটিয়ালা, পঞ্জাব। ১২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
মোদী সরকারের কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে চলমান কৃষক আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ। জুন মাসে লকডাউনের মাঝে মানুষের সঙ্কটে মুনাফার সুযোগ খোঁজা সরকার যখন অর্ডিন্যান্স জারি করে, তখন থেকেই আন্দোলন শুরু। সেপ্টেম্বরে অর্ডিন্যান্সকে জোর করে আইনে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। দেশ জুড়ে বিরোধ শুরু হয়। ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসে দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটের মাঝে কৃষক আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে যায় রাজধানীর সীমানায়। রাস্তা খুঁড়ে, ব্যারিকেড তুলে, জল-কামান আর অশ্রু-গ্যাসের গোলা ছুড়ে সে ঢেউকে আটকে রাখা যায়নি।
২৬ নভেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গোটা দেশে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে যায়। দিল্লি সীমান্তে সিংঘু, টিকরি, গাজ়িপুর বর্ডারে গড়ে ওঠে কৃষক প্রতিবাদের ছাউনি। সরকারের যাবতীয় অপপ্রচার সত্ত্বেও আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গণসমর্থন তাকে রক্ষণাত্মক অবস্থায় ঠেলে দেয়। আন্দোলনকে লাঠি গুলি চালিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া বা উপেক্ষা ও ক্লান্তিতে কৃষকের মনোবল দুর্বল করে দেওয়া, দুই রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় সরকার ও কৃষক নেতাদের আলাপ আলোচনা। সমাধান খোঁজার কোনও ইচ্ছে অবশ্য চোখে পড়েনি, আলোচনার নামে কৃষকের ধৈর্যের এবং ঐক্যের পরীক্ষা নেওয়াই বোধ হয় ছিল সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য।
আলোচনার অচলাবস্থা দেখে ২৬ জানুয়ারির আগে সুপ্রিম কোর্ট বল নিজের কোর্টে নিয়ে নেয়। কিন্তু তাতেও কৃষকদের ঘরে ফেরানো যায়নি। বরং ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর প্যারেডে যোগ দিতে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ থেকে ‘দিল্লি চলো’ ডাকে ট্র্যাক্টরের ঢল নামে। মরিয়া সরকার ও তার সহযোগী মিডিয়া লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের খণ্ডচিত্র দেখিয়ে কৃষকদের অভূতপূর্ব প্যারেড এবং কৃষকের সঙ্গে দিল্লিবাসীর ব্যাপক সহমর্মিতার ছবিকে দেশের জনগণের চোখে আড়াল করে। জনগণের চোখে আন্দোলনকে হেয় করে পুলিশ নামিয়ে ও ‘স্থানীয় লোকের আপত্তি’র নামে দলীয় বাহিনীকে উস্কে দিয়ে হামলা করে আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার যুদ্ধে নামে সরকার। সাময়িক ভাবে অনেকেরই মনে হয় সরকারের এই ছক বোধ হয় সফল হয়ে গেল।
কিন্তু সরকারের সমস্ত আশায় জল ঢেলে, আমাদের সমস্ত আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে কৃষক আন্দোলন আরও বেশি শক্তি ও প্রত্যয় নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পঞ্জাবের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে এসেছে হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ। জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহাপঞ্চায়েত। উপচে পড়ছে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে কৃষকের ভিড়। মুজফ্ফরনগর দাঙ্গা জাঠ ও মুসলিম কৃষকদের মধ্যে যে প্রাচীর তুলে দিয়েছিল, তা ভাঙতে শুরু করেছে। কৃষক নেতারা ২ অক্টোবর গাঁধী জয়ন্তী পর্যন্ত সরকারকে সময় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন কৃষক আন্দোলনে ক্লান্তি নেই। আর আন্দোলন যত দীর্ঘ হবে ততই তার বিস্তার ঘটবে, ভৌগোলিক ব্যাপ্তি ও সামাজিক গভীরতা, দু’দিক থেকেই।
রাজ্যসভা ও লোকসভায় মোদীর দীর্ঘ ভাষণের অনেকটা অংশ জুড়েই থেকেছে কৃষক আন্দোলনের কথা। কখনও ধমক, কখনও অভিভাবকসুলভ উপদেশ, কখনও খোলাখুলি চোখরাঙানি। বেশ বোঝা যাচ্ছে সরকার এখন নিজের আইনের জালে নিজেই আটকে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ভবিষ্যতে মানুষ এই আইনের সুফল বুঝতে পারবে। ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষে ভারত এ জন্য মোদী সরকারকে ধন্যবাদ জানাবে। তার মানে এখন সরকার এই আইনের প্রয়োজন বা সুফল বোঝাতে ব্যর্থ, তাই সুদূর ভবিষ্যতের কথা। অভিভাবকরা যেমন অনেক সময় বলেন ‘বড় হলে বুঝবে’।
মোদী এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কৃষকরা কখনও এমন আইন দাবি করেননি। সরকার নিজেই এটা করেছে, আর মোদী এর তুলনা করেছেন বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথাজনিত হিংসা নিবারক আইনের সঙ্গে— ওই আইনগুলো নাকি কোনও সামাজিক প্রয়োজনবোধ বা চাহিদা ছাড়াই প্রণীত হয়েছে! সমাজ সংস্কার আইনের সঙ্গে কৃষিতে কর্পোরেট দখলদারি প্রতিষ্ঠার আইনের তুলনা চলতে পারে না, আর সমাজ সংস্কারের প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে আছে দীর্ঘ আলোড়ন, আন্দোলনের ইতিহাস।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, ছোট কৃষকের স্বার্থেই নাকি এই আইন। ছোট কৃষকরা কি নিজেদের স্বার্থ বোঝেন না? এই আইন দাবি করা তো দূরের কথা, আইনের বিরুদ্ধে তাঁরা খুবই সরব। এই আন্দোলনে বিপুল অংশগ্রহণ তাঁদেরই। এই আইনে যদি ছোট কৃষকের লাভ হওয়ার কথা, তবে তো এত দিনে বিহারের কৃষকদের কপাল খুলে যেত। ২০০৬ সাল থেকে এনডিএ সরকার ওখানে কৃষি বাজার সমিতি ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে কৃষি বিপণনের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, আজ সবচেয়ে কম কৃষকের ফসল কেনে বিহার সরকার, সবচেয়ে কম দাম পায় বিহারের কৃষক, কৃষি আয়ের দিক থেকে তাঁরা দেশে সবার পিছনে।
এত দিন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বলা হত, তাঁরা নাকি মিছিমিছি কৃষক সমাজকেও শ্রেণিবিভক্ত মনে করেন, ধনী কৃষক, মধ্য কৃষক আর গরিব ভূমিহীন কৃষকের আলাদা আলাদা স্বার্থের কথা বলেন আর আলাদা আলাদা দাবি তুলে ব্যাপক কৃষক ঐক্য ও বৃহত্তর কৃষক আন্দোলনকে দুর্বল করে দেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে মনে হল, ছোট কৃষকদের বড় শত্রু নাকি বড় কৃষকরাই। সেচের জল থেকে শুরু করে কৃষি ঋণ, সবই নাকি বড় কৃষকরা কব্জা করে নিচ্ছেন বলে ছোট কৃষকরা কিছু পাচ্ছেন না। সরকার তা হলে ছোট কৃষকদের জন্য আলাদা ঋণ প্রকল্প, আলাদা অনুদানের ব্যবস্থা কেন করছে না? প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি বা পিএম কিসান প্রকল্প কেন শুধু জমির মালিক দেখে দেওয়া হচ্ছে? অন্যের জমি লিজ় নিয়ে যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা কেন বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি অনুদান ও মাসে পাঁচশো টাকার এই ন্যূনতম সহায়তা থেকে?
কৃষকরা মাসে পাঁচশো টাকার লোকদেখানো ‘সম্মান’ চাননি, চেয়েছেন ন্যায়সঙ্গত ন্যূনতম সমর্থন মূল্য বা এমএসপি। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো তা হওয়া উচিত সমগ্র কৃষি খরচের অন্তত দেড় গুণ। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এমএসপি ছিল, আছে, থাকবে। এটা কি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানা এমএসপি, যা বিজেপির ইস্তাহারে ছিল, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছিল এটা করা যাবে না? এমএসপি-র গ্যারান্টি কি সরকার দেবে, যাতে এমএসপি-র কম দামে কেউ কিনতে না পারে আর বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে কৃষক দাম হাতে পায়? প্রধানমন্ত্রী বলছেন, মান্ডিব্যবস্থা বহাল থাকবে, শুধু কেউ চাইলে অন্যত্র বিক্রি করতে পারেন। বিএসএনএল ও বহু পাবলিক সেক্টর খাতায় কলমে এখনও আছে, কিন্তু সরকারি বদান্যতায় সে জায়গায় কারা ফুলে ফেঁপে উঠছে, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে জানেন।
বোঝাই যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কৃষক আন্দোলন নিয়ে খুবই বিব্রত, বিরক্ত। আন্দোলনজীবী, পরজীবী ইত্যাদি বাছা বাছা শব্দ তিনি প্রয়োগ করেছেন ভগৎ সিংহ, গাঁধী, অম্বেডকরের উত্তরসূরিদের জন্য। রাজ্যসভায় বলেছেন, কৃষক আন্দোলনের পিছনে রয়েছে অন্য ‘এফডিআই’: ফরেন ডেস্ট্রাক্টিভ আইডিয়োলজি। কৃষকের সমর্থনে আন্তর্জাতিক মহল থেকে সামান্য দুটো টুইটেই বিদেশি মতাদর্শের কথা উঠে গেল? বিশ্বায়নটা শুধু পুঁজিমালিক ও মুনাফা-কামানো কোম্পানিদের জন্য, বিবেক আর সংবেদনশীল মন বাঁধা পড়ে থাকবে দেশের সীমানায়? লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষক আন্দোলন পবিত্র, কিন্তু সেখানে বন্দিমুক্তির মতো অপবিত্র দাবি কেন উঠছে? অর্থাৎ, কৃষক যেন অন্য কথা না বলে, অন্যরা যেন কৃষকের কথা না বলে।
জমি, চাষ ও ফসল— এই তিনটে কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়েই বড় বড় কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। নীলকর সাহেবদের চাপিয়ে দেওয়া নীলচাষের ফরমানের বিরুদ্ধে কৃষকের ধূমায়িত বিক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে চম্পারণ সত্যাগ্রহ। জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে: লাঙল যার জমি তার। ফসলের অধিকারের দাবি রচনা করেছে অমর গণসঙ্গীত: হেই সামালো...। এ বারের আন্দোলনের মূল কথা আবার ফসলের অধিকার। ফসল, তুমি কার? ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের ক্ষুধা মেটাতে আবার যেন আমেরিকার গমের উপর আমরা নির্ভর না হয়ে পড়ি। ফসলের উৎপাদক কৃষক আর উপভোক্তা জনসাধারণের মাঝে সরকারি প্রশ্রয়ে কোম্পানি রাজ যেন মুনাফার ব্যারিকেড আর বাজারের কাঁটাতারের বেড়া বিছিয়ে দিতে না পারে। ফসল যার, কৃষি তার। কৃষি থাকুক কৃষকের হাতে, ফসলের ফয়সালা কৃষকরাই করুন। সরকার কৃষকের পাশে থাকুক, কৃষকের ভেকধারী কোম্পানি রাজের হাতে নয়।